চীনের বিলাসবহুল বাজারে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। যে বাজার দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের দখলে ছিল, সেখানে এখন দ্রুত উত্থান ঘটছে স্থানীয় বিলাসবহুল পণ্যের। অর্থনৈতিক মন্দা, বিদেশি ব্র্যান্ডের বিক্রি কমে যাওয়া এবং জাতীয় গর্বের উত্থান—সব মিলিয়ে চীনা ক্রেতাদের পছন্দ বদলে গেছে। এই পরিবর্তন এতটাই স্পষ্ট যে বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোকেও তাদের কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে হচ্ছে।
বার্নার্ড আর্নোর সাংহাই ভ্রমণের প্রতীকী বার্তা
এলভিএমএইচ চেয়ারম্যান বার্নার্ড আর্নো যখন ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে সাংহাই সফরে যান, অনেকেই ভেবেছিলেন তিনি লুই ভুইতঁ বা ডিওরের মতো ব্র্যান্ডের দোকানই ঘুরে দেখবেন। কিন্তু তিনি এর বদলে নতুন ট্রেন্ডের সাথে তাল মিলিয়ে স্থানীয় ব্র্যান্ড ঘুরে দেখেন। সাংহাইয়ের আধুনিক বিলাসবহুল শপিং সেন্টার কিয়ানতান তাইকু লি-তে তিনি যান সঙমন্ট নামের চীনা মিনিমালিস্ট চামড়াজাত দ্রব্যের দোকানে এবং সেখান থেকে দুটি ব্যাগ কেনেন। এরপর তিনি লাওপু গোল্ড নামে একটি স্থানীয় স্বর্ণালংকার ব্র্যান্ডের দোকানেও প্রবেশ করেন, যেখানে তিনি প্রায় আধঘণ্টা ধরে বিভিন্ন পণ্য দেখেন এবং “exquisite”, “interesting” এর মতো প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেন। আর্নোর এই পদক্ষেপ স্পষ্ট করে যে চীনা ব্র্যান্ড এখন আর শুধু বিকল্প নয়, বরং দেশের বিলাসবহুল বাজারের ভবিষ্যৎ অধ্যায়ের অংশ।
চীনের বিলাসবহুল বাজারে দ্রুত পরিবর্তন
চীনের ৪৯ বিলিয়ন ডলারের বিলাসবহুল বাজারে বিদেশি ব্র্যান্ডের বিক্রি কমে এসেছে। কোভিড-পরবর্তী সময়ে যে চাহিদা ফেরার কথা ছিল তার বদলে বাজার শ্লথ হয়ে গেছে। ফলে লুই ভুইতঁ, কেরিং, বুরবেরি, এস্টি লডারের মতো ব্র্যান্ডগুলো গত দুই বছরে বড় আকারে বিক্রি হারিয়েছে। বিশেষ করে অনলাইন বিক্রিতে বিপুল পতন দেখা গেছে। এর বিপরীতে চীনা ব্র্যান্ডগুলো অনলাইনে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে। BigOne Lab-এর তথ্য অনুযায়ী পাঁচটি চীনা বিলাসবহুল ব্র্যান্ড গত দুই বছরে সাতটি বিদেশি প্রতিদ্বন্দ্বী ব্র্যান্ডকে পিছনে ফেলেছে। লাওপু গোল্ডের অনলাইন বিক্রি দুই বছরের তুলনায় বেড়েছে ১,০০০% এবং সঙমন্টের অনলাইন ব্যাগ বিক্রিতে ৯০% বৃদ্ধি দেখা গেছে। অন্যদিকে গুচ্চির অনলাইন ব্যাগ বিক্রি কমেছে ৫০% এবং মাইকেল কোরসের বিক্রি প্রায় ৪০% কমেছে।

টিমলে দেশীয় ব্র্যান্ডের শীর্ষস্থান
