১০:১৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৫
২০২৬ সাল থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্মার্টফোন ও স্মার্টওয়াচ ব্যবহার নিষিদ্ধ তারেক রহমান শিগগিরই দেশে ফিরবেন: সালাহউদ্দিন চীনের হাতে বৈশ্বিক ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের নিয়ন্ত্রণ সিঙ্গাপুরের সাহিত্যকে এগিয়ে নিতে নিজের সম্পদ ঝুঁকিতে ফেলছেন এডমন্ড উই মৃত্যুহীন প্রসবের লক্ষ্য: ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাফল্য প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩৩২) আমেরিকায় খাদ্যপরামর্শে ফেরত আসছে পুরোনো ‘ফুড পিরামিড’ বিতর্ক সিঙ্গাপুর বায়েনাল ২০২৫: শহরটাই হয়ে ওঠে খোলা একটি আর্ট গ্যালারি হিজাব পরা রেসলিং তারকা নূর ‘ফিনিক্স’ ডায়ানার আগুন থেকে উঠে দাঁড়ানোর গল্প পাকিস্তান আইডলে টপ–১৬–এ রোমাইসা তারিক: “এই শো আমার জীবন পুরো বদলে দিয়েছে”

মৃত্যুহীন প্রসবের লক্ষ্য: ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাফল্য

তামিলনাড়ুর বিভিন্ন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক ও নার্সরা নভেম্বর মাসে নবজাতক পুনরুজ্জীবন প্রটোকল অনুশীলন করেন। সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক ফাউন্ডেশন, সিংহেলথ এবং তামিলনাড়ু স্বাস্থ্য বিভাগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে চেন্নাইয়ে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে এই সিমুলেশন চালানো হয়।

অনলাইন নিবন্ধন ব্যবস্থায় সম্প্রতি একটি মানবিক পরিবর্তন আনা হয়েছে—যদি মায়ের বয়স ১৮ বছরের নিচে হয় বা তিনি স্বামীর নাম উল্লেখ না করেন, তবে তাকে স্থায়ী নয়, অস্থায়ী ডিজিটাল পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। সামাজিক লজ্জা এড়িয়ে আরও বেশি মায়ের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার এই প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ বিশাল স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে ছোট অথচ কার্যকর পরিবর্তনের আরেকটি উদাহরণ।

চেন্নাই – ডা. তেরেস কুবা সদ্য সন্তান জন্ম দেওয়া এক মাকে স্ট্রেচারে শুয়ে থাকতে দেখছিলেন। এক নার্স চিৎকার করে বললেন, তিনি দ্রুত রক্ত হারাচ্ছেন।

কারও কণ্ঠ শোনা গেল, তাঁর রক্তচাপ ও নাড়ির গতি কমছে।

অন্তঃসত্ত্বা-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ (পোস্টপার্টাম হেমোরেজ) বুঝতে পেরে ডা. কুবা নার্সকে অক্সিটোসিন দিতে বলেন, রোগীর জরায়ু ম্যাসাজ করেন এবং রক্তপাত চলছে কি না পরীক্ষা করেন। শেষ পর্যন্ত মায়ের জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়।

স্ট্রেচারে থাকা নারীটি আসলে একটি মানবাকৃতি পুতুল, এবং ঘটনাটি ছিল প্রসূতি-সংক্রান্ত জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রশিক্ষণমূলক একটি মহড়া। কিন্তু তাতেও ডা. কুবার অর্জনের অনুভূতি কম ছিল না।

৩৮ বছর বয়সী এই চিকিৎসক বলেন, “প্রসূতি জরুরি পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষেত্রে আমি সর্বোচ্চ দক্ষ হতে চাই—অভ্যাসই নিখুঁত করে।”

রামনাথপুরম জেলার পারমাকুডি ব্লকের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত একজন মেডিকেল অফিসার হিসেবে তিনি মাতৃমৃত্যু কমানোর জন্য তামিলনাড়ু সরকারের অগ্রগতির সামনের সারিতে কাজ করছেন।

This year, we hope to have zero deaths': India's south makes giving birth  safer - Asia News NetworkAsia News Network

সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্যগোষ্ঠী সিংহেলথ এবং অ-লাভজনক সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক ফাউন্ডেশনের আয়োজনে নভেম্বর মাসের এই প্রশিক্ষণে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা অংশ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণে শেখা জ্ঞান রাজ্যের অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়ার কথা রয়েছে।

ডা. কুবার মতো নিষ্ঠাবান চিকিৎসকেরা তামিলনাড়ুতে প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যু রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় এই রাজ্যে গত এক দশকে মাতৃমৃত্যুর হার ধারাবাহিকভাবে কমেছে—বর্তমানে প্রতি এক লাখ জীবিত জন্মে মৃত্যুর সংখ্যা ৩৫। এটি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোত্তম সাফল্য; কেরালা ও অন্ধ্রপ্রদেশে এই হার ৩০।

তেলেঙ্গানা ও কর্ণাটককে অন্তর্ভুক্ত করলে দক্ষিণ ভারতের পাঁচ রাজ্যে গড় মাতৃমৃত্যু হার দাঁড়ায় ৪২—যা ভারতের জাতীয় গড় ৮৮-এর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।

যদিও মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ ও অসমের মতো রাজ্যে মাতৃমৃত্যুর হার কমছে, তা এখনো ১০০-এর ওপরে।

দক্ষিণের এসব রাজ্যের সাফল্যের মূল রহস্য—মাতৃস্বাস্থ্যকে কেন্দ্র করে দীর্ঘমেয়াদি, ধারাবাহিক ও কাঠামোগত প্রচেষ্টা।

চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যা বাড়ানো, প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র-সরঞ্জাম-অ্যাম্বুলেন্স বৃদ্ধি এবং জনসচেতনতা—সব মিলিয়েই এই সাফল্য এসেছে।

এর পাশাপাশি নারীর শিক্ষার হার, পরিবারে সমর্থন, স্যানিটেশন এবং উন্নত সড়কব্যবস্থার মতো সামাজিক-অর্থনৈতিক সুবিধাও বড় ভূমিকা রেখেছে—যার ভিত্তি তৈরি হয়েছে বহু বছর ধরে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর শাসননীতির মাধ্যমে।

দক্ষিণের বিভিন্ন রাজ্যের কর্মকর্তারা জানান, কম ফলপ্রসূ অঞ্চলেও যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে এবং বিদ্যমান প্রটোকল কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়, তবে আরও অনেক মায়ের জীবন রক্ষা করা সম্ভব। ডা. কুবা বলেন, “আমাদের কেন্দ্রে প্রতি মাসে ১০০-র বেশি প্রসব হয়, এবং উচ্চঝুঁকির পরিস্থিতি নিয়মিতই আসে।”

Nurses trained in neonatal resuscitation - The Hindu

২০২৪ সালে তাঁর জেলায় ২৮ বছর বয়সী এক মহিলার প্রসবকালীন মৃত্যু তাঁকে এখনো ভারাক্রান্ত করে।

তিনি বলেন, “২০২৪ সালে আমরা মাত্র একজন মাকে হারিয়েছি, কিন্তু একটি মৃত্যুও গ্রহণযোগ্য নয়। এবার আমরা শূন্য মৃত্যুর লক্ষ্য নিয়েছি। প্রতিটি জরুরি অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”

২০২৪ সালে দক্ষিণের পাঁচ রাজ্যে জন্মেছে ৩৭ লক্ষের বেশি শিশু। বহু বছরের জন্মহার কমানোর পর এখন রাজ্যগুলো মনোযোগ দিচ্ছে মাতৃমৃত্যু প্রতিরোধে।

২০০২ সাল থেকে কেরালা গোপনীয় মূল্যায়ন পদ্ধতিতে সমস্ত মাতৃমৃত্যুর বিশ্লেষণ করছে—ব্যর্থতার পেছনে থাকা কারণ যেমন চিকিৎসার বিলম্ব বা প্রশিক্ষণের অভাব চিহ্নিত ও সমাধানের জন্য ‘নামহীন-দোষারোপহীন’ পদ্ধতি অনুসরণ করে।

