আমেরিকার সঙ্গে বিশ্ব রাজনীতিতে যারা দীর্ঘদিন ধরে মিত্র হিসেবে থেকেছে, তাদের জন্য সময়টা এখন খুবই অস্থির। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় ফিরে এসে দুর্বল সামরিক শক্তি সম্পন্ন দেশগুলোকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করছেন। কিন্তু শুধু দুর্বল মিত্ররাই নয়, বরং যারা আমেরিকার বিশ্বব্যাপী ভূমিকা সমর্থন করতে বছরের পর বছর নিজেকে উপযোগী করে তুলেছে, তাদের জন্য এটি একটি উদ্বেগের সময়।
ডেনমার্ক—একটি ছোট কিন্তু অত্যন্ত বিশ্বস্ত দেশ—দীর্ঘদিন ধরে দুইভাবে আমেরিকার উপকারে এসেছে: সামরিক সহযোগিতা এবং কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এই দুই ভূমিকাই প্রশ্নের মুখে।
ডেনমার্কের দীর্ঘ সামরিক সহযোগিতা
ডেনমার্ক একটি ছোট দেশ হওয়ায় একা নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই তারা বহু বছর ধরে নিজেকে ন্যাটোর অত্যন্ত সক্রিয় সদস্য হিসেবে তুলে ধরেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যখন আমেরিকা বিশ্বব্যাপী শান্তিরক্ষার দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত ছিল, তখন ডেনমার্ক সেই পথে হাঁটে।
১৯৯০-৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের অবরোধে অংশ নেওয়া ছিল এই পরিবর্তনের শুরু। এরপর বালকান যুদ্ধ, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর হামলার পর আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ—সব ক্ষেত্রেই ডেনমার্ক ছিল অন্যতম সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। আফগানিস্তানে জনসংখ্যার অনুপাতে সবচেয়ে বেশি সৈন্য হতাহত হওয়া দেশগুলোর একটি ছিল ডেনমার্ক।
এখনও ইউক্রেন সংকটে মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি সহায়তা দানকারী দেশগুলোর একটি ডেনমার্ক। কিন্তু আমেরিকার ‘বিশ্ব-পুলিশ’ ভূমিকার প্রতি আগ্রহ অনেকটাই কমে গেছে—ওবামা আমল থেকে শুরু হওয়া সেই মনোভাব ট্রাম্পের আমলে আরও তীব্র হয়েছে।

গ্রিনল্যান্ড ও বাল্টিক অঞ্চলে ডেনমার্কের কৌশলগত গুরুত্ব
ডেনমার্কের আরেকটি বড় শক্তি তার ভূগোল। দেশটি বাল্টিক সাগরের প্রবেশপথে অবস্থিত, যা রাশিয়ার নৌবাহিনীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া আছে গ্রিনল্যান্ড—১৮ শতক থেকে ডেনমার্কের অধীনস্থ বিশাল আর্কটিক দ্বীপ।
শীতল যুদ্ধের সময় গ্রিনল্যান্ড ছিল সোভিয়েত সাবমেরিন নজরদারি এবং আমেরিকার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রধান কেন্দ্র। ১৯৫১ সালের চুক্তি অনুযায়ী, আমেরিকা আজও গ্রিনল্যান্ডে সেনা মোতায়েন করতে পারে প্রায় সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে। এই কারণেই বহু বছর ধরে আমেরিকা ডেনমার্কের তুলনামূলক কোমল পররাষ্ট্রনীতিকে সহ্য করেছে।
ট্রাম্পের গ্রিনল্যান্ড-দাবি ও উত্তেজনা
কিন্তু ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ডকে কেন্দ্র করে নতুন সংঘাত সৃষ্টি করেছেন। প্রথমবার ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি গ্রিনল্যান্ড কিনতে চান বলে মন্তব্য করেছিলেন। এখন তিনি আরও জোর দিয়ে বলছেন—আমেরিকার এই দ্বীপটি ‘অবশ্যই প্রয়োজন’, এমনকি শক্তি প্রয়োগের কথাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