চীনের বৃহত্তম অনলাইন রিটেইল প্ল্যাটফর্ম টিমলে দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো এখন বিদেশি ব্র্যান্ডের চেয়েও বেশি আয় করছে। হাংঝৌ ঝিই টেক-এর তথ্য বলে লাওপু গোল্ড গত ১২ মাসে টিমলে বিক্রি করেছে ৬৩০ মিলিয়ন ডলার, যেখানে ভ্যান ক্লিফ অ্যান্ড আরপেলস বিক্রি করেছে মাত্র ৫৭ মিলিয়ন ডলার। মাও গেপিং কসমেটিকস বিক্রি করেছে ১২৫ মিলিয়ন ডলার, যা ববি ব্রাউনের বিক্রির দ্বিগুণ। লাওপু গোল্ডের অনলাইন এবং দোকান—দুটোয়ই বিক্রি ২০২৩ ও ২০২৪ সালে দ্বিগুণ হয়েছিল এবং ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে আরও ২৫০% বৃদ্ধি পেয়েছে। Bain & Co.-এর হিসাব বলে ২০২৪ সালে চীনের বিলাসবহুল বাজার প্রায় ২০% সংকুচিত হয়েছে—২০১১ সালের পর সবচেয়ে বড় পতন।
দামের ব্যবধান এবং নতুন মানসিকতা
চীনা ক্রেতারা এখন দাম হিসেব করেই ব্র্যান্ড বেছে নিচ্ছেন। আইসিকলের Aircoat কোটের দাম ১,১২৩ থেকে ২,৮০৮ ডলারের মধ্যে, যেখানে ম্যাক্স মারার একই ধরনের কোটের দাম ৪,২০০ ডলারের বেশি। সঙমন্টের ব্যাগ ৪২১ ডলার, যেখানে হেরমেস পিকোটিন ব্যাগের দাম ৫,০০০ থেকে ৮,০০০ ডলারের মধ্যে। যদিও দাম একটি বড় ফ্যাক্টর, তবে বিশেষজ্ঞদের মতে শুধু দাম নয়, গল্প, সংস্কৃতি এবং নান্দনিকতার গভীর সংযোগও ক্রেতাদের আকর্ষিত করছে। Digital Luxury Group-এর জ্যাক রোইজেন বলেন চীনা ব্র্যান্ডগুলো শুধু সস্তা নয়—তারা স্টোরিটেলিং এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে, যা তরুণদের সাথে গভীরভাবে মিলে যাচ্ছে।
চীনা সংস্কৃতির প্রতি নতুন আগ্রহ
চীনা ব্র্যান্ডগুলো এখন নিজেদের পরিচয়ে জোর দিচ্ছে। সঙমন্ট তাদের নকশায় পূর্বীয় নান্দনিকতা ব্যবহার করে এবং দোকানের ডিজাইনে ক্যালিগ্রাফির ছাপ রাখে। টু সামার চীনা চায়ের ঘ্রাণ, অস্মান্থাস, সংরক্ষিত কমলালেবুর খোসার মতো ঐতিহ্যবাহী উপাদান ব্যবহার করে সুগন্ধি তৈরি করে এবং জিংদেজেনের পোর্সেলিন ব্যবহার করে। আইসিকলের ডিজাইন কনফুসিয়াসের সমন্বয়ের দর্শন থেকে অনুপ্রাণিত। সঙমন্টের প্রতিষ্ঠাতা ফু সঙ জানান যে তারা শুরু থেকেই নিজেদেরকে স্থানীয় সংস্কৃতিভিত্তিক চীনা ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত করতে চেয়েছেন।
ক্রেতার বাস্তব অভিজ্ঞতা
অনেক চীনা ক্রেতা এখন বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডের পরিবর্তে নিজেদের দেশের ব্র্যান্ডে আস্থা রাখছেন। সাংহাইয়ের ৩০ বছর বয়সী ওয়ান ইয়িহুয়ান আগে হারমেস বা টম ফোর্ড ছাড়া কিছু ভাবতেন না, কিন্তু এখন তিনি সঙমন্টের ২১০ ডলারের ব্যাগ ব্যবহার করেন এবং মাও গেপিং মেকআপ করেন। তিনি বলেন, একসময় তিনি ভেবেছিলেন বিলাসবহুল পণ্যই পরিচয়ের প্রতীক, কিন্তু এখন তিনি শুধু এমন পণ্য চান যা তার সত্যিকারের পছন্দের।
লাওপু গোল্ডের বিস্ফোরক উত্থান