অন্ধ্রপ্রদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রী ওয়াই. সাত্যকুমার জানান, কেন্দ্রীয় তহবিল ব্যবহার করে প্রসূতি কক্ষ উন্নত করা, ব্যস্ত হাসপাতালগুলোতে বিশেষ প্রসব-উইং স্থাপন, এবং গর্ভাবস্থার প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা হয়েছে—যার সুবিধা পাচ্ছেন ৭০ শতাংশ গর্ভবতী নারী।

তামিলনাড়ুর জনস্বাস্থ্য ও প্রতিরোধ চিকিৎসা অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক ডা. জে. নির্মলসন জানান, জাতীয় প্রটোকল যথাযথভাবে বাস্তবায়ন এবং নিজস্ব সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সম্পূরক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তামিলনাড়ু বড় ধরনের অগ্রগতি অর্জন করেছে।

২০০৫ সাল থেকে তামিলনাড়ু হেলথ সিস্টেমস প্রজেক্ট জরুরি প্রসূতি ও নবজাতক সেবা কেন্দ্র গড়ে তুলেছে—যেখানে ২৪ ঘণ্টা বিশেষায়িত কর্মী ও চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে। বর্তমানে ১২০টি সেকেন্ডারি ও ৩৮টি টারশিয়ারি হাসপাতাল এ সেবার আওতায়।

২০২৪ সালে প্রায় ৯ লাখ ৩ হাজার প্রসবের মধ্যে প্রায় ১০০ শতাংশই হাসপাতালে সম্পন্ন হয়েছে।

৭ কোটি ২০ লাখ মানুষের এই রাজ্যে গৃহভিত্তিক নজরদারিও অত্যন্ত কঠোর—যাতে ঘরে প্রসবের প্রবণতা কমে। গর্ভবতী নারীরা পান ১৮ হাজার রুপি ও পুষ্টিকর খাদ্যকিট, যা রক্তাল্পতা প্রতিরোধে সহায়ক। প্রত্যেক নারীকে দেওয়া হয় বিশেষ ডিজিটাল আইডি—যাতে নিয়মিত পরীক্ষা ও উচ্চঝুঁকির তথ্য শনাক্ত করা যায়।

ভারতে প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ—অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, সংক্রমণ এবং উচ্চ রক্তচাপজনিত খিঁচুনি (ইক্ল্যাম্পসিয়া)। তাই চিকিৎসক, নার্স ও ধাত্রীদের বারবার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে—উচ্চঝুঁকির গর্ভাবস্থা শনাক্ত, পরিকল্পনা ও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।

সিংহেলথ ও সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক ফাউন্ডেশন গত এক দশক ধরে তামিলনাড়ুর সঙ্গে যৌথভাবে কর্মশালা চালাচ্ছে। প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্সরা পরে রাজ্যের অন্যদেরও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।

সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী করিনা চ্যান বলেন, “আমাদের বিশেষ জোর ছিল প্রসূতি বিশেষজ্ঞ, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, নার্স ও ধাত্রীদের জরুরি পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করা এবং প্রাথমিক-দ্বিতীয়-তৃতীয় স্তরের সব প্রতিষ্ঠানে প্রটোকল পর্যবেক্ষণ।”

২০১৫-২০১৮ এবং ২০২৩-২০২৫—দুই দফায় সিঙ্গাপুরের কেকে উইমেনস অ্যান্ড চিলড্রেনস হাসপাতাল ও সিংহেলথ পলিক্লিনিকের চিকিৎসকেরা তামিলনাড়ুতে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

CMC Vellore gets simulation lab to train doctors, nurses in maternal and  neonatal care - The Hindu

কেকে হাসপাতালের প্রসূতি ও ভ্রূণ চিকিৎসা বিভাগের সিনিয়র পরামর্শক ডা. শেফালি তাগোর জানান, সিঙ্গাপুরে মাতৃমৃত্যু প্রতি এক লাখে মাত্র ৬—“এর পেছনে কেবল আধুনিক প্রযুক্তি নয়; সিঙ্গাপুরে মায়েরা নিজেরাই সেবার জন্য এগিয়ে আসেন। কিন্তু ভারতে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদেরই মায়েদের বোঝাতে হয় পরীক্ষা করাতে যেতে।”