তার অভিযোগ—ডেনমার্ক আর্কটিক অঞ্চলে যথেষ্ট বিনিয়োগ করেনি। কিন্তু এ অভিযোগের মধ্যে আমেরিকার দীর্ঘদিনের সামরিক উপস্থিতির বাস্তবতা উপেক্ষিত রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী আমেরিকা চাইলে এখানকার সামরিক ঘাঁটি আরও বিস্তৃত করতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের কিছু সদস্য দাবি করেন—গ্রিনল্যান্ডের ভূসম্পদই আসল লক্ষ্য। অথচ আমেরিকান কোম্পানিগুলো চাইলে যে কোনো সময় বিনিয়োগ করতে পারে—দ্বীপ দখল করা এতে জরুরি নয়।
গ্রিনল্যান্ড বাসীদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত
গ্রিনল্যান্ডের ৫৭ হাজার মানুষের অনেকেই ডেনমার্ক থেকে স্বাধীনতার পক্ষে। অতীতের ঔপনিবেশিক অবিচার তাদের স্মৃতিতে রয়ে গেছে। তবে তারা আমেরিকার অধীন হতে চান না। সাম্প্রতিক নির্বাচনে মানুষ দ্রুত বিচ্ছিন্নতাবাদ কে সমর্থন করেনি। তারা চায়—কৌশলগত অবস্থান কাজে লাগিয়ে আমেরিকার বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে, কিন্তু নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে।
ডেনমার্ক এখন আর “গ্রিনল্যান্ড কার্ড” ব্যবহার করতে পারে না, কারণ গ্রিনল্যান্ড বাসীরা এখন নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চায়।
ভরসার সংকট: ছোট মিত্রদের নতুন ভয়
ডেনমার্ক আমেরিকাকে ছেড়ে যেতে চায় না। তারা নতুন একটি চুক্তির মাধ্যমে আমেরিকার সেনা মোতায়েনের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু আশঙ্কা রয়েছে—বরং আমেরিকাই ডেনমার্ককে ছেড়ে যেতে পারে।

ডেনমার্কের সংসদের পররাষ্ট্র কমিটির প্রধান ক্রিশ্চিয়ান ফ্রিস বাখ বলেন—যখন আমেরিকার ভাইস-প্রেসিডেন্ট কে. ডি. ভ্যান্স দাবি করলেন যে ডেনমার্ক ‘ভালো মিত্র নয়’ এবং গ্রিনল্যান্ডের মালিক হওয়ার যোগ্য নয়, তখন এটি ছিল ‘পেটে ঘুষি মারার মতো আঘাত। আফগানিস্তানে ডেনমার্কের ত্যাগ—ট্রাম্প বা ভ্যান্সের কাছে এগুলোর মূল্য প্রায় শূন্য, কারণ তারা সেই যুদ্ধকে ভুল বলে মনে করেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী অ্যান্ডার্স ফগ রাসমুসেন আশঙ্কা—বিশ্বব্যবস্থা এমন দিকে যাচ্ছে যেখানে বড় শক্তিগুলো ছোট দেশগুলোর মাথার ওপর দিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবে।
ডেনমার্কের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি
ডেনমার্ক এখন বাড়তি নিরাপত্তার জন্য আমেরিকান ও ইউরোপীয় অস্ত্র কিনছে। রাশিয়াকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপযোগ্য দীর্ঘ-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কেনার সিদ্ধান্ত একটি বড় পরিবর্তন। এছাড়া তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় যোগ দিয়েছে—যেটি থেকে তারা এতদিন দূরে ছিল।
রাশিয়াকে প্রতিহত করতে আগামী বহু বছর ডেনমার্ককে আমেরিকার ওপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু এক জিনিস স্পষ্ট—বিশ্বাসের সেই পুরোনো ভিত্তি আর আগের মতো নেই। যেমন ডেনমার্ককে এখন অনিশ্চিত মনে হচ্ছে, তেমনি আমেরিকার পক্ষেও ডেনমার্কের ওপর পূর্ণ ভরসা রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে।
# বিশ্ব রাজনীতি #ডেনমার্ক #আমেরিকা #ট্রাম্প #গ্রিনল্যান্ড #ন্যাটো
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















