০৯:০৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশে খাদ্য মজুদ দ্রুত কমছে: সামনে কি ঘাটতির বাস্তব ঝুঁকি?

সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মজুদ মাত্র কয়েক মাসে ২১ লাখ টন থেকে কমে ১৩ লাখ টনে নেমে এসেছে। বাজারে দামের চাপ, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, আমদানিনির্ভরতা এবং আবহাওয়ার অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা এখন বাস্তব ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা।


সরকারি মজুদের বর্তমান অবস্থা

চাল, গম ও ধান মিলিয়ে সরকারের হাতে এখন প্রায় ১৩ লাখ ১৪ হাজার টন খাদ্যশস্য রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই চাল। মাত্র তিন–চার মাস আগেও মজুদ ছিল ২১ লাখ টনের বেশি। অর্থাৎ অল্প সময়েই প্রায় ৮ লাখ টন কমে গেছে। এই দ্রুত পতন বাজারে স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং সরকার নতুন করে আমদানির আলোচনা শুরু করেছে।

কেন আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে

খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিদর্শন ইউনিট (FPMU) এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে—২০২২–২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ৫ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য আমদানি করেছে। উৎপাদন ঝুঁকি, বন্যা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং বিশ্ববাজারের দামের ওঠানামার কারণে দেশ এখনও আমদানিভরসা কাটাতে পারেনি। ২০২৫–২৬ অর্থবছরের জন্যও ১.৫ মিলিয়ন টন আমদানির পরিকল্পনা চূড়ান্ত।

দেশীয় চাহিদা বনাম মজুদ: ঘাটতির ইঙ্গিত কোথায়

ট্যারিফ কমিশন অনুযায়ী দেশে বছরে চালের চাহিদা ৩.৫ থেকে ৩.৮ কোটি টন। সরকারি বণ্টন, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ও দুর্যোগ মোকাবিলায় একটি স্থিতিশীল নিরাপত্তা মজুদ প্রয়োজন। বর্তমানে যে মজুদ রয়েছে, তা নিয়মিত সরবরাহের জন্য “মধ্যম মানের” হলেও, ঘাটতি ঠেকানোর মতো শক্তিশালী নয়। বন্যা বা আমদানি বিলম্ব হলে এই মজুদ দ্রুত নেমে যেতে পারে।

খাদ্য-জ্বালানির দ্বৈত সংকটের মুখে বাংলাদেশ – DW – 28.10.2022

খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে বাড়তি চাপ

২০২৫ সালে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মেয়াদ বাড়িয়ে ছয় মাস করায় অতিরিক্ত ১.৫ লাখ টন চালের প্রয়োজন হয়েছে। বাজারে দামের চাপ সামাল দিতে ও নিম্নআয়ের মানুষকে সহায়তা করতে এই কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এতে সরকারি গুদামের ওপর চাপ বাড়ছে। খাদ্য অধিদপ্তর বলছে—মজুদ “পর্যাপ্ত”—তবে ঝুঁকি কমাতে আগেই আমদানি অনুমোদন রাখা হচ্ছে।

স্থানীয় উৎপাদন কি চাপ কমাতে পারবে?

কৃষি অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, আমন কাটার মৌসুম শুরু হওয়ায় বাজারে কিছুটা স্বস্তি ফিরতে পারে। তবে এখনই বড় পরিমাণে আমদানি করলে স্থানীয় বাজারে দাম কমে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ—চাতাল মালিকদের পরিবর্তে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করলে কৃষকের আয় বাড়বে এবং বাজারও স্থিতিশীল থাকবে।

সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা কম: কেন উদ্বেগ?

