০৩:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫

ওপেনএআই-এর উপর চাপ: ভাঙছে আধিপত্যের মুখোশ

২১শ শতাব্দীর প্রযুক্তিখাতে দীর্ঘদিন ধরে ‘উইনার-টেক-অল’ মানসিকতা কাজ করেছে। নব্বই দশকের শেষ দিকে মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ যখন বাজারে একচ্ছত্র আধিকার স্থাপন করে, তখন থেকেই গুগল সার্চ খাতে ও অ্যামাজন ই-কমার্সে নিজের শীর্ষস্থান দখল করে। মেটাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায় বিশ্বজোড়া প্রভাব বিস্তার করেছে—যদিও ১৮ নভেম্বর, ওয়াশিংটন ডিসির একটি আদালত প্রতিষ্ঠানটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মনোপলিস্ট’ ঘোষণা করা থেকে বিরত ছিল।

জেনারেটিভ এআই আসার পর পরিস্থিতি আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে। ২০২২ সালের শেষ দিকে চ্যাটজিপিটি চালু হওয়ার পর থেকে ওপেনএআই-ই ছিল সবার নজরের কেন্দ্রে। কিন্তু সম্প্রতি সেই আধিকার ভাঙতে শুরু করেছে।

ওপেনএআইকে ঘিরে নতুন চাপ
১৮ নভেম্বর মাইক্রোসফট ও এনভিডিয়া—ওপেনএআই-এর দুই প্রধান সমর্থক—একই দিনে ওপেনএআই-এর বড় প্রতিদ্বন্দ্বী আনথ্রপিকের পক্ষে অবস্থান নেয়। এতদিন আনথ্রপিককে অর্থায়ন করছিল অ্যামাজন ও গুগল। একই দিনে গুগলও তাদের নতুন এআই মডেল উন্মোচন করে ওপেনএআইকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানায়।

আর্থিক দিক থেকে পরিবর্তনের ইঙ্গিত
আনথ্রপিক নিয়ে ঘোষিত নতুন চুক্তি এআই খাতের অতিরিক্ত ব্যয়-নির্ভর উচ্ছ্বাস আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। মাইক্রোসফট ও এনভিডিয়া ঘোষণা করেছে তারা ১৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে, আর আনথ্রপিক সেই অর্থ ব্যবহার করে মাইক্রোসফটের অ্যাজিউর ক্লাউডে ৩০ বিলিয়ন ডলারের সামগ্রিক ব্যয় পরিকল্পনা করবে, যেখানে ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে এনভিডিয়ার এআই চিপ। কিছুদিন আগেও এ ধরনের পারস্পরিক নির্ভরশীল চক্রকে বাজার ইতিবাচকভাবে দেখতো। কিন্তু এখন বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত। ঘোষণার পরই মাইক্রোসফটের শেয়ারদর ৩ শতাংশ কমে যায়।

ওপেনএআই-এর বৃহদাকার ব্যয় পরিকল্পনাও বিনিয়োগকারীদের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেপ্টেম্বরে ওপেনএআই ঘোষণা করে তারা ওরাকল থেকে পাঁচ বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের কম্পিউটিং ক্ষমতা কিনবে। এর পরপরই এনভিডিয়া জানায় তারা ওপেনএআই-এ ১০০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করবে।
এগুলো মিলিয়ে ওপেনএআই-এর মোট ব্যয় অঙ্গীকার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলারে—যা বাজারে উদ্বেগ তৈরি করেছে যে, ঋণঝুঁকি থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো এআই ডেটা সেন্টার নির্মাণে অতিরিক্ত ঝুঁকি নিচ্ছে।

এনভিডিয়ার শক্তিশালী বাজার অবস্থান
১৯ নভেম্বর এনভিডিয়া তাদের তৃতীয় প্রান্তিকের রেকর্ড বিক্রি ঘোষণা করে এবং চতুর্থ প্রান্তিকের আয় প্রত্যাশাও বাড়িয়ে দেয়। তাদের সিইও জেনসন হুয়াং বলেন, “এআই বাবল নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে, কিন্তু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা একেবারেই ভিন্ন কিছু দেখছি।”
আনথ্রপিকের নতুন চুক্তিতে এনভিডিয়ার এ আত্মবিশ্বাসই প্রতিফলিত। প্রথমবারের মতো আনথ্রপিক তাদের মডেল প্রশিক্ষণে এনভিডিয়ার চিপ ব্যবহার করবে। চুক্তির আর্থিক শর্ত খুব পরিষ্কার না হলেও সিএনবিসি জানায়, আনথ্রপিকের মূল্যায়ন এখন প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলার—সেপ্টেম্বরে যা ছিল ১৮৩ বিলিয়ন। ফলে প্রতিষ্ঠানটি ওপেনএআই-এর আরও কাছাকাছি চলে এসেছে, যার মূল্যায়ন প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার। এদিকে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায়, ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান XAI ১৫ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহের আলোচনায় আছে, যা তাদের মূল্যায়নকে ২৩০ বিলিয়ন ডলারে নিতে পারে।