লাওপু গোল্ড বর্তমানে চীনে সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান ব্র্যান্ডগুলোর একটি। BigOne-এর তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সাল থেকে তাদের স্টোর বিক্রি ১০০% এর বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে টিফানি ও বুলগারির মতো ব্র্যান্ডগুলো বিক্রিতে বড় পতনের মুখে। বেইজিংয়ের এসকেপি মলে ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে লাওপুর বিক্রি ২০০% বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৫ সালে তারা চীনের সব শীর্ষ ১০টি বিলাসবহুল মলে দোকান খুলে প্রথম স্থানীয় ব্র্যান্ড হিসেবে নতুন মাইলফলক তৈরি করেছে।

উৎপাদনে নতুন মান
চীন যেখানে সস্তা উৎপাদনের জন্য পরিচিত ছিল, সেখানে এখন প্রিমিয়াম মানের কারুশিল্পে নতুন ধারণা তৈরি হচ্ছে। আইসিকল ২০১৩ সালে ম্যাক্স মারার উৎপাদনকারী একটি চীনা কারখানা কিনেছে। সঙমন্ট অত্যন্ত উচ্চমানের ফুল-গ্রেইন কাউহাইড এবং গোল্ড-প্লেটেড হার্ডওয়্যার ব্যবহার করে, যা দক্ষ কারিগরদের হাতে তৈরি। লাওপু গোল্ড ঐতিহ্যবাহী এনামেল এবং ফিলিগ্রি টেকনিক ব্যবহার করে গহনা তৈরি করে। মাও গেপিং স্থানীয় মডেলে মেকআপ শেখানোর মাধ্যমে লাখো ভক্ত অর্জন করেছেন।
বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশ
সঙমন্ট, টু সামার এবং মাও গেপিং আন্তর্জাতিক বাজারে বিস্তৃত হতে চায়। যদিও বিদেশি বাজারে তাদের বিক্রি এখনো সীমিত, বিশ্লেষকদের মতে তারা দ্রুতই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় জায়গা করে নিতে পারে।
চ্যালেঞ্জ সামনে
গোল্ডম্যান স্যাক্সের বিশ্লেষক মিশেল চেং মনে করেন চীনের বাজারে ১ থেকে ৫ বিলিয়ন ইউয়ান আয় করা সহজ হলেও ১০ বিলিয়ন ইউয়ান ছুঁতে হলে প্রয়োজন দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল। ইউরোমনিটরের ডেটা বলছে, চীনের বিলাসবহুল বাজারে শীর্ষ ১০ ব্র্যান্ডই পশ্চিমা, যাদের বিক্রির অংশ ৬৩%। চীনা ব্র্যান্ডগুলোর বাজার শেয়ার এখনো ০.৫% এরও কম।
অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বিলাসের জাদু কমছে
চীনের অর্থনৈতিক মন্দা শুধু বিদেশি নয়, দেশীয় বিলাসবহুল ব্র্যান্ডগুলোর ওপরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে। অনেক ক্রেতাই এখন আগের মতো বড় খরচ করতে চাইছেন না। গুও ওয়েনজুন, যিনি আগে একবারে ৭০ হাজার ডলার খরচ করতেন, এখন ৭ ডলারের টোট ব্যাগ আর ৪ ডলারের টি-শার্ট কিনছেন। তার মতে বিলাসপণ্যের সেই আকর্ষণ আর নেই।
#চীন #বিলাসবহুলবাজার #স্থানীয়ব্র্যান্ড #ফ্যাশন #অনলাইনবিক্রি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















