ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনি এখনও জীবিত, কিন্তু ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর তার ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। স্বৈরশাসিত সরকারগুলোরও শাসকদের শাস্তি দেওয়ার নিজস্ব পদ্ধতি থাকে—মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ, সাজানো বিচার, কিংবা রাজনৈতিক অপমানের মাধ্যমে। আবার কখনো ব্যর্থ নেতাদের সামান্য সম্মানও দেওয়া হয়। বর্তমানে ৮৬ বছর বয়সী খামেনি ঠিক এমন এক অবস্থানে, যেখানে ব্যর্থতা তাকে দুর্বল করে দিয়েছে এবং তাঁর অনুসারীরা এখন বাস্তবে ক্ষমতা দখল করতে শুরু করেছে। জুন মাসের ১২ দিনের যুদ্ধ তাকে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছে—যে ব্যক্তি দীর্ঘদিন মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, সেই ক্ষমতা এখন ভেঙে পড়েছে।
জর্জরিত ভাবমূর্তি
যদি তিনি ২০২৩ সালের ৬ অক্টোবর মারা যেতেন, তবে ইতিহাস তাকে সফল বিপ্লবী নেতা হিসেবে স্মরণ করত। কিন্তু ৭ অক্টোবরের যুদ্ধের আগে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না এবং ফিলিস্তিনি জঙ্গিদের আগাম আক্রমণের সম্ভাবনা অনুমান করতেও ব্যর্থ হয়েছিলেন।
ইসরায়েল দেখিয়ে দিয়েছে যে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে, কিন্তু খামেনি পুরনো কৌশলে আঁকড়ে ছিলেন। ইরানের ভেতরেই বহুজন বুঝতে পেরেছিলেন যে দেশের সামরিক শক্তি যথেষ্ট নয়। এমনকি ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি)-এর ভেতর থেকেও দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের দাবি উঠেছিল। কিন্তু খামেনি তবুও ধীরে ধীরে পরমাণু কর্মসূচি বাড়ানোর পুরনো নীতিতেই অটল ছিলেন। ১২ দিনের যুদ্ধের আগেও ইরান দু’বার ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ভেবেছিল—তাদের ব্যালিস্টিক ক্ষমতা ইসরায়েলকে ঠেকাতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে তা ব্যর্থ হয়েছে।

ক্ষমতার সংকট
এখন খামেনি যখন গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন, তখনই অতীতে তার সামনে মাথা নত করা শক্তিশালী ব্যক্তিরা তাকে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন। ৩ নভেম্বর মার্কিন দূতাবাস দখলের বার্ষিকীতে তিনি ঘোষণা করেন—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের দ্বন্দ্ব মূলগত, এটি সহযোগিতার কোনো জায়গা তৈরি করে না।
কিন্তু মাত্র ছয় দিন পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি বলেন—যদি যুক্তরাষ্ট্র সমতার ভিত্তিতে আলোচনায় আগ্রহী হয়, তবে আলোচনা সম্ভব। কিছুদিন পরেই আলী লারিজানি বলেন—ইরানের নেতারা কখনো স্বভাবগতভাবে পশ্চিমবিরোধী ছিলেন না, বরং পশ্চিমের আচরণই বিরোধ সৃষ্টি করেছে।
এই সবকিছুই দেখায়—তেহরানের ক্ষমতার অভ্যন্তরে বহুজন আমেরিকা বা ইসরায়েলের সম্ভাব্য আক্রমণে আতঙ্কিত। তাই তারা কূটনৈতিক সমাধানের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
পুরনো নাটক ভেঙে পড়ছে
খামেনি অতীতে কৌশলে আমেরিকাবিরোধী বক্তব্য দিতেন, আর তার কূটনীতিকরা সেই বক্তব্য ব্যবহার করে বিদেশি শক্তির কাছ থেকে ছাড় আদায় করতেন—বিশেষ করে ওবামা আমলের ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায়।
কিন্তু এখন তার বিরুদ্ধে যেসব অবস্থান নেওয়া হচ্ছে, তা আর সাজানো নয়—এগুলি বাস্তব অসন্তোষ ও ভয় থেকে উঠে আসছে।
অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ
২০০৯ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর সংস্কারপন্থী নেতা মেহদি কাররুবিকে ১৪ বছর গৃহবন্দি রাখা হয়েছিল। মার্চে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি সরাসরি খামেনিকে আক্রমণ করে বলেন—খামেনির ভুল সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, নিরাপত্তা ও নৈতিকতাকে ধ্বংস করেছে। আশ্চর্যজনকভাবে তাকে কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি, কারণ নেতৃত্বের ভেতরেও বহুজন তার সঙ্গে একমত।
নতুন ক্ষমতাকাঠামো
যদিও খামেনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন, ইরানের শাসনযন্ত্র থেমে নেই। বিভিন্ন স্তরে দায়িত্ব ভাগ হয়ে গেছে।
– আলী লারিজানি জাতীয় নিরাপত্তার বড় অংশ সামলাচ্ছেন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে পরস্পরবিরোধী বার্তা দিচ্ছেন, যাতে পশ্চিমারা আবার দীর্ঘ আলোচনায় জড়িয়ে পড়ে।
– বিচারবিভাগের প্রধান ঘোলাম-হোসেইন মোহসেনি-ইজেই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং ইসরায়েলের সহযোগীদের দ্রুত শাস্তি দিতে নির্দেশ দিচ্ছেন।
– প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান অর্থনীতি ও পরিবেশগত সংকট সামলানোর চেষ্টা করছেন।
– আইআরজিসি, সংসদের স্পিকার মোহাম্মদ গালিবাফ এবং বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও রাজনৈতিক প্রভাব ধরে রেখেছে।
সমষ্টিগত নেতৃত্ব সাধারণত দীর্ঘমেয়াদে অকার্যকর হয়, কিন্তু আপাতত পরিস্থিতি টিকে আছে।

খামেনির সাফল্যই আজ তার ব্যর্থতা
বিপরীতভাবে, খামেনিরই গড়ে তোলা ইসলামপন্থী কাঠামো আজ তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। তারা বিপ্লবের উত্তরাধিকারের প্রতি এতটাই অনুগত যে খামেনি দুর্বল হলেও ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে না। খামেনির অনুপস্থিতিতেও ইসলামিক রিপাবলিক তার কাঠামো ও মতাদর্শ ধরে রাখতে পারবে—এই বার্তা দেশে কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে এখন প্রকাশ্যে শোনা যাচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে খামেনির কৌশল ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু দেশের ভেতরে তিনি নিজের মতো নেতাদের তৈরি করতে সফল। আর সেই উত্তরাধিকারই আজ তাকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে।
৭ অক্টোবরের পর ইসরায়েলের সামরিক সাফল্য এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের একদিনের বোমা হামলা খামেনিকে এমন অবস্থায় ফেলেছে—যেখানে তাকেই ব্যর্থতার দায় নিতে হচ্ছে, আর তার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা রয়ে গেছেন ক্ষমতার কেন্দ্রে।
#ইরান #আলি_খামেনি #মধ্যপ্রাচ্য #ইসরায়েল #রাজনীতি #ক্ষমতা_সংকট #পরমাণু_কর্মসূচি #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















