ফিলিপাইনের বহু নারী বিদেশে ভালো আয়ের আশায় কাজ খুঁজতে যান। কেউ গ্রাহকসেবায়, কেউ হোটেলের চাকরিতে—এমন আশা নিয়ে দেশ ছাড়েন। কিন্তু অনেকেই অজান্তেই মানবপাচার চক্রের হাতে পড়ে যান। তাদের নিয়ে যাওয়া হয় প্রতারণা ব্যবসার অন্ধকার দুনিয়ায়, যেখানে জোরপূর্বক শ্রম, মানসিক নির্যাতন এবং যৌন সহিংসতার মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হয়। আর দেশে তাদের সন্তানরা অপেক্ষা করে একজন অনুপস্থিত মায়ের জন্য।
মায়ের ফেরার অপেক্ষা
মানিলার বাইরে একটি ছোট দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি শিশু প্রতিদিন মায়ের খোঁজ করে। বাড়ির ভেতরে তার খালা ও দাদা-দাদি জানে—মা নাকি বিদেশে চাকরি করছেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি বন্দি হয়ে আছেন প্রতারণার ঘাঁটিতে, যেখানে নির্যাতন ও অমানবিক আচরণের শিকার তিনি। সন্তানদের মনোবল ভেঙে না দিতে পরিবার সত্য গোপন রাখে।
নারীদের প্রতি প্রতারকদের বাড়তি নজর
বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রতারণা শিল্পে নারীদের ব্যবহার বাড়ছে। কারণ তাদের মুখ, কণ্ঠস্বর ও পরিচয় ব্যবহার করে প্রেমের ফাঁদ, বিনিয়োগ প্রতারণা এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ভুয়া চিত্র তৈরি করা সহজ। অনেক ক্ষেত্রে নারীদের জোর করে যৌন সেবায় নিযুক্ত করা হয়, কিংবা শাস্তি হিসেবে যৌন সহিংসতার মুখোমুখি হতে হয়।
দারিদ্র্য, বিদেশে কাজের স্বপ্ন ও প্রতারণা
ফিলিপাইনে স্থায়ী আয়ের অভাব বহু নারীকে বিদেশে কাজ নিতে বাধ্য করে। সন্তানদের পড়াশোনা, বাড়ি কেনা বা বাবা-মায়ের চিকিৎসার খরচ—এসব দায়িত্বের চাপ তাদের এই ঝুঁকি নিতে বাধ্য করে। এই দুর্বলতাকেই কাজে লাগায় অপরাধচক্র। ফলে পরিবারের ভরসা হয়ে থাকা নারীরা হারিয়ে যান অজানা কষ্টের অন্ধকারে।
এক নারীর প্রতারণা ফাঁদে পড়ার গল্প
ক্যাসি নামের এক নারী অনলাইনে বিদেশে গ্রাহকসেবার চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে যাত্রা শুরু করেন। অভিজ্ঞতা থাকায় তিনি সন্দেহ করেননি। কিন্তু পৌঁছেই বুঝতে পারেন—সবই ফাঁদ। তাকে বাধ্য করা হয় স্ক্যাম কাজে—যেখানে নির্দিষ্ট স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করিয়ে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। একই ভবনে চলত প্রেমের ফাঁদ, বিনিয়োগ প্রতারণা, ঋণ প্রতারণা, এমনকি মাদক ও বন্যপ্রাণী পাচারের মতো অপরাধও।
প্রতিরোধের ঝুঁকি ও মুক্তি
একদিন ক্যাসি জানতে পারেন, তার দেশের মানুষকে বিক্রি করার বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। এতে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতারকের মুখোমুখি দাঁড়ান। আগে বহু শাস্তি সহ্য করলেও তিনি প্রতিবাদ থামাননি। অবশেষে তার দেশের দূতাবাসের সহায়তায় তিনি উদ্ধার হন। কিন্তু শারীরিক ও মানসিক ক্ষত আজও তাকে তাড়া করে।
পরিবারের ভেঙে পড়া জীবন