চলতি মৌসুমে সরকার মাত্র ৭ লাখ টন সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়েছে, যা বিশেষজ্ঞদের মতে প্রয়োজনের তুলনায় কম। গত বছর সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল বেশি। ফলে এই কম সংগ্রহ পরিকল্পনা বাজার ও মজুদের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করতে পারে। মজুদ বাড়াতে সরকারকে—

১) সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ক্রয় বৃদ্ধি
২) প্রয়োজন হলে পরিমিত আমদানি
৩) সারা বছর স্থিতিশীল নীতি বজায় রাখার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে

২০২৩–২৫ তুলনা: কেন মজুদ এত দ্রুত কমল

২০২৩ সালে গড় মজুদ ছিল ১৬–১৮ লাখ টন। ২০২৪ সালে বন্যার পর আমদানি বাড়িয়ে মজুদ ২১ লাখ টন পর্যন্ত নেওয়া হয়। কিন্তু ২০২৫ সালের শেষভাগে এসে মজুদ কমে ১৩ লাখ টনে নেমে এসেছে—গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই পরিস্থিতিই খাদ্য ঘাটতির বাস্তব আশঙ্কা তৈরি করছে।

উপসংহার: সংকট এখনো নয়, কিন্তু ঝুঁকি বাড়ছে

এখনই সরাসরি “খাদ্যসংকট” নেই, তবে মজুদ কমে যাওয়া, চাহিদা বৃদ্ধি, আমদানির ওপর নির্ভরতা এবং জলবায়ু ঝুঁকি—এই চার কারণে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নাজুক অবস্থায় আছে। আমন বাজারে এলে চাপ কমবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে মজুদ কমপক্ষে ১৮–২০ লাখ টনে ফিরিয়ে আনা জরুরি।

বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা এখন এক ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ভারসাম্যে দাঁড়িয়ে—একদিকে বাজার, অন্যদিকে কৃষক, মাঝখানে সরকারি মজুদ। সময়মতো পদক্ষেপই ভবিষ্যতে বড় সংকট ঠেকাতে পারে।

 

#বাংলাদেশ_খাদ্যমজুদ #খাদ্যঘাটতি #চাল_গম #খাদ্যনিরাপত্তা #আমদানিনির্ভরতা #সারাক্ষণ_রিপোর্ট

জনপ্রিয় সংবাদ

বাংলাদেশে খাদ্য মজুদ দ্রুত কমছে: সামনে কি ঘাটতির বাস্তব ঝুঁকি?

০৭:৪৭:২২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৫

সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মজুদ মাত্র কয়েক মাসে ২১ লাখ টন থেকে কমে ১৩ লাখ টনে নেমে এসেছে। বাজারে দামের চাপ, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, আমদানিনির্ভরতা এবং আবহাওয়ার অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা এখন বাস্তব ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা।


সরকারি মজুদের বর্তমান অবস্থা

চাল, গম ও ধান মিলিয়ে সরকারের হাতে এখন প্রায় ১৩ লাখ ১৪ হাজার টন খাদ্যশস্য রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই চাল। মাত্র তিন–চার মাস আগেও মজুদ ছিল ২১ লাখ টনের বেশি। অর্থাৎ অল্প সময়েই প্রায় ৮ লাখ টন কমে গেছে। এই দ্রুত পতন বাজারে স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং সরকার নতুন করে আমদানির আলোচনা শুরু করেছে।

কেন আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে

খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিদর্শন ইউনিট (FPMU) এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে—২০২২–২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ৫ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য আমদানি করেছে। উৎপাদন ঝুঁকি, বন্যা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং বিশ্ববাজারের দামের ওঠানামার কারণে দেশ এখনও আমদানিভরসা কাটাতে পারেনি। ২০২৫–২৬ অর্থবছরের জন্যও ১.৫ মিলিয়ন টন আমদানির পরিকল্পনা চূড়ান্ত।

দেশীয় চাহিদা বনাম মজুদ: ঘাটতির ইঙ্গিত কোথায়

ট্যারিফ কমিশন অনুযায়ী দেশে বছরে চালের চাহিদা ৩.৫ থেকে ৩.৮ কোটি টন। সরকারি বণ্টন, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ও দুর্যোগ মোকাবিলায় একটি স্থিতিশীল নিরাপত্তা মজুদ প্রয়োজন। বর্তমানে যে মজুদ রয়েছে, তা নিয়মিত সরবরাহের জন্য “মধ্যম মানের” হলেও, ঘাটতি ঠেকানোর মতো শক্তিশালী নয়। বন্যা বা আমদানি বিলম্ব হলে এই মজুদ দ্রুত নেমে যেতে পারে।

