যুক্তরাষ্ট্রে খ্রিস্টধর্মের তিনটি প্রধান শাখার মধ্যে অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্ম সবচেয়ে ছোট এবং তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত। বহুদিন ধরে স্থির ও অপরিবর্তিত এই ধর্মীয় ঐতিহ্য সম্প্রতি নতুন এক পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়েছে। বিশেষত তরুণ ও রক্ষণশীল পুরুষদের বড় একটি অংশ আকৃষ্ট হচ্ছে এই প্রাচীন বিশ্বাস ও তার কঠোর অনুশীলনের দিকে। চার্চগুলোর পুরোহিতরা জানাচ্ছেন উপস্থিতি বেড়ে যাচ্ছে, নতুন আগন্তুকরা ভিড় করছেন বিভিন্ন প্যারিশে। পুরনো সদস্যরা এই পরিবর্তনে কখনো অবাক, কখনো আনন্দিত, কখনো বিভ্রান্ত। প্যারিশগুলোকে এখন রূপান্তরিত হতে আগ্রহী মানুষের ভিড় সামলাতে বিশেষ পরিকল্পনা করতে হচ্ছে।
তরুণদের আগ্রহে হঠাৎ উত্থান
দেশজুড়ে পুরোহিতরা বলছেন, বহু প্যারিশে এমন সমাবেশ চোখে পড়ছে যা আগে দেখা যায়নি। নতুন আগন্তুকদের বড় অংশ তরুণ পুরুষ, যারা কঠোর শৃঙ্খলা ও গভীর ধর্মীয় অনুশীলনের প্রতি আকৃষ্ট। তাদের মতে, আধুনিক খ্রিস্টধর্মের অনেক ধারা আবেগঘন ও সহজতর হয়ে উঠলেও অর্থোডক্সি বরং কঠিন এবং চ্যালেঞ্জপূর্ণ—এবং এই কঠোরতাই তাদের কাছে আকর্ষণীয়। অ্যান্তিয়োকিয়ান অর্থোডক্স পুরোহিত অ্যান্ড্রু ড্যামিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে অর্থোডক্স চার্চের ইতিহাসে কখনো এত সংখ্যক তরুণ একসঙ্গে চার্চে যোগ দিতে দেখা যায়নি। তার ভাষায়, “এটা সবার জন্যই নতুন অভিজ্ঞতা।”
যুক্তরাষ্ট্রে অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের সংখ্যা খুবই কম—মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ, যেখানে ৪০ শতাংশ প্রোটেস্টান্ট এবং ২০ শতাংশ ক্যাথলিক। দীর্ঘদিন ধরে এখানে ইউক্রেন, গ্রিসসহ পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসীদের মাধ্যমে অর্থোডক্স চার্চ টিকে ছিল। তাদের সন্তানরা প্রজন্ম ধরে অন্য চার্চে চলে যেতেন। কিন্তু এখন দেশে জন্ম নেওয়া নতুন এক অর্থোডক্স প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। অনেক তরুণ প্রথম অর্থোডক্স ধর্ম সম্পর্কে জানতে পারছে ইউটিউব ও সোশ্যাল মিডিয়ার কঠোর রক্ষণশীল প্রভাবশালীদের কাছ থেকে। কিছু সমালোচক তাদের ‘অর্থোব্রো’ বলে আখ্যা দেন।
নতুন তরুণদের অভিজ্ঞতা ও মনোভাব
গত গ্রীষ্মে নর্থ ক্যারোলিনার অ্যাল সেন্টস অর্থোডক্স চার্চের তরুণরা শহরের এক বুকশপ ও বারে সমাবেশ করেন। সেখানে নারীদের সংখ্যা ছিল খুবই কম, আর পুরুষ ছিলেন ৪০ জনের বেশি। সবাই তা লক্ষ্য করেন এবং এর কারণ তাদের কাছে স্পষ্ট ছিল। নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র জশ এলকিন্স বলেন, অর্থোডক্সি “পুরুষের আত্মাকে আকর্ষণ করে।” তার মতে, এই চার্চই একমাত্র চার্চ যেখানে পুরুষদের কঠোরভাবে শাসন ও দিকনির্দেশনা দেওয়া হয় এবং বলা হয় কী করতে হবে। মাত্র ২০ বছর বয়সী এলকিন্স দ্বিতীয় শতকের এক শহীদের উদ্ধৃতি দিতে পারেন অনায়াসে, আবার ধর্মতাত্ত্বিক পরিভাষাও সাবলীলভাবে ব্যবহার করেন।
কঠোর রীতিনীতি ও শৃঙ্খলার প্রতি আকর্ষণ
অর্থোডক্স উপাসনার ধরন বেশিরভাগ আমেরিকান, এমনকি অনেক খ্রিস্টানের কাছেও অপরিচিত। এখানে ধুপ, স্তোত্রগান, আইকনের সামনে গভীর প্রণিপাত, এবং উপাসনার অনেক অংশ কেবল পুরোহিতদের দৃষ্টিতে সম্পন্ন হয়। এই চার্চে কঠোর উপবাস ও ত্যাগের নিয়মও রয়েছে। ২৯ বছরের ম্যাথিউ হারম্যান হাডসন বলেন, শুরুতে তিনি ভাবেননি যে এটি এত কঠিন হবে। কিন্তু তার ভাষায়, “এটা আমাকে এমনভাবে ছুঁয়েছে যা আর কিছু করতে পারেনি।” তিনি জানান, আগে তাকে বন্ধুবান্ধবকে অর্থোডক্স ধর্ম কি তা বুঝিয়ে বলতে হতো, এখন দোকানে অনেকেই তার গলায় থাকা ক্রস দেখে চিনে ফেলেন।
