শিশুর জন্মের পর মায়ের স্তন থেকে প্রথম যে ঘন, হলদে তরল নিঃসরণ হয়, সেটিই কলোস্ট্রাম। কয়েক দিনের মধ্যেই এই কলোস্ট্রাম স্তন্যদুগ্ধে রূপ নেয়। পুষ্টি, অ্যান্টিবডি, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রোটিন ও টিস্যু গঠনে সহায়ক অ্যামিনো অ্যাসিডে ভরপুর এই ‘প্রথম দুধ’ নবজাতকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তাকে ভালোভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। এ কারণে প্রশ্ন উঠছে—যেহেতু কলোস্ট্রাম শিশুদের জন্য এত উপকারী, তাহলে কি এটি প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও কার্যকর?
বিশ্বব্যাপী কলোস্ট্রামের জনপ্রিয়তা
গরুর কলোস্ট্রাম বহু দেশে—যেমন ব্রিটেন, ভারত, তুরস্ক ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ায়—দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন খাবারে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক বছরে এর বাজার দ্রুত বড় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক খুচরা-বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান জানায়, শুধু এক বছরেই কলোস্ট্রাম সাপ্লিমেন্টের বিক্রি ১৫৫% বেড়েছে। তরল, গুঁড়ো বা ক্যাপসুল আকারে বিক্রি হওয়া এই পণ্য সম্পর্কে দাবিও কম নয়—এর ভক্তরা বলেন, এটি প্রদাহ কমায়, হজমশক্তি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, পেশি দৃঢ় করে, শ্বাসপ্রশ্বাসের দক্ষতা উন্নত করে এবং ত্বক পুনরুজ্জীবিত করে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে গবেষণা
এখন পর্যন্ত বিজ্ঞান যেটুকু বলছে, তার ফল মিলেমিশে আছে। পোল্যান্ডে ২৮ জন সাঁতারু ও ট্রায়াথলিটকে নিয়ে হওয়া একটি পরীক্ষায় প্রতিদিন ২৫ গ্রাম করে গরুর কলোস্ট্রাম ১২ সপ্তাহ খাওয়ানো হয়। তাতে লালায় থাকা ইমিউনোগ্লোবুলিন-এ নামের উপকারী অ্যান্টিবডির সামান্য কিন্তু ইতিবাচক বৃদ্ধি দেখা যায়—যা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও টক্সিন নিষ্ক্রিয় করতে সাহায্য করে। পাঁচটি র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল্ড ট্রায়ালের পর্যালোচনাতেও দেখা গেছে, কলোস্ট্রাম খাওয়া অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উপরের শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের হার ৩৮% কমে এবং সেরে ওঠার সময়ও দ্রুত হয়।
তবে এই গবেষণাগুলো মূলত সেইসব ক্রীড়াবিদদের ওপরই সীমাবদ্ধ ছিল, যাদের অতিরিক্ত ব্যায়ামের কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। নমুনার সংখ্যা ছিল ছোট, এবং অন্যান্য কিছু গবেষণা বড় ডোজেও তেমন কোনো উপকারিতা খুঁজে পায়নি।
হজম ও অন্ত্রের সুস্থতায় কলোস্ট্রামের ভূমিকা
গাট হেলথ বা অন্ত্রের স্বাস্থ্যে কলোস্ট্রামের প্রভাব তুলনামূলকভাবে বেশি প্রমাণভিত্তিক। উগান্ডায় ৮৪ জন এইচআইভি-সম্পর্কিত দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়ায় ভোগা রোগীর ওপর এক পরীক্ষায় দেখা যায়, যাদের স্ট্যান্ডার্ড চিকিৎসার পাশাপাশি কলোস্ট্রাম দেওয়া হয়, তাদের ডায়রিয়া দ্রুত কমে। নয় সপ্তাহ পর দেখা যায়, এরা গড়ে ১১% ওজনও বাড়িয়েছেন। অন্যদিকে যারা কলোস্ট্রাম পাননি, তারা ওজন ফিরে পাননি।
গবেষকদের মতে, কলোস্ট্রামের অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রোটিন—যেমন ল্যাকটোফেরিন ও ল্যাকটোপরঅক্সিডেজ—অন্ত্রের আস্তরণ মজবুত করতে সাহায্য করে। এর ফলে ‘লিকি গাট’ বা অন্ত্রের ঝিল্লি ফুটো হওয়ার প্রবণতা কমে, যা দেহে প্রদাহ ছড়ানোর অন্যতম কারণ। প্রদাহ কমলে শরীরের অক্সিজেন গ্রহণক্ষমতাও উন্নত হয়। ল্যাকটোফেরিন রক্তে লোহার সাথে যুক্ত হয়ে রক্তকণিকাকে অক্সিজেন বহনে সহায়তা করে। ইউরোপিয়ান জার্নাল অব স্পোর্ট সায়েন্স–এ প্রকাশিত সাম্প্রতিক ছোট এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ১২ সপ্তাহ প্রতিদিন ২৫ গ্রাম কলোস্ট্রাম নিয়েছেন, তাদের অক্সিজেন গ্রহণক্ষমতা প্লাসিবো গ্রুপের তুলনায় বেশি।

অতিরঞ্জিত দাবিগুলো
যদিও এসব ফলাফল আশাব্যঞ্জক, অনেক ক্ষেত্রেই কলোস্ট্রাম নিয়ে অতিরিক্ত দাবি করা হয়েছে। যেমন, পেশি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ওই EJSS গবেষণায় কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। ত্বক পুনরুজ্জীবনের দাবির ক্ষেত্রেও এখন পর্যন্ত কোনো পিয়ার-রিভিউড গবেষণা প্রকাশিত হয়নি। উপরন্তু, দৈনিক তিন গ্রাম কলোস্ট্রামের খরচই মাসে ৬০ ডলারের বেশি—যা বিবেচনার বিষয়।
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কলোস্ট্রাম কতটা উপকারী—সে বিষয়ে গবেষণার ফল এখনো মিশ্র। কিছু ক্ষেত্রে এটি উপকার দিতে পারে, বিশেষত অন্ত্রের স্বাস্থ্যে ও প্রদাহ কমাতে। তবে এর সীমাবদ্ধতা, খরচ এবং অসমর্থিত দাবির দিকগুলো সতর্কতার সাথে বিবেচনা করা জরুরি।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















