ভিয়েতনামের অর্থনীতির প্রধান রক্তনালী হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক ঋণ ব্যবস্থাকে ধরা হয়। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভিয়েতনাম রাষ্ট্রীয় ব্যাংক (এসবিভি) বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে ‘ক্রেডিট স্পেস’ বা ঋণসীমা কোটার মাধ্যমে নীতি পরিচালনা করে আসছে। ২০২৫ সালে এসবিভি সার্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করতে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ১৯–২০ শতাংশে উন্নীত করেছে, যা পূর্ব পরিকল্পনার ১৬ শতাংশের তুলনায় বেশি।
এসবিভির এই পদ্ধতি মূলধনের প্রবাহে সরাসরি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেয়, বিশেষ করে এমন সময়ে যখন ব্যাংক খাত এখনও উচ্চ মাত্রার অনুৎপাদনশীল ঋণ এবং দুর্বলতার সঙ্গে লড়ছে। তবে ব্যাসেল II মানদণ্ড পূরণকারী এবং নতুন সার্কুলার ১৪/২০২৫/টিটি-এনএইচএন অনুযায়ী ব্যাসেল III অভিমুখে অগ্রসরমান ব্যাংকের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি কড়াকড়িভাবে নির্ধারিত ক্রেডিট কোটার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
সীমা-নির্ভর নিয়ন্ত্রণ থেকে ঝুঁকিভিত্তিক নজরদারির দিকে
বর্তমান ব্যবস্থায় এসবিভি প্রতি বছর ব্যাংকের সক্ষমতা ও নিয়ম মেনে চলার ভিত্তিতে তাদের ঋণসীমা নির্ধারণ করে। নির্ধারিত সীমায় পৌঁছাতে ব্যাংক আর ঋণ দিতে পারে না, এমনকি বাজারে ঋণের চাহিদা বেশি থাকলেও।
২০২৫ সালে ক্রেডিট স্পেস বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক বড় ব্যাংক বছরের প্রথম ছয় মাসেই ১৮ শতাংশের বেশি ঋণ প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। অন্যদিকে ছোট ব্যাংকগুলো কঠিন সীমার কারণে অনেক যোগ্য গ্রাহক ঋণ দিতে পারছে না।
এই ব্যবস্থার সুবিধা যেমন আছে, তেমনি অসুবিধাও রয়েছে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য এটি ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হলেও, শক্তিশালী ব্যাংকগুলোকে একই সীমার মধ্যে আটকে দেয়। ফলে আর্থিকভাবে সক্ষম প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু ব্যাংকের ঋণসীমা শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে ঋণ পায় না।
এ কারণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন সময় এসেছে ভিয়েতনামকে ধীরে ধীরে ‘হার্ড কোটার’ বদলে ঝুঁকিভিত্তিক নজরদারি ব্যবস্থায় যেতে—যেখানে প্রতিটি ব্যাংকের ঝুঁকি প্রোফাইল এবং ব্যবস্থাপনা সক্ষমতার ভিত্তিতে ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমন্বিত হবে।
ঝুঁকিভিত্তিক নজরদারির চারটি প্রধান সূচক
মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত (CAR): ব্যাসেল III অনুযায়ী ন্যূনতম ৮ শতাংশ। ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বেশি হলে CAR কমে যায় এবং ব্যাংককে স্বাভাবিকভাবেই ঋণ কমাতে হয়।
ঋণ-আমানত অনুপাত (LDR): এটি ৮৫–৯০ শতাংশের বেশি হলে তারল্য সংকটের ঝুঁকি তৈরি হয়।
ঝুঁকি ওজন: রিয়েল এস্টেটে ঋণের ঝুঁকি ওজন ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে, যেখানে সরকারি ঋণের ঝুঁকি ওজন শূন্য শতাংশ—এটি ব্যাংককে নিরাপদ ঋণ পোর্টফোলিও গঠনে বাধ্য করে।
উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ঋণ সীমা: রিয়েল এস্টেট ও কর্পোরেট বন্ডের মতো সংবেদনশীল খাতে সীমাবদ্ধতা বজায় রেখে পুরো ব্যাংকিং সেক্টরে সমানভাবে কোটার প্রয়োগ এড়ানো সম্ভব।