জেনারেশন জেড ধর্মীয় পতনের ধারা পাল্টে দিচ্ছে
দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় আনুগত্য কমছিল। প্রতিটি প্রজন্ম আগের চেয়ে কম ধর্মীয় হচ্ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক জরিপ বলছে—তরুণ পুরুষরা সেই ধারাকে উল্টে দিচ্ছে। অর্থোডক্স চার্চ দাবি করে, তাদের ধর্মযাজকদের শৃঙ্খলা যিশু খ্রিস্ট ও প্রাথমিক প্রেরিতদের সময় পর্যন্ত পৌঁছে। প্রথম সহস্রাব্দে পূর্ব ও পশ্চিম খ্রিস্টধর্মের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয় এবং একাদশ শতকে বিভাজন চূড়ান্ত হয়। এরপর পূর্ব অর্থোডক্স চার্চ মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ায় বিস্তার লাভ করে।
পিউ রিসার্চ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের ৬০ শতাংশই পুরুষ—যেখানে ইভানজেলিকাল ক্রিস্টানদের মধ্যে পুরুষ ৪৬ শতাংশ। আবার অর্থোডক্সদের মধ্যে ২৪ শতাংশের বয়স ৩০ বছরের নিচে—যা অন্য শাখাগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। অনেক রূপান্তরিত ব্যক্তি বলেন, অর্থোডক্স চার্চ অন্য খ্রিস্টান ধারার তুলনায় অনেক বেশি ‘পুরুষালী’। পুরোহিতরা পুরুষ, তারা বিবাহিত হতে পারেন, তাদের বড় পরিবার থাকে, বড় দাড়ি থাকে। অর্থোডক্সি উপবাস ও ত্যাগের চর্চা দিয়ে ধর্মীয় জীবনকে কঠিন করে তোলে, যেখানে অনেক ইভানজেলিকাল চার্চ আধুনিক সঙ্গীত ও অনুপ্রেরণাধর্মী বক্তব্যের মাধ্যমে আবেগঘন অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দেয়।
নতুন ধারার ‘তীব্র’ খ্রিস্টধর্ম
অর্থোডক্স চার্চের উত্থানের সঙ্গে মিল রেখে আরও কিছু খ্রিস্টান গোষ্ঠীর মধ্যেও তরুণদের আকর্ষণ বাড়ছে। ক্যাথলিক চার্চে অনেক তরুণ প্রাচীন ল্যাটিন মাস পছন্দ করছেন, যেখানে নারীরা মাথায় ঘোমটা দেন। এই গোষ্ঠীগুলো ছোট হলেও পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। পিউ রিসার্চ জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে খ্রিস্টধর্মের পতন থেমে গেছে এবং তরুণদের অংশগ্রহণেই তা সম্ভব হয়েছে।
কেউ কেউ মনে করেন, তরুণরা যেসব চার্চে যোগ দিচ্ছে তার সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো—তারা অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলোর প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়। ফাদার ড্যামিক বলেন, যেমন ক্যারিসম্যাটিক খ্রিস্টধর্ম যেখানে বিশ্বাসে চিকিৎসা, আত্মিক যুদ্ধ প্রভৃতি ধারণা রয়েছে, সেখানেও তরুণদের উপস্থিতি স্থিতিশীল।
ফাদার উইনের পরিবার ও চার্চের সম্প্রসারণ
অ্যাল সেন্টস চার্চের পুরোহিত ফাদার ডেভিড উইন বলেন, “অর্থোডক্স চার্চ স্বাভাবিক, সুস্থ, সত্য ও সুন্দর হতে চাওয়া মানুষের আশ্রয়।” ৩৮ বছর বয়সী উইন ২০১০-এর দশকে রূপান্তরিত হন। চার্চে আগ্রহী মানুষের সঙ্গে গভীরভাবে সময় কাটান তিনি। তার স্ত্রী ডেস্টিনি ইনস্টাগ্রামে জনপ্রিয় অর্থোডক্স প্যারেন্টিং অ্যাকাউন্ট চালান। ঘরে তারা চার সন্তানকে হোমস্কুলিং করান এবং শিগগিরই পঞ্চম সন্তানের অপেক্ষায় আছেন। বাড়ির বড় বারান্দায় চার্চের লোকজন প্রায়ই জড়ো হন।
