এপিগ্রাম লিটারারি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এডমন্ড উই বহুদিন ধরেই সিঙ্গাপুরের বই শিল্পের অন্যতম উদ্ভাবনী ব্যক্তিত্ব। পরিবর্তিত পাঠাভ্যাস, ডিজিটালের দিকে ঝোঁক এবং ব্যয়বহুল পরিচালন খরচের সময়েও তিনি সিঙ্গাপুর সাহিত্য (সিঙ্গ লিট) প্রচারে নতুন পথ খুঁজেছেন।
এপিগ্রাম প্রতিষ্ঠার ধরন বদলে ফাউন্ডেশনে রূপ দেওয়া, লন্ডনে অফিস খোলা এবং স্বাধীন বইয়ের দোকানগুলোর সঙ্গে অনলাইন বুকশপ চালুর মতো নানা সিদ্ধান্তে তিনি সব সময়ই প্রচলিত ধারা ভেঙেছেন।
সাম্প্রতিক এক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি—যা সিঙ্গ লিট-কে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচটি বড় বাজারে নিয়ে যাবে—সম্পন্ন করার পর তিনি বললেন, “টাকা কামাতে চাই না তা নয়, কিন্তু যদি শুরুতেই টাকার কথা না ভাবি?”
অক্টোবরে ফ্রাঙ্কফুর্ট বুক ফেয়ারে তিনি এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন। মালয়েশিয়ার দ্য বিবলিও প্রেস, ইন্দোনেশিয়ার ইলেক্স মিডিয়া কোমপুটিন্ডো, থাইল্যান্ডের রিভার বুকস, ফিলিপাইনের মিলফ্লোরেস পাবলিশিং এবং মিয়ানমারের NDSP বুকস—এই পাঁচ প্রকাশককে তিনি রাজি করান যে তারা ২০২৮ সাল পর্যন্ত (ফিলিপাইন ২০৩০ পর্যন্ত) প্রতি বছর এপিগ্রাম বুকস ফিকশন প্রাইজ বিজয়ী চারটি করে উপন্যাস প্রকাশ করবে।
বই বিতরণের দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধানও তিনি ভিন্নভাবে করেছেন—নিজস্ব বিতরণ চ্যানেল আছে এমন আঞ্চলিক অংশীদারদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়ে।
এমনকি যেসব পাণ্ডুলিপি তারা পড়েও দেখেনি, সেগুলো প্রকাশে প্রকাশকদের রাজি করাতে তাকে বড় অঙ্কের অগ্রিম ব্যয় নিজের কাঁধে নিতে হয়েছে। