অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি চলমান প্রতারণা, শোষণ ও ঋণদাসত্ব ঠেকাতে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়াকে আরও কঠোর ও স্বচ্ছ ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর (UN Human Rights) এবং তাদের বিশেষজ্ঞরা।
অভিবাসী শ্রমিক সুরক্ষায় কঠোর নজরদারির পরামর্শ
জাতিসংঘ মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা শুক্রবার বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া—উভয় সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষায় আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে। তাদের মতে, শ্রমিকদের যেন অপরাধী হিসেবে বিবেচনা না করা হয় বা নতুনভাবে ভুক্তভোগীতে পরিণত না করা হয়। পাশাপাশি প্রতারণামূলক রিক্রুটিং এজেন্সি ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আইনের আওতায় আনার ওপর জোর দেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের ওপর চলমান শোষণ, প্রতারণা, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি এবং গভীরতর ঋণদাসত্ব নিয়ে নতুন উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
রিক্রুটিং খাতে স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ জোরদারের তাগিদ
বাংলাদেশকে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর ওপর আরও কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন। তারা কেন্দ্রীয় জব পোর্টাল চালুর কথাও উল্লেখ করেন, যা নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করবে এবং শ্রমিকদের কাছ থেকে কোনো ফি নেওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে সহায়তা করবে।
জেনেভা থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন, মালয়েশিয়ায় প্রতারণামূলক নিয়োগ এবং অভিবাসীদের শোষণ এখনো ব্যাপকভাবে চলছে, যা শ্রমিক ও তাদের পরিবারের ওপর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্ম দিচ্ছে।
দুর্নীতি, পাসপোর্ট জব্দ ও প্রতারণার বিস্তারিত অভিযোগ
বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ছিলেন সমসাময়িক দাসত্ববিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক তোমোয়া ওবোকাতা, অভিবাসী অধিকারবিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক জেহাদ মাদি এবং ব্যবসা ও মানবাধিকারবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্যরা।
তাদের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস (BOES)–এর মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হাজারো শ্রমিক বাংলাদেশে আটকে আছে বা মালয়েশিয়ায় গিয়ে শোষণের ঝুঁকিতে পড়ছে। তারা সরকারি ফি-এর পাঁচ গুণেরও বেশি অর্থ পরিশোধ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে—নিয়োগকর্তাদের দ্বারা পাসপোর্ট জব্দ করা, মিথ্যা চাকরির প্রতিশ্রুতি, চুক্তির সঙ্গে চাকরির শর্তের অমিল, শ্রমিকদের ব্যক্তিগত তথ্য অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করা এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর থেকে সহায়তার অভাব।
কিছু শ্রমিককে অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য করা হয়েছে, আবার কারও চাকরির ক্ষেত্র পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে তাদের সম্মতি ছাড়াই। এছাড়া খুব অল্পসংখ্যক রিক্রুটিং এজেন্সির ‘বন্ধ চক্র’ দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও পদ্ধতিগত শোষণের মাধ্যমে টিকে আছে বলেও বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন।
জোরপূর্বক ঘোষণা নেওয়া ও শ্রমিকদের উপর অতিরিক্ত চাপ
বিশেষজ্ঞদের কাছে এমন তথ্যও এসেছে যে শ্রমিকদের জোর করে এমন ঘোষণাপত্রে সই করানো হয়েছে বা ভিডিও রেকর্ড নেওয়া হয়েছে যাতে তারা দাবি করে যে তারা কেবল সরকারি ফি-ই পরিশোধ করেছে।
শ্রমবাজারে মানবাধিকার অনুসারে পরিচালনার আহ্বান
তারা মনে করেন, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া—দুই সরকারেরই দায়িত্ব শ্রমবাজারকে মানবাধিকারসম্মত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলকভাবে পরিচালনা করা। মালয়েশিয়াকে শ্রমিকদের শোষণ, ইচ্ছামতো গ্রেফতার, আটক বা বহিষ্কার থেকে সুরক্ষার জন্য আরও শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
অবৈচ্ছিক প্রত্যাবাসন এবং শ্রমিকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক কোনো পদক্ষেপকে বিশেষজ্ঞরা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সরাসরি লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেন।
তদন্ত, প্রতিকার, ক্ষতিপূরণ ও ঋণমুক্তির নির্দেশনা
উভয় দেশকে দ্রুত ও স্বাধীন তদন্ত পরিচালনা, কার্যকর প্রতিকার প্রদান, ক্ষতিপূরণ ও ঋণমুক্তির ব্যবস্থা করা এবং প্রতারণামূলক নিয়োগচক্র ভেঙে দিতে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার আহ্বান জানান বিশেষজ্ঞরা।
স্বাধীন পর্যবেক্ষণ, শ্রম পরিদর্শন ও পৃথকীকরণ ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ
তারা দুটি সরকারকে নাগরিক সমাজ, শ্রমিক ইউনিয়ন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে স্বাধীন পর্যবেক্ষণ জোরদার করার পরামর্শ দেন।
এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ খাতগুলোতে শ্রম পরিদর্শন বাড়ানো এবং শ্রম অধিকার বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও অভিবাসন কর্তৃপক্ষের মধ্যে কার্যকর পৃথকীকরণ নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে।
বাংলাদেশকে শ্রমিকদের জন্য প্রস্থান-পূর্ব প্রশিক্ষণ এবং কার্যকর অভিযোগ গ্রহণ ব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা, যাতে অভিবাসীরা তাদের অধিকার রক্ষার সুযোগ পায়।
গঠনমূলক আলোচনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ঘোষণা
শেষ পর্যন্ত বিশেষজ্ঞরা জানান, এই বিষয়ে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনা চালিয়ে যেতে তারা প্রস্তুত।
#UNHumanRights #জাতিসংঘমানবাধিকারদপ্তর #বাংলাদেশ #মালয়েশিয়া #অভিবাসীশ্রমিক #মানবাধিকার #শোষণ #প্রতারণা #ঋণদাসত্ব #রিক্রুটিংএজেন্সি #তদন্ত #ক্ষতিপূরণ #অভিবাসন
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















