জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে কথার জট
ব্রাজিলের বেলেমে চলমান জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন কোপ৩০–এ প্রকাশিত নতুন খসড়া চুক্তি থেকে হঠাৎই উধাও হয়ে গেছে জীবাশ্ম জ্বালানি ছাড়ার বৈশ্বিক রোডম্যাপের প্রস্তাব। সপ্তাহের শুরুতে প্রকাশিত প্রথম খসড়ায় কয়লা, তেল ও গ্যাস থেকে ধীরে ধীরে সরে যাওয়ার বিষয়ে কয়েকটি বিকল্প ভাষা ছিল, যা কোপ২৮–এ গৃহীত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পথরেখা তৈরি করতে পারত। কিন্তু শুক্রবার ভোরে প্রকাশিত সংশোধিত খসড়ায় জীবাশ্ম জ্বালানির নামই আর নেই। এতে স্পষ্টভাবে সুবিধা পেয়েছে বড় উৎপাদনকারী দেশগুলো, যারা দীর্ঘদিন ধরে তেল–গ্যাসের ভবিষ্যৎ নিয়ে কড়া অবস্থান নিয়েছে।
জার্মানি, কেনিয়া ও নিম্নভূমি দ্বীপরাষ্ট্রসহ একাধিক দেশ এ পর্যন্ত জোর দিয়ে আসছিল অন্তত একটি স্পষ্ট রোডম্যাপের ওপর, যেখানে ধাপে ধাপে উৎপাদন ও ব্যবহার কমানোর লক্ষ্য নির্দিষ্ট থাকবে। তাদের যুক্তি, পরিষ্কার পরিকল্পনা না থাকলে ধনী উৎপাদনকারী দেশগুলো ব্যবসা আগের মতই চালিয়ে যাবে, আর চরম জলবায়ু দুর্যোগের ভর কাঁধে নিয়ে বাঁচতে হবে দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে। অপরদিকে তেল–গ্যাস রপ্তানিকারক দেশগুলো বলছে, অতিরিক্ত কঠোর ভাষা ব্যবহার করলে জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে এবং বাজারে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। ফলে নতুন খসড়ায় প্যারিস চুক্তির আগের বাধ্যবাধকতার কথাই ঘুরেফিরে এসেছে, কিন্তু নতুন কোনো কঠিন প্রতিশ্রুতি যোগ হয়নি।

অর্থায়ন, বাণিজ্য ও আগুনে বিঘ্নিত আলোচনা
খসড়ার অন্য অংশে জলবায়ু অভিযোজনের অর্থায়ন তিন গুণ বাড়ানোর লক্ষ্য রাখা হয়েছে—২০২৫ সালের ভিত্তি থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে। এর মাধ্যমে স্বীকার করা হয়েছে যে তাপদাহ, ঝড় আর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোকে অবকাঠামো–সহ নানা ক্ষেত্রে অগ্রিম প্রস্তুতির জন্য অনেক বেশি অর্থের প্রয়োজন। তবে কে কত দেবে সে ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি নেই; ধনী দেশগুলোর ঐতিহাসিক দায় নিয়ে সংবেদনশীল আলোচনাকে খসড়া এড়িয়ে গেছে। উন্নয়নশীল দেশের কাছে এটি কাগজে–কলমে অগ্রগতি হলেও নিশ্চয়তার দিক থেকে দুর্বল বলেই মনে হচ্ছে।
একই সঙ্গে পরবর্তী তিনটি সম্মেলনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও জলবায়ু নিয়ে একটি সংলাপ চালুর কথা যোগ হয়েছে, যেখানে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। কার্বন বর্ডার ট্যাক্স ও সবুজ শিল্পনীতির প্রভাব নিয়ে দীর্ঘদিন ধোঁয়াশায় থাকা দেশগুলোর জন্য এটি একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কার্বন বর্ডার লেভি নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতের তীব্র আপত্তি থাকায় এ আলোচনাও বেশ স্পর্শকাতর হয়ে উঠবে। পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে সম্মেলনস্থলে লাগা আগুন, যাতে কয়েক ঘণ্টা ধরে আলোচনা স্থগিত ছিল এবং গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হয়েছে।
![]()
শেষ মুহূর্তের দর–কষাকষি ও ভবিষ্যতের বিচার
কাগজে নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আজই কোপ৩০ শেষ হওয়ার কথা, যদিও প্রায় সব বড় সম্মেলনের মতোই আলোচনার সময় বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবু সম্মেলন–কক্ষের ভেতরে এখন চাপ স্পষ্ট—একদিকে জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানিকারক ও বড় অর্থনীতি, অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো। কোন ভাষা থাকলে সবাই রাজি হবে, আর কোন শব্দে এক বা একাধিক দেশ ভেটো দেবে—এই সূক্ষ্ম হিসাবেই কাটছে ঘন্টাগুলো। সমর্থকরা চাইছেন অন্তত নরম ভাষায় হলেও জীবাশ্ম জ্বালানি ছাড়ার প্রতিশ্রুতি ফেরানো হোক, অন্যদিকে অনেকে ভয় পাচ্ছেন অতিরিক্ত চাপ দিলে পুরো প্যাকেটই ভেঙে যেতে পারে।
সম্মেলনস্থলের বাইরে অ্যাক্টিভিস্ট, আদিবাসী নেতা ও পরিবেশ–সংগঠনগুলো নতুন খসড়াকে তীব্র সমালোচনা করছে। তাদের যুক্তি, কয়লা, তেল ও গ্যাস থেকে সরে যাওয়ার স্পষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই বনের সুরক্ষা বা অভিযোজন তহবিলের প্রতিশ্রুতি বিশ্বাসযোগ্য হয় না। যারা ইতিমধ্যেই বন্যা, খরা আর অরণ্য–আগুনের সঙ্গে লড়াই করছে, তাদের জন্য এই ভাষা জীবন–মৃত্যুর প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত। শেষ মুহূর্তে যদি কোনোভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি–সংক্রান্ত শক্ত ভাষা ফিরে আসে, তাহলে কোপ৩০–কে আংশিক সাফল্য বলা যাবে; আর যদি না আসে, তাহলে ইতিহাসের কাছে এই সম্মেলনকে ব্যর্থতার নজির হিসেবেই পড়তে হতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