সতর্কতা: কেন এখনই কোটা পুরোপুরি তুলে দেওয়া যাবে না
যদিও অনেকেই মনে করেন ক্রেডিট কোটা বাতিলের সময় এসেছে, তবুও বেশ কিছু যৌক্তিক কারণ রয়েছে সতর্ক থাকার।
ভিয়েতনামের আর্থিক খাত এখনও ব্যাংক ঋণনির্ভর। পুঁজিবাজার পুরোপুরি বিকশিত না হওয়ায় কোটা তুলে দিলে বিপুল পরিমাণ অর্থ রিয়েল এস্টেট বা শেয়ারে ঢুকে অর্থনীতিকে অস্থির করে তুলতে পারে।
অনেক ছোট ব্যাংক এখনও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় দুর্বল এবং অতিরিক্ত প্রবৃদ্ধির পেছনে ছুটছে। কিছু ব্যাংকের অনুৎপাদনশীল ঋণ প্রথম প্রান্তিকে ১৪ শতাংশে পৌঁছেছে।
নিয়ন্ত্রক ডেটা অবকাঠামো এখনও সীমিত। ক্রেডিট ইনফরমেশন সেন্টার (CIC) রিয়েল-টাইম তথ্য সরবরাহ করতে পারে না।
এসব কারণে ক্রেডিট স্পেস এখনো স্বল্পমেয়াদী অর্থনৈতিক ওঠানামা নিয়ন্ত্রণে একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে।
ফিচ রেটিং সতর্ক করেছে, ক্রেডিট নিয়ন্ত্রণ শিথিল হলে অনুৎপাদনশীল ঋণের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে—বিশেষ করে যখন ২০২৫ সালের জিডিপি প্রবৃদ্ধি মাত্র ৫.৬ শতাংশ ধরা হয়েছে।
ঝুঁকি কমাতে ধাপে ধাপে রোডম্যাপ
পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রকদের সম্ভাব্য তিনটি পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
প্রথম ছোট ব্যাংক পরোক্ষ ঋণ দিয়ে অতিরিক্ত প্রবৃদ্ধি অর্জন করলে অনুৎপাদনশীল ঋণ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এসবিভি সাময়িকভাবে তাদের ঋণসীমা সংকুচিত করবে এবং CAR ও LDR প্রতি ত্রৈমাসিকে রিপোর্ট করতে বাধ্য করবে।
দ্বিতীয় উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বুদবুদ সৃষ্টি। রিয়েল এস্টেটে ঋণ ২৫ শতাংশের বেশি বাড়লে ব্যাসেল III অনুযায়ী ১৫০ শতাংশ ঝুঁকি ওজন প্রয়োগ, LDR ৮৫ শতাংশে সীমাবদ্ধ এবং CIC-কে রিয়েল-টাইম নজরদারিতে উন্নীত করা হবে।
তৃতীয় সিস্টেমিক ঝুঁকি। ক্রেডিট-টু-জিডিপি অনুপাত ১৪০ শতাংশ ছাড়ালে মুদ্রানীতির স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এসবিভি বাধ্যতামূলক রিজার্ভ ২–৩ শতাংশ বাড়াতে পারে এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে বন্ড বাজারকে শক্তিশালী করবে।
ধাপে ধাপে পরিবর্তন
২০২৫–২০২৬: ক্রেডিট স্পেস থাকবে, তবে CAR, LDR, NPL ইত্যাদির ভিত্তিতে নমনীয়ভাবে নির্ধারিত হবে। শক্তিশালী ব্যাংক ২০ শতাংশ পর্যন্ত কোটা পাবে, দুর্বল ব্যাংক পাবে কম।
২০২৭–২০২৮: ক্রেডিট কোটা বাতিল করে ঝুঁকিভিত্তিক ‘ডায়নামিক রিস্ক ওয়েট’ ব্যবস্থা কার্যকর হবে। ব্যাসেল III-সম্মত ব্যাংকগুলো নিজস্ব মূলধন সীমার মধ্যে স্বাধীনভাবে ঋণ পরিচালনা করতে পারবে।
২০২৮-এর পর: কোটা পুরোপুরি বিলুপ্ত হবে। ঋণ নিয়ন্ত্রণ হবে নীতি সুদহার, রিজার্ভ, মূলধন পর্যাপ্ততা এবং রিয়েল-টাইম ডেটা নজরদারির মাধ্যমে। এসবিভির ভূমিকা হবে নির্দেশনা ও তদারকি।
ভিয়েতনাম গত এক দশকে উচ্চ অনুৎপাদনশীল ঋণের যুগ থেকে একটি স্থিতিশীল ব্যাংকিং খাতে পৌঁছেছে। তবে অর্থনীতি যত বাড়ছে, ততই ‘কঠোর ব্রেক’ কোটার পরিবর্তে ‘সফট ব্রেক’—অর্থাৎ নিরাপদ ও ঝুঁকিভিত্তিক নজরদারির প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। এ পরিবর্তনই দীর্ঘমেয়াদে ভিয়েতনামের আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে।
#tags #VietnamEconomy #BankingReform
Sarakhon Report 


















