দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ং সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা সফর করে দেশটির অস্ত্র ও পারমাণবিক শক্তি খাতে বড় ধরনের রপ্তানি সুযোগ তৈরির ভিত্তি স্থাপন করেছেন। বিশ্বের শীর্ষ দশ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে অবস্থান থাকা দক্ষিণ কোরিয়া এবার আন্তর্জাতিক বাজারে নিজের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে চাইছে। তাঁর এই সফরকে সেই দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সফরের উদ্দেশ্য ও কৌশলগত গুরুত্ব
লি জে মিয়ং-এর সফর মূলত সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), মিশর, দক্ষিণ আফ্রিকা ও তুরস্ককে কেন্দ্র করে। এর মধ্যে ইউএই ছিল অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার, কারণ দক্ষিণ কোরিয়া এই দেশকে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় অস্ত্র রপ্তানির সম্প্রসারণের একটি কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। দক্ষিণ কোরিয়া দীর্ঘদিন ধরে সেমিকন্ডাক্টর ও ইলেকট্রনিক্স নির্ভর অর্থনীতির বাইরে নতুন শিল্পখাতে প্রবেশ করতে চাইছে, এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানি সেই কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ইউএই-দক্ষিণ কোরিয়ার সহযোগিতা ও চুক্তি
১৮ নভেম্বর আবুধাবিতে ইউএই প্রেসিডেন্ট শেখ মুহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সঙ্গে বৈঠকের পর দুই দেশ সাতটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে। এসব চুক্তির মধ্যে রয়েছে প্রতিরক্ষা শিল্পে যৌথ উন্নয়ন, স্থানীয়ভাবে অস্ত্র উৎপাদনে, তৃতীয় দেশের যৌথ রপ্তানি, ছোট মডুলার পারমাণবিক রিয়্যাক্টর উন্নয়ন, পারমাণবিক শক্তির সঙ্গে এআই প্রযুক্তি যুক্ত করা, এবং মহাকাশ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে নতুন সহযোগিতা। প্রেসিডেন্টের চিফ অব স্টাফ কাং হুন-সিক জানান যে এসব চুক্তি শুধু মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় নয়, বরং ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং অন্যান্য অঞ্চলে দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য নতুন বাজার খুলে দেবে।

ব্যবসায়িক নেতাদের উপস্থিতি ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য
লি জে মিয়ং-এর সঙ্গে ইউএই সফরে গিয়েছিলেন স্যামসাং ইলেকট্রনিকসের এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান লি জে-ইয়ং এবং হুন্ডাই মোটর গ্রুপের চেয়ারম্যান চুং ইউ-সনসহ দেশের প্রধান শিল্প প্রতিষ্ঠানের নেতারা। তাদের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে দক্ষিণ কোরিয়া প্রতিরক্ষা রপ্তানিকে আলাদা কোনো উদ্যোগ হিসেবে নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনৈতিক কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখছে, যেখানে প্রযুক্তি, অটোমোটিভ, পারমাণবিক শক্তি এবং প্রতিরক্ষা খাত পরস্পর পরিপূরক ভূমিকা পালন করছে।
ইউএই-এর আগ্রহ ও সম্ভাব্য অর্ডার
দক্ষিণ কোরিয়ার চিফ অব স্টাফ কাং হুন-সিক জানান যে এই সফরের ফলে দেশটির কোম্পানিগুলো ১৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি প্রতিরক্ষা অর্ডার পেতে পারে। ইউএই ইতিপূর্বে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ভূমি-থেকে-আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র সহ বিভিন্ন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছে। বর্তমানে তারা দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম দেশীয় যুদ্ধবিমান KF-21 কেনার আগ্রহ দেখাচ্ছে, যার উৎপাদন ২০২৬ সালে শুরু হবে।
মিশর, দক্ষিণ আফ্রিকা ও তুরস্কের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও পারমাণবিক সহযোগিতা
মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ এল-সিসির সঙ্গে বৈঠকে লি জে মিয়ং প্রতিরক্ষা শিল্পে যৌথ উৎপাদনের প্রস্তাব দেন, যার মধ্যে FA-৫০ হালকা আক্রমণাত্মক বিমান ও অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্র উল্লেখযোগ্য। তুরস্ক সফরে তিনি প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোগানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং একই দিনে পারমাণবিক প্রযুক্তি সহযোগিতার একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার লক্ষ্য হচ্ছে তুরস্কের সিনোপ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি অর্জন করা।

দক্ষিণ কোরিয়ার রপ্তানি নীতি ও বিগত সাফল্য
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন সরকার প্রতিরক্ষা রপ্তানিকে জাতীয় কৌশলের একটি কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। ২০২০-২৪ সময়ে বিশ্বের ১০ম বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে প্রযুক্তিগত যুদ্ধাবস্থায় থাকায় দেশটি স্থল ভিত্তিক অস্ত্র উৎপাদনে বিশেষ সক্ষমতা বজায় রেখেছে। পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইয়লের শাসনামলে ইউক্রেন যুদ্ধের পর ইউরোপে K2 ট্যাঙ্ক এবং K9 স্বয়ংচালিত হাউইটজার রপ্তানিতে অগ্রগতি হয় এবং পোল্যান্ডে যুদ্ধবিমান ও ট্যাঙ্ক সরবরাহ করা হয়। আরও আগে লি মিয়ং-বাকের সময় দক্ষিণ কোরিয়া বারাকা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি জেতে, যেখানে জাপান ও ফ্রান্সের প্রতিযোগী ছিল।
রপ্তানির কৌশল ও দামের প্রতিযোগিতা
দক্ষিণ কোরিয়ার রপ্তানি কৌশলের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো যৌথ উৎপাদন, পুরোনো অস্ত্রের পুনরায় বিক্রি, আর্থিক সহায়তা এবং অর্থনৈতিক সাহায্যের প্যাকেজ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে দক্ষিণ কোরিয়ার অস্ত্র আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে মূলত তুলনামূলকভাবে কম দামের কারণে। এই সাশ্রয়ী মূল্য দক্ষিণ কোরিয়াকে বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে নিয়ে গেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে বিস্তৃত অর্থনৈতিক লক্ষ্য
অস্ত্র রপ্তানির বাইরে দক্ষিণ কোরিয়া মধ্যপ্রাচ্যে প্রসাধনী, খাদ্য, সাংস্কৃতিক পণ্যসহ বিভিন্ন খাতে রপ্তানি বাড়াতে চায়। ২০২৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউএই একটি বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি সই করেছে, যার আওতায় ধীরে ধীরে শুল্ক তুলে দেওয়া হবে। এতে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানের তুলনায় প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে, কারণ এসব দেশ এখনো ইউএই-এর সঙ্গে এমন চুক্তি করেনি।
লি জে মিয়ং-এর এই বিস্তৃত সফর দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি, পারমাণবিক শক্তি এবং বৃহত্তর অর্থনৈতিক কৌশলকে বৈশ্বিক পর্যায়ে শক্তিশালী করার একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। সাশ্রয়ী মূল্যের অস্ত্র, উন্নত প্রযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়া বৈশ্বিক বাজারে আরও প্রভাবশালী শক্তি হয়ে ওঠার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
#arms_export #SouthKorea #UAE #MilitaryCooperation #NuclearEnergy #LeeJaeMyung #DefenseIndustry #MiddleEast #Africa #KoreaUAE #GlobalTrade
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