ভারতে মাতৃমৃত্যুর বড় কারণ হলো—গ্রামীণ বা নিম্নআয়ের নারীরা নিকটস্থ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান, যেখানে সাধারণ প্রসব করা গেলেও জরুরি অস্ত্রোপচারের সক্ষমতা নেই। উচ্চঝুঁকির রোগীকে দ্রুত দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হয়। এই সময়েই মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। তাই তামিলনাড়ু তৈরি করেছে অনন্য ও কার্যকর রেফারেল প্রটোকল।

চেন্নাইয়ের প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ডা. এম. মহালক্ষ্মী বলেন, “প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্বল্প কর্মী—একজন মেডিকেল অফিসার, একজন নার্স ও একজন সহায়ক—প্রথমেই দ্রুত ঝুঁকি শনাক্ত করেন।”

“এরপর রোগীকে স্থিতিশীল করতে করতে তারা নিকটস্থ দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের কেন্দ্রে খবর পাঠান। ফলে অ্যাম্বুলেন্স দ্রুত আসে, এবং হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই চিকিৎসকেরা রক্তের গ্রুপ ও রোগীর ইতিহাস জেনে প্রস্তুত থাকেন। চিকিৎসায় কোনো দেরি হয় না।”

তামিলনাড়ু দীর্ঘদিনের একটি সমস্যার সৃজনশীল সমাধানও করেছে—অপ্রাপ্তবয়স্ক, অবিবাহিত বা তুলনামূলকভাবে বয়স্ক মায়েরা সামাজিক লজ্জায় গর্ভধারণ লুকিয়ে রাখেন। তাই অনলাইন নিবন্ধনে তাদের জন্য স্থায়ী নয়, অস্থায়ী ডিজিটাল আইডি দেওয়া হয়।

সামাজিক লজ্জা এড়িয়ে আরও বেশি নারীর কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার এই ছোট প্রযুক্তিগত পদক্ষেপও নারীর জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

তবুও কাজ শেষ হয়ে যায়নি বলে মনে করেন ডা. নির্মলসন।

তিনি বলেন, “কিছু নারী এখনো আমাদের নজরের বাইরে থাকেন—কারণ তাঁরা সচেতনতার অভাব, কাজের চাপ, বা অন্য সন্তানদের দেখাশোনার কারণে পরীক্ষা করিয়ে উঠতে পারেন না। অনেক সময় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো লোকও থাকে না।”

জনপ্রিয় সংবাদ

২০২৬ সাল থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্মার্টফোন ও স্মার্টওয়াচ ব্যবহার নিষিদ্ধ

মৃত্যুহীন প্রসবের লক্ষ্য: ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাফল্য

০৪:০০:৫৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৫

তামিলনাড়ুর বিভিন্ন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক ও নার্সরা নভেম্বর মাসে নবজাতক পুনরুজ্জীবন প্রটোকল অনুশীলন করেন। সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক ফাউন্ডেশন, সিংহেলথ এবং তামিলনাড়ু স্বাস্থ্য বিভাগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে চেন্নাইয়ে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে এই সিমুলেশন চালানো হয়।

অনলাইন নিবন্ধন ব্যবস্থায় সম্প্রতি একটি মানবিক পরিবর্তন আনা হয়েছে—যদি মায়ের বয়স ১৮ বছরের নিচে হয় বা তিনি স্বামীর নাম উল্লেখ না করেন, তবে তাকে স্থায়ী নয়, অস্থায়ী ডিজিটাল পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। সামাজিক লজ্জা এড়িয়ে আরও বেশি মায়ের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার এই প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ বিশাল স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে ছোট অথচ কার্যকর পরিবর্তনের আরেকটি উদাহরণ।

চেন্নাই – ডা. তেরেস কুবা সদ্য সন্তান জন্ম দেওয়া এক মাকে স্ট্রেচারে শুয়ে থাকতে দেখছিলেন। এক নার্স চিৎকার করে বললেন, তিনি দ্রুত রক্ত হারাচ্ছেন।

