খাশোগি হত্যাকাণ্ডে যুবরাজ সালমানকে রক্ষার প্রশ্নে ট্রাম্পের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত মানবাধিকার নীতি থেকে বড় ধরনের সরে যাওয়া হিসেবে দেখা হচ্ছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার মূল্যায়নের সঙ্গে তাঁর বক্তব্যের অসঙ্গতি এবং স্বৈরশাসকদের প্রতি দীর্ঘদিনের প্রশংসামূলক মনোভাব এ নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি করেছে। হোয়াইট হাউস অবশ্য দাবি করছে—মানবাধিকার বিষয়ে ট্রাম্পের মতো কেউ ভাবেন না, এবং তাঁর সিদ্ধান্তগুলো ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির প্রতিফলন মাত্র।
ওয়াশিংটনে যখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার অভিযোগ থেকে রক্ষা করলেন, তখন সমালোচকদের ক্ষোভ তীব্রতর হয়। একই সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—মানবাধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের নীতি কীভাবে বদলে যাচ্ছে। ট্রাম্পের মন্তব্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার মূল্যায়নের পুরো বিপরীত ছিল এবং এটি ট্রাম্প প্রশাসনের মানবাধিকার বিষয়ে ঐতিহ্যগত অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার দৃষ্টান্ত হিসেবেও সামনে আসে।

বেশ কিছু মার্কিন প্রশাসন কৌশলগত স্বার্থে মানবাধিকার রেকর্ড দুর্বল দেশগুলো সহযোগিতা করেছে। তবে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আরও স্পষ্ট ও প্রকাশ্য। তিনি সৌদি আরব, হাঙ্গেরি, চীন, এল সালভাদরসহ বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাধর নেতাদের প্রকাশ্যে প্রশংসা করেছেন। তাঁর অবস্থান ছিল এই নেতাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা নয়; বরং প্রতিটি সম্পর্ককে তিনি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক লাভের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেছেন। ওভাল অফিসে তাঁর মন্তব্যেও তা স্পষ্ট—যুবরাজ খাশোগি হত্যায় কোনোভাবেই জড়িত নন বলে তিনি দাবি করেন, যদিও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার মূল্যায়ন এতে ভিন্ন কথা বলে। সাবেক কূটনৈতিক কর্মকর্তা ব্রেট ব্রুয়েনও মনে করেন, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক নীতিগুলো উপেক্ষা করেছেন এবং তাঁর অবস্থান স্বৈরশাসকদের জন্য সবুজ সংকেত হিসেবে কাজ করছে।
সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনে ট্রাম্প কার্যকর ভূমিকা রাখছেন বলেও বিশ্লেষকেরা মনে করেন। যুবরাজের যুক্তরাষ্ট্র সফর, বিনিয়োগ সম্মেলনে বিলিয়ন ডলারের চুক্তি ঘোষণা—এসবই সম্পর্কের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ট্রাম্পপন্থী অন্যান্য নেতাদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের অবস্থান দেখা গেছে। তুরস্কের এরদোয়ান, হাঙ্গেরির ওরবানসহ যেসব নেতার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে, ট্রাম্প তাঁদের অধিকাংশ অভিযোগ উপেক্ষা করেছেন। অন্যদিকে ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ট্রাম্প প্রশাসন তুললেও সমালোচকদের দাবি—এসব অভিযোগ রাজনৈতিক পক্ষপাতের ভিত্তিতে বেছে নেওয়া হয়েছে।
মানবাধিকার নীতিকে ঘিরে ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম দশ মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই নতুন রূপরেখা তৈরি করেছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। অর্থনৈতিক চুক্তি, কৌশলগত লাভ এবং তাঁর রাজনৈতিক ভিত্তির রুচিকে কেন্দ্র করে মানবাধিকার প্রশ্নকে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়েছে। পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার কাঠামোতেও বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রচারে কাজ করা এই দপ্তরকে পুনর্গঠন করে ‘পশ্চিমা মূল্যবোধ’-কেন্দ্রিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। যৌন সহিংসতা, এলজিবিটি-কিউ জনগোষ্ঠীর নির্যাতনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে মনোযোগ কমানো হয়েছে, যদিও প্রশাসন বলছে—এটি অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনুসরণের অংশ।

তবে একই সময়ে ইউরোপের রোমানিয়া, জার্মানি, ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশে দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছে। ব্রাজিলে বলসোনারোর বিচারপ্রক্রিয়া নিয়েও চাপ তৈরি করা হয়েছে, যা প্রশাসনের স্বার্থকেন্দ্রিক মানবাধিকার নীতির অংশ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
বামমুখী সরকারগুলোর ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান আরও কঠোর। এল সালভাদরের মেগা-কারাগারে নির্যাতন, ভেনেজুয়েলা ও কিউবার বিরুদ্ধে কড়া ভাষার বিবৃতি—এসব উদাহরণ দেখায় যে রাজনৈতিক ঝুঁকি বা মানবাধিকার লঙ্ঘনকে সামনে রেখে এই সরকারগুলোকে বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। এর ফলে মানবাধিকার নীতি যুক্তরাষ্ট্রে আর আদর্শিক বিষয় নয়; বরং রাজনৈতিক অগ্রাধিকার, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং বৈদেশিক কৌশলের সঙ্গে সমন্বিত নতুন বাস্তবতা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