বিদেশে কাজের জন্য পরিবারের সাপোর্ট সাধারণত নারীর ওপরই থাকে। কিন্তু তারা যখন বন্দি হয়ে পড়েন, তখন পরিবারে দেখা দেয় আর্থিক সংকট। যারা সন্তানদের দেখাশোনা করেন, তারা একাই সামলাতে পারেন না। ফলে বিক্রি করতে হয় আসবাব, বন্ধ করতে হয় নানা খরচ—শিশুর স্কুল জীবনও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
যৌন নির্যাতনের আতঙ্ক
বন্দি থাকা নারীরা জানান, প্রতারণা কাজে দক্ষ না হলে তাদের শাস্তি হিসেবে যৌন সহিংসতার শিকার হতে হয়। কেউ কেউ জোর করে নগ্ন অবস্থায় ভিডিও ধারণের কথাও জানিয়েছেন। অনেক নারী লজ্জা, ভয় এবং পরিবারের মানসিক চাপের কারণে এসব কথা প্রকাশও করতে পারেন না।
সরকারি সহায়তার সীমাবদ্ধতা
বহু পরিবার সরকারের কাছে দীর্ঘদিন ধরে সাহায্য চাইলেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাচ্ছে না। কারণ প্রতারণা চক্র এখন আন্তর্জাতিক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং অপরাধচক্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক উদ্ধার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।

গোপন স্ক্যাম সেন্টারের অভ্যন্তরীণ দুনিয়া
একটি পরিত্যক্ত স্ক্যাম কমপাউন্ডে পাওয়া যায় বড় অফিসঘর, অসংখ্য সিমকার্ড, প্রতারণার গাইডবই, ভিডিও কলের স্ক্রিপ্ট—সবই এই শিল্পের জটিলতা ও সংগঠিত কাঠামো তুলে ধরে। বিলাসবহুল বাড়িতে থাকেন প্রধান অপরাধীরা, আর তাদের কর্মীরা কাজ করেন অমানবিক পরিবেশে।
প্রযুক্তিনির্ভর প্রতারণা
স্ক্যাম ব্যবসা এখন আরও উন্নত প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় মুখ বদলানো, কণ্ঠ পরিবর্তন, স্বয়ংক্রিয় অনুবাদ—এসব ব্যবহার করে প্রতারণাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তবসম্মত দেখানো হয়। নারীরা একই দিনে বিভিন্ন ভুয়া পরিচয়ে ভিডিও কল করে ভুক্তভোগীদের ফাঁদে ফেলেন।
এক মডেল-নারীর বাস্তব অভিজ্ঞতা
সারা নামের এক নারী জানান, তাকে আইটি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে গিয়ে বাধ্য করা হয় ভিডিও কল, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কথোপকথন এবং ধনী জীবনের ভান করা শেখাতে। তাকে বলা হয় বিলাসী জীবনধারা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে, যাতে ভুক্তভোগীরা তাকে বিশ্বাস করে। নারীদের সবচেয়ে বড় ভয়—যৌন দাসত্বে বাধ্য করা—এই ভয়কেই ব্যবহার করে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।

পালিয়ে বাঁচা ও নতুন শুরু
সারা সুযোগ পেয়ে পালিয়ে আসেন এবং আর ফিরে যাননি। ক্যাসিও ফিরে এসেছেন, তবে পরিবারের ওপর পড়া ঋণ এবং মানসিক আঘাত থেকে বেরিয়ে আসতে তার সময় লাগবে। আর লিলি অবশেষে ফিরেছেন তার দুই সন্তানকে বুকে জড়িয়ে নতুন জীবন শুরু করার জন্য।
#মানবপাচার #নারীনির্যাতন #স্ক্যামইন্ডাস্ট্রি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