কারও কণ্ঠ শোনা গেল, তাঁর রক্তচাপ ও নাড়ির গতি কমছে।

অন্তঃসত্ত্বা-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ (পোস্টপার্টাম হেমোরেজ) বুঝতে পেরে ডা. কুবা নার্সকে অক্সিটোসিন দিতে বলেন, রোগীর জরায়ু ম্যাসাজ করেন এবং রক্তপাত চলছে কি না পরীক্ষা করেন। শেষ পর্যন্ত মায়ের জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়।

স্ট্রেচারে থাকা নারীটি আসলে একটি মানবাকৃতি পুতুল, এবং ঘটনাটি ছিল প্রসূতি-সংক্রান্ত জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রশিক্ষণমূলক একটি মহড়া। কিন্তু তাতেও ডা. কুবার অর্জনের অনুভূতি কম ছিল না।

৩৮ বছর বয়সী এই চিকিৎসক বলেন, “প্রসূতি জরুরি পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষেত্রে আমি সর্বোচ্চ দক্ষ হতে চাই—অভ্যাসই নিখুঁত করে।”

রামনাথপুরম জেলার পারমাকুডি ব্লকের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত একজন মেডিকেল অফিসার হিসেবে তিনি মাতৃমৃত্যু কমানোর জন্য তামিলনাড়ু সরকারের অগ্রগতির সামনের সারিতে কাজ করছেন।

This year, we hope to have zero deaths': India's south makes giving birth  safer - Asia News NetworkAsia News Network

সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্যগোষ্ঠী সিংহেলথ এবং অ-লাভজনক সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক ফাউন্ডেশনের আয়োজনে নভেম্বর মাসের এই প্রশিক্ষণে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা অংশ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণে শেখা জ্ঞান রাজ্যের অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়ার কথা রয়েছে।

ডা. কুবার মতো নিষ্ঠাবান চিকিৎসকেরা তামিলনাড়ুতে প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যু রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় এই রাজ্যে গত এক দশকে মাতৃমৃত্যুর হার ধারাবাহিকভাবে কমেছে—বর্তমানে প্রতি এক লাখ জীবিত জন্মে মৃত্যুর সংখ্যা ৩৫। এটি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোত্তম সাফল্য; কেরালা ও অন্ধ্রপ্রদেশে এই হার ৩০।

তেলেঙ্গানা ও কর্ণাটককে অন্তর্ভুক্ত করলে দক্ষিণ ভারতের পাঁচ রাজ্যে গড় মাতৃমৃত্যু হার দাঁড়ায় ৪২—যা ভারতের জাতীয় গড় ৮৮-এর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।

যদিও মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ ও অসমের মতো রাজ্যে মাতৃমৃত্যুর হার কমছে, তা এখনো ১০০-এর ওপরে।

দক্ষিণের এসব রাজ্যের সাফল্যের মূল রহস্য—মাতৃস্বাস্থ্যকে কেন্দ্র করে দীর্ঘমেয়াদি, ধারাবাহিক ও কাঠামোগত প্রচেষ্টা।

চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যা বাড়ানো, প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র-সরঞ্জাম-অ্যাম্বুলেন্স বৃদ্ধি এবং জনসচেতনতা—সব মিলিয়েই এই সাফল্য এসেছে।

এর পাশাপাশি নারীর শিক্ষার হার, পরিবারে সমর্থন, স্যানিটেশন এবং উন্নত সড়কব্যবস্থার মতো সামাজিক-অর্থনৈতিক সুবিধাও বড় ভূমিকা রেখেছে—যার ভিত্তি তৈরি হয়েছে বহু বছর ধরে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর শাসননীতির মাধ্যমে।

দক্ষিণের বিভিন্ন রাজ্যের কর্মকর্তারা জানান, কম ফলপ্রসূ অঞ্চলেও যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে এবং বিদ্যমান প্রটোকল কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়, তবে আরও অনেক মায়ের জীবন রক্ষা করা সম্ভব। ডা. কুবা বলেন, “আমাদের কেন্দ্রে প্রতি মাসে ১০০-র বেশি প্রসব হয়, এবং উচ্চঝুঁকির পরিস্থিতি নিয়মিতই আসে।”