২০২০ সালে উইন অ্যাল সেন্টসে যোগ দেন—যে বছরটিকে অনেকে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্ম বৃদ্ধির মোড় বলে মনে করেন। মহামারির সময় অধিকাংশ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও অর্থোডক্স চার্চগুলো বেশি পরিমাণে সরাসরি উপাসনা চালিয়ে যায়। ফলে অনেকেই এই চার্চে নতুনভাবে যুক্ত হন। ২০২৩ সালের মধ্যে অর্থোডক্স চার্চে উপস্থিতি পুরোপুরি ফিরে আসে, যেখানে অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতি তখনো কম ছিল। এখন কিছু অর্থোডক্স চার্চ নিজস্ব স্কুলও তৈরি করছে। হিউস্টনের সেন্ট কনস্টান্টাইন স্কুলের ছাত্র সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়েছে, এবং পিটসবার্গ ও ডালাসে নতুন ক্যাম্পাস খুলছে।
অনলাইন প্রভাব, রাজনীতি ও বিতর্ক
অনলাইন প্রভাবশালী যাদের মাধ্যমে অনেক তরুণ অর্থোডক্স ধর্মের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, তারা রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে খুব সরাসরি কথা বলেন। তাদের অবস্থান সাধারণত কঠোর রক্ষণশীল। তারা ঐতিহ্যবাহী পরিবারব্যবস্থার ওপর জোর দেন এবং মনে করেন নারীবাদ, সমকামিতা ও ট্রান্স পরিচয় সমাজের ক্ষতি করছে। তাদের একটি বড় অংশ ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরোধী। ইন্টারনেটের কিছু অংশে এমনকি খোলাখুলি বর্ণবাদ, ইহুদিবিদ্বেষ এবং শ্বেত আধিপত্যবাদী বক্তব্যও ছড়ায়। দক্ষিণাঞ্চলে এমন ‘নিও–কনফেডারেট অর্থোডক্সি’ দেখা যায়, যেখানে পুরনো শ্বেত আধিপত্যবাদী ভাবধারার সঙ্গে অর্থোডক্স ধর্মকে মেলানো হয়। কুখ্যাত “ইউনাইট দ্য রাইট” সমাবেশের আয়োজক ম্যাথিউ হেইমবাখ একসময় অর্থোডক্স চার্চ থেকে বহিষ্কৃত হলেও পরে অন্য শাখায় যোগ দেন।
অর্থোডক্স লেখক রড ড্রেহার সতর্ক করেছেন যে, জুমার প্রজন্মের কিছু ধর্মীয় রক্ষণশীলদের মাঝে ইহুদিবিদ্বেষ “ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে”। অনেক প্যারিশ পুরোহিত বলেন, তাদের দায়িত্ব হলো অনলাইনের উগ্র ‘অর্থোব্রো’ চিন্তাধারাকে বাস্তব চার্চ জীবনের মাধ্যমে বদলে দেওয়া, কারণ বাস্তব জীবন ইন্টারনেটের সহিংস কথাবার্তা থেকে অনেক দূরে। কিন্তু সমালোচকদের মতে, চার্চের শীর্ষ নেতারা অনেক সময় এসব বিপজ্জনক বক্তব্যের বিরুদ্ধে যথেষ্ট অবস্থান নেন না।
সমালোচনার জায়গা
নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির গবেষক সারাহ রিকার্ডি সোয়ার্টজ বলেন, “আপনি প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিকোণ থেকে হয়তো এই বৃদ্ধিতে খুশি হতে পারেন। কিন্তু যখন সেই বৃদ্ধির সঙ্গে সহিংস রাজনৈতিক প্রবণতা যুক্ত হয়, তখন তা বিপজ্জনক এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।”
যদিও অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্ম যুক্তরাষ্ট্রে এখনো ছোট একটি সম্প্রদায়, তবুও তরুণ পুরুষদের আগমনে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। কঠোর অনুশাসন, ঐতিহাসিক গভীরতা এবং আধ্যাত্মিক চ্যালেঞ্জ অনেককে টানছে এই পথে। তবে এর উত্থানের সঙ্গে উগ্র রাজনৈতিক মতাদর্শের সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগও বাড়ছে। এই নতুন ঢেউ চার্চকে যেমন নতুন শক্তি দিচ্ছে, তেমনি নতুন প্রশ্ন তুলছে—বিশ্বাসের এই পুনর্জাগরণ শেষে কোন পথে যাবে।
# যুক্তরাষ্ট্র #ধর্মীয়প্রবণতা #অর্থোডক্স_খ্রিস্টধর্ম #তরুণ_পুরুষ #জেনারেশন_জেড #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