খাদ্য-জ্বালানির দ্বৈত সংকটের মুখে বাংলাদেশ – DW – 28.10.2022

খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে বাড়তি চাপ

২০২৫ সালে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মেয়াদ বাড়িয়ে ছয় মাস করায় অতিরিক্ত ১.৫ লাখ টন চালের প্রয়োজন হয়েছে। বাজারে দামের চাপ সামাল দিতে ও নিম্নআয়ের মানুষকে সহায়তা করতে এই কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এতে সরকারি গুদামের ওপর চাপ বাড়ছে। খাদ্য অধিদপ্তর বলছে—মজুদ “পর্যাপ্ত”—তবে ঝুঁকি কমাতে আগেই আমদানি অনুমোদন রাখা হচ্ছে।

স্থানীয় উৎপাদন কি চাপ কমাতে পারবে?

কৃষি অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, আমন কাটার মৌসুম শুরু হওয়ায় বাজারে কিছুটা স্বস্তি ফিরতে পারে। তবে এখনই বড় পরিমাণে আমদানি করলে স্থানীয় বাজারে দাম কমে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ—চাতাল মালিকদের পরিবর্তে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করলে কৃষকের আয় বাড়বে এবং বাজারও স্থিতিশীল থাকবে।

সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা কম: কেন উদ্বেগ?

চলতি মৌসুমে সরকার মাত্র ৭ লাখ টন সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়েছে, যা বিশেষজ্ঞদের মতে প্রয়োজনের তুলনায় কম। গত বছর সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল বেশি। ফলে এই কম সংগ্রহ পরিকল্পনা বাজার ও মজুদের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করতে পারে। মজুদ বাড়াতে সরকারকে—

১) সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ক্রয় বৃদ্ধি
২) প্রয়োজন হলে পরিমিত আমদানি
৩) সারা বছর স্থিতিশীল নীতি বজায় রাখার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে

২০২৩–২৫ তুলনা: কেন মজুদ এত দ্রুত কমল

২০২৩ সালে গড় মজুদ ছিল ১৬–১৮ লাখ টন। ২০২৪ সালে বন্যার পর আমদানি বাড়িয়ে মজুদ ২১ লাখ টন পর্যন্ত নেওয়া হয়। কিন্তু ২০২৫ সালের শেষভাগে এসে মজুদ কমে ১৩ লাখ টনে নেমে এসেছে—গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই পরিস্থিতিই খাদ্য ঘাটতির বাস্তব আশঙ্কা তৈরি করছে।

উপসংহার: সংকট এখনো নয়, কিন্তু ঝুঁকি বাড়ছে

এখনই সরাসরি “খাদ্যসংকট” নেই, তবে মজুদ কমে যাওয়া, চাহিদা বৃদ্ধি, আমদানির ওপর নির্ভরতা এবং জলবায়ু ঝুঁকি—এই চার কারণে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নাজুক অবস্থায় আছে। আমন বাজারে এলে চাপ কমবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে মজুদ কমপক্ষে ১৮–২০ লাখ টনে ফিরিয়ে আনা জরুরি।

বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা এখন এক ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ভারসাম্যে দাঁড়িয়ে—একদিকে বাজার, অন্যদিকে কৃষক, মাঝখানে সরকারি মজুদ। সময়মতো পদক্ষেপই ভবিষ্যতে বড় সংকট ঠেকাতে পারে।

 

#বাংলাদেশ_খাদ্যমজুদ #খাদ্যঘাটতি #চাল_গম #খাদ্যনিরাপত্তা #আমদানিনির্ভরতা #সারাক্ষণ_রিপোর্ট