Nurses trained in neonatal resuscitation - The Hindu

২০২৪ সালে তাঁর জেলায় ২৮ বছর বয়সী এক মহিলার প্রসবকালীন মৃত্যু তাঁকে এখনো ভারাক্রান্ত করে।

তিনি বলেন, “২০২৪ সালে আমরা মাত্র একজন মাকে হারিয়েছি, কিন্তু একটি মৃত্যুও গ্রহণযোগ্য নয়। এবার আমরা শূন্য মৃত্যুর লক্ষ্য নিয়েছি। প্রতিটি জরুরি অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”

২০২৪ সালে দক্ষিণের পাঁচ রাজ্যে জন্মেছে ৩৭ লক্ষের বেশি শিশু। বহু বছরের জন্মহার কমানোর পর এখন রাজ্যগুলো মনোযোগ দিচ্ছে মাতৃমৃত্যু প্রতিরোধে।

২০০২ সাল থেকে কেরালা গোপনীয় মূল্যায়ন পদ্ধতিতে সমস্ত মাতৃমৃত্যুর বিশ্লেষণ করছে—ব্যর্থতার পেছনে থাকা কারণ যেমন চিকিৎসার বিলম্ব বা প্রশিক্ষণের অভাব চিহ্নিত ও সমাধানের জন্য ‘নামহীন-দোষারোপহীন’ পদ্ধতি অনুসরণ করে।

অন্ধ্রপ্রদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রী ওয়াই. সাত্যকুমার জানান, কেন্দ্রীয় তহবিল ব্যবহার করে প্রসূতি কক্ষ উন্নত করা, ব্যস্ত হাসপাতালগুলোতে বিশেষ প্রসব-উইং স্থাপন, এবং গর্ভাবস্থার প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা হয়েছে—যার সুবিধা পাচ্ছেন ৭০ শতাংশ গর্ভবতী নারী।

তামিলনাড়ুর জনস্বাস্থ্য ও প্রতিরোধ চিকিৎসা অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক ডা. জে. নির্মলসন জানান, জাতীয় প্রটোকল যথাযথভাবে বাস্তবায়ন এবং নিজস্ব সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সম্পূরক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তামিলনাড়ু বড় ধরনের অগ্রগতি অর্জন করেছে।

২০০৫ সাল থেকে তামিলনাড়ু হেলথ সিস্টেমস প্রজেক্ট জরুরি প্রসূতি ও নবজাতক সেবা কেন্দ্র গড়ে তুলেছে—যেখানে ২৪ ঘণ্টা বিশেষায়িত কর্মী ও চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে। বর্তমানে ১২০টি সেকেন্ডারি ও ৩৮টি টারশিয়ারি হাসপাতাল এ সেবার আওতায়।

২০২৪ সালে প্রায় ৯ লাখ ৩ হাজার প্রসবের মধ্যে প্রায় ১০০ শতাংশই হাসপাতালে সম্পন্ন হয়েছে।

৭ কোটি ২০ লাখ মানুষের এই রাজ্যে গৃহভিত্তিক নজরদারিও অত্যন্ত কঠোর—যাতে ঘরে প্রসবের প্রবণতা কমে। গর্ভবতী নারীরা পান ১৮ হাজার রুপি ও পুষ্টিকর খাদ্যকিট, যা রক্তাল্পতা প্রতিরোধে সহায়ক। প্রত্যেক নারীকে দেওয়া হয় বিশেষ ডিজিটাল আইডি—যাতে নিয়মিত পরীক্ষা ও উচ্চঝুঁকির তথ্য শনাক্ত করা যায়।

ভারতে প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ—অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, সংক্রমণ এবং উচ্চ রক্তচাপজনিত খিঁচুনি (ইক্ল্যাম্পসিয়া)। তাই চিকিৎসক, নার্স ও ধাত্রীদের বারবার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে—উচ্চঝুঁকির গর্ভাবস্থা শনাক্ত, পরিকল্পনা ও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।

