মৌসুমি বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত মধ্য ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ থাইল্যান্ড
একটানা ভারি বৃষ্টিতে ভিয়েতনামের মধ্যাঞ্চল ও থাইল্যান্ডের দক্ষিণ প্রদেশগুলো ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধসের মুখে পড়েছে। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় কোয়াং ত্রি থেকে লাম দং পর্যন্ত দীর্ঘ উপকূল ও পাহাড়ি এলাকায় নদ–নদীর পানি হঠাৎ বেড়ে ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। দাক লাক প্রদেশে রাতের অন্ধকারে দ্রুত পানি বাড়তে থাকায় অনেক মানুষের পক্ষে ঘর ছাড়ার সময়ও মেলেনি; অধিকাংশ মৃত্যু ঘটেছে ডুবে যাওয়ার কারণে। এখনো বহু মানুষ নিখোঁজ, পরিবারগুলো আশ্রয় নিয়েছে স্কুল, মন্দির আর উঁচু সরকারি ভবনে।
ভিয়েতনামে মৃতের সংখ্যা নব্বইয়ের ঘর ছুঁয়েছে, পাশাপাশি থাইল্যান্ডের দক্ষিণাংশেও প্রাণহানির খবর আসছে। সঙখলা প্রদেশে সড়ক এমনভাবে ডুবে গেছে যে ফায়ার ট্রাক ও ছোট গাড়িও প্রায় পুরোটা পানির নিচে চলে গেছে; স্বাভাবিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা এত পরিমাণ পানি সামাল দিতে পারেনি। উদ্ধারকর্মীরা নৌকায় করে আটকে পড়া মানুষদের সরিয়ে নিচ্ছেন, অন্যদিকে প্রকৌশলীরা বিদ্যুৎ ও রাস্তা মেরামতের জন্য যুদ্ধ করছে। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, উজানে পানি নামতে শুরু করলেও কিছু এলাকায় আরেক দফা ভারি বৃষ্টি পরিস্থিতি খারাপ করে দিতে পারে।
এই বিপর্যয়ের পূর্ণ আর্থিক ক্ষতি হিসাব করা এখনো বাকি, তবে প্রাথমিক তথ্য বলছে লাখ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি ও ফসলক্ষেত কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভিয়েতনামের সেন্ট্রাল হাইল্যান্ডসে কফি ও গোলমরিচের চাষ বিশেষভাবে আক্রান্ত, যা স্থানীয় জীবিকা ও রপ্তানি আয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। থাইল্যান্ডে সড়কপথের ওপর নির্ভরশীল ছোট দোকান, পর্যটননির্ভর ব্যবসা ও পরিবহন খাতে লম্বা বিরতির প্রভাব পড়ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, ঠাসাঠাসি আশ্রয়কেন্দ্রে বিশুদ্ধ পানির ঘাটতি হলে ডায়রিয়া ও অন্যান্য পানিবাহিত রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মৌসুমি বৃষ্টির ধরন দ্রুত বদলে যাচ্ছে। একই মৌসুমে কোথাও দীর্ঘ খরা, কোথাও হঠাৎ কিছু দিনের ভয়াবহ বৃষ্টি—দুই চরম অবস্থার মধ্যে দোল খাচ্ছে আবহাওয়া। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে পাহাড় কেটে বসতি বা কফি বাগান গড়ে তোলা, বনভূমি উজাড় করা, নালাজন নদী ভরাটের মতো মানবসৃষ্ট কারণ। ফলে পাহাড়ি অঞ্চল ও নদীভাঙনপ্রবণ এলাকায় বন্যা ও ভূমিধসের ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে, অথচ অনেক গ্রামে এখনো কার্যকর আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থা বা নির্ধারিত সুরক্ষিত আশ্রয়কেন্দ্র নেই।
এমন বাস্তবতায় ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড সরকার জরুরি ত্রাণ, পুনর্বাসন ও অবকাঠামো মেরামতের ঘোষণা দিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মত, শুধুই পুরোনোভাবে পুনর্গঠন করলে একই দুর্বলতা আবারও সামনে আসবে—নদীর ধারেই দুর্বল বাঁধ, পাহাড়ের ঢালে কাঁচা ঘর, ড্রেনেজহীন নতুন সড়ক। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও স্থানীয় কর্মীরা তাই দুর্যোগ-সহনশীল ঘরবাড়ি, আধুনিক ড্রেনেজ, পুনঃবনায়ন, গ্রাম পর্যায়ে মহড়া ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিচ্ছেন। আপাতত মানুষের চাওয়া খুব সাধারণ—একটু শুকনো জায়গা, পরিষ্কার পানি আর কিছু খাবার। কিন্তু পানি নেমে গেলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হবে আরেক প্রশ্ন—এই ট্র্যাজেডি কি সত্যিই জলবায়ু অভিযোজনকে দ্রুত করবে, নাকি আবারও কাগজে-কলমে আটকে থাকবে পরিকল্পনা?
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