গুগলের পাল্টা পদক্ষেপ
১৮ নভেম্বর গুগল তাদের নতুন এআই মডেল জেমিনি ৩ প্রকাশ করে। প্রতিষ্ঠানটি দাবি করে, এটি গুগল সার্চ, কোডিং এবং বিভিন্ন ডিজিটাল টুলে আরও উন্নত এআই সুবিধা দেবে। বর্তমানে জেমিনির মাসিক সক্রিয় ব্যবহারকারী ৬৫০ মিলিয়ন—যদিও ওপেনএআই বলছে চ্যাটজিপিটির সাপ্তাহিক ব্যবহারকারী সংখ্যা ৮০০ মিলিয়ন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—জেমিনি প্রশিক্ষিত হয়েছে গুগলের নিজস্ব চিপ ব্যবহার করে, যা এনভিডিয়া-ভিত্তিক মডেলের তুলনায় খরচ কমাতে পারে। এই ঘোষণার পর ১৯ নভেম্বর অ্যালফাবেটের শেয়ারদর রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে।

প্রতিযোগিতা বাড়ার সম্ভাব্য প্রভাব
ব্যবহারকারীদের জন্য প্রতিযোগিতা বাড়া ভালো—কারণ এতে দাম কমে এবং নতুন সেবা দ্রুত উন্নত হয়। তবে একই সঙ্গে এআই বাজারে ফাটকা বিনিয়োগের আশঙ্কাও বাড়ছে। প্রতিযোগিতা তীব্র হলে ব্যয়বহুল ডেটা সেন্টার নির্মাণ ও বিশাল মূল্যায়ন ধরে রাখা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
এআই খাত যতই বিস্তৃত হোক, সকল ল্যাবের জন্য দীর্ঘমেয়াদে রাজস্ব নিশ্চিত করা এখনই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

#ওপেনএআই_সংকট #এআই_প্রতিযোগিতা #প্রযুক্তি_বাজার #সারাক্ষণ_রিপোর্ট

জনপ্রিয় সংবাদ

পুনর্বাসনের রাজা রিচার্ড টেইটের নতুন মিশন

ওপেনএআই-এর উপর চাপ: ভাঙছে আধিপত্যের মুখোশ

০১:৪৭:৪৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫

২১শ শতাব্দীর প্রযুক্তিখাতে দীর্ঘদিন ধরে ‘উইনার-টেক-অল’ মানসিকতা কাজ করেছে। নব্বই দশকের শেষ দিকে মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ যখন বাজারে একচ্ছত্র আধিকার স্থাপন করে, তখন থেকেই গুগল সার্চ খাতে ও অ্যামাজন ই-কমার্সে নিজের শীর্ষস্থান দখল করে। মেটাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায় বিশ্বজোড়া প্রভাব বিস্তার করেছে—যদিও ১৮ নভেম্বর, ওয়াশিংটন ডিসির একটি আদালত প্রতিষ্ঠানটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মনোপলিস্ট’ ঘোষণা করা থেকে বিরত ছিল।

জেনারেটিভ এআই আসার পর পরিস্থিতি আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে। ২০২২ সালের শেষ দিকে চ্যাটজিপিটি চালু হওয়ার পর থেকে ওপেনএআই-ই ছিল সবার নজরের কেন্দ্রে। কিন্তু সম্প্রতি সেই আধিকার ভাঙতে শুরু করেছে।

ওপেনএআইকে ঘিরে নতুন চাপ
১৮ নভেম্বর মাইক্রোসফট ও এনভিডিয়া—ওপেনএআই-এর দুই প্রধান সমর্থক—একই দিনে ওপেনএআই-এর বড় প্রতিদ্বন্দ্বী আনথ্রপিকের পক্ষে অবস্থান নেয়। এতদিন আনথ্রপিককে অর্থায়ন করছিল অ্যামাজন ও গুগল। একই দিনে গুগলও তাদের নতুন এআই মডেল উন্মোচন করে ওপেনএআইকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানায়।