সিংহেলথ ও সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক ফাউন্ডেশন গত এক দশক ধরে তামিলনাড়ুর সঙ্গে যৌথভাবে কর্মশালা চালাচ্ছে। প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্সরা পরে রাজ্যের অন্যদেরও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।

সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী করিনা চ্যান বলেন, “আমাদের বিশেষ জোর ছিল প্রসূতি বিশেষজ্ঞ, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, নার্স ও ধাত্রীদের জরুরি পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করা এবং প্রাথমিক-দ্বিতীয়-তৃতীয় স্তরের সব প্রতিষ্ঠানে প্রটোকল পর্যবেক্ষণ।”

২০১৫-২০১৮ এবং ২০২৩-২০২৫—দুই দফায় সিঙ্গাপুরের কেকে উইমেনস অ্যান্ড চিলড্রেনস হাসপাতাল ও সিংহেলথ পলিক্লিনিকের চিকিৎসকেরা তামিলনাড়ুতে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

CMC Vellore gets simulation lab to train doctors, nurses in maternal and  neonatal care - The Hindu

কেকে হাসপাতালের প্রসূতি ও ভ্রূণ চিকিৎসা বিভাগের সিনিয়র পরামর্শক ডা. শেফালি তাগোর জানান, সিঙ্গাপুরে মাতৃমৃত্যু প্রতি এক লাখে মাত্র ৬—“এর পেছনে কেবল আধুনিক প্রযুক্তি নয়; সিঙ্গাপুরে মায়েরা নিজেরাই সেবার জন্য এগিয়ে আসেন। কিন্তু ভারতে কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদেরই মায়েদের বোঝাতে হয় পরীক্ষা করাতে যেতে।”

ভারতে মাতৃমৃত্যুর বড় কারণ হলো—গ্রামীণ বা নিম্নআয়ের নারীরা নিকটস্থ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান, যেখানে সাধারণ প্রসব করা গেলেও জরুরি অস্ত্রোপচারের সক্ষমতা নেই। উচ্চঝুঁকির রোগীকে দ্রুত দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হয়। এই সময়েই মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। তাই তামিলনাড়ু তৈরি করেছে অনন্য ও কার্যকর রেফারেল প্রটোকল।

চেন্নাইয়ের প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ডা. এম. মহালক্ষ্মী বলেন, “প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্বল্প কর্মী—একজন মেডিকেল অফিসার, একজন নার্স ও একজন সহায়ক—প্রথমেই দ্রুত ঝুঁকি শনাক্ত করেন।”

“এরপর রোগীকে স্থিতিশীল করতে করতে তারা নিকটস্থ দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্তরের কেন্দ্রে খবর পাঠান। ফলে অ্যাম্বুলেন্স দ্রুত আসে, এবং হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই চিকিৎসকেরা রক্তের গ্রুপ ও রোগীর ইতিহাস জেনে প্রস্তুত থাকেন। চিকিৎসায় কোনো দেরি হয় না।”

তামিলনাড়ু দীর্ঘদিনের একটি সমস্যার সৃজনশীল সমাধানও করেছে—অপ্রাপ্তবয়স্ক, অবিবাহিত বা তুলনামূলকভাবে বয়স্ক মায়েরা সামাজিক লজ্জায় গর্ভধারণ লুকিয়ে রাখেন। তাই অনলাইন নিবন্ধনে তাদের জন্য স্থায়ী নয়, অস্থায়ী ডিজিটাল আইডি দেওয়া হয়।

সামাজিক লজ্জা এড়িয়ে আরও বেশি নারীর কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার এই ছোট প্রযুক্তিগত পদক্ষেপও নারীর জীবন বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

তবুও কাজ শেষ হয়ে যায়নি বলে মনে করেন ডা. নির্মলসন।

তিনি বলেন, “কিছু নারী এখনো আমাদের নজরের বাইরে থাকেন—কারণ তাঁরা সচেতনতার অভাব, কাজের চাপ, বা অন্য সন্তানদের দেখাশোনার কারণে পরীক্ষা করিয়ে উঠতে পারেন না। অনেক সময় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো লোকও থাকে না।”