আর্থিক দিক থেকে পরিবর্তনের ইঙ্গিত
আনথ্রপিক নিয়ে ঘোষিত নতুন চুক্তি এআই খাতের অতিরিক্ত ব্যয়-নির্ভর উচ্ছ্বাস আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। মাইক্রোসফট ও এনভিডিয়া ঘোষণা করেছে তারা ১৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে, আর আনথ্রপিক সেই অর্থ ব্যবহার করে মাইক্রোসফটের অ্যাজিউর ক্লাউডে ৩০ বিলিয়ন ডলারের সামগ্রিক ব্যয় পরিকল্পনা করবে, যেখানে ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে এনভিডিয়ার এআই চিপ। কিছুদিন আগেও এ ধরনের পারস্পরিক নির্ভরশীল চক্রকে বাজার ইতিবাচকভাবে দেখতো। কিন্তু এখন বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত। ঘোষণার পরই মাইক্রোসফটের শেয়ারদর ৩ শতাংশ কমে যায়।

ওপেনএআই-এর বৃহদাকার ব্যয় পরিকল্পনাও বিনিয়োগকারীদের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেপ্টেম্বরে ওপেনএআই ঘোষণা করে তারা ওরাকল থেকে পাঁচ বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের কম্পিউটিং ক্ষমতা কিনবে। এর পরপরই এনভিডিয়া জানায় তারা ওপেনএআই-এ ১০০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করবে।
এগুলো মিলিয়ে ওপেনএআই-এর মোট ব্যয় অঙ্গীকার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলারে—যা বাজারে উদ্বেগ তৈরি করেছে যে, ঋণঝুঁকি থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো এআই ডেটা সেন্টার নির্মাণে অতিরিক্ত ঝুঁকি নিচ্ছে।

এনভিডিয়ার শক্তিশালী বাজার অবস্থান
১৯ নভেম্বর এনভিডিয়া তাদের তৃতীয় প্রান্তিকের রেকর্ড বিক্রি ঘোষণা করে এবং চতুর্থ প্রান্তিকের আয় প্রত্যাশাও বাড়িয়ে দেয়। তাদের সিইও জেনসন হুয়াং বলেন, “এআই বাবল নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে, কিন্তু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা একেবারেই ভিন্ন কিছু দেখছি।”
আনথ্রপিকের নতুন চুক্তিতে এনভিডিয়ার এ আত্মবিশ্বাসই প্রতিফলিত। প্রথমবারের মতো আনথ্রপিক তাদের মডেল প্রশিক্ষণে এনভিডিয়ার চিপ ব্যবহার করবে। চুক্তির আর্থিক শর্ত খুব পরিষ্কার না হলেও সিএনবিসি জানায়, আনথ্রপিকের মূল্যায়ন এখন প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন ডলার—সেপ্টেম্বরে যা ছিল ১৮৩ বিলিয়ন। ফলে প্রতিষ্ঠানটি ওপেনএআই-এর আরও কাছাকাছি চলে এসেছে, যার মূল্যায়ন প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার। এদিকে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায়, ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান XAI ১৫ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহের আলোচনায় আছে, যা তাদের মূল্যায়নকে ২৩০ বিলিয়ন ডলারে নিতে পারে।

গুগলের পাল্টা পদক্ষেপ
১৮ নভেম্বর গুগল তাদের নতুন এআই মডেল জেমিনি ৩ প্রকাশ করে। প্রতিষ্ঠানটি দাবি করে, এটি গুগল সার্চ, কোডিং এবং বিভিন্ন ডিজিটাল টুলে আরও উন্নত এআই সুবিধা দেবে। বর্তমানে জেমিনির মাসিক সক্রিয় ব্যবহারকারী ৬৫০ মিলিয়ন—যদিও ওপেনএআই বলছে চ্যাটজিপিটির সাপ্তাহিক ব্যবহারকারী সংখ্যা ৮০০ মিলিয়ন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—জেমিনি প্রশিক্ষিত হয়েছে গুগলের নিজস্ব চিপ ব্যবহার করে, যা এনভিডিয়া-ভিত্তিক মডেলের তুলনায় খরচ কমাতে পারে। এই ঘোষণার পর ১৯ নভেম্বর অ্যালফাবেটের শেয়ারদর রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে।

প্রতিযোগিতা বাড়ার সম্ভাব্য প্রভাব
ব্যবহারকারীদের জন্য প্রতিযোগিতা বাড়া ভালো—কারণ এতে দাম কমে এবং নতুন সেবা দ্রুত উন্নত হয়। তবে একই সঙ্গে এআই বাজারে ফাটকা বিনিয়োগের আশঙ্কাও বাড়ছে। প্রতিযোগিতা তীব্র হলে ব্যয়বহুল ডেটা সেন্টার নির্মাণ ও বিশাল মূল্যায়ন ধরে রাখা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
এআই খাত যতই বিস্তৃত হোক, সকল ল্যাবের জন্য দীর্ঘমেয়াদে রাজস্ব নিশ্চিত করা এখনই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

#ওপেনএআই_সংকট #এআই_প্রতিযোগিতা #প্রযুক্তি_বাজার #সারাক্ষণ_রিপোর্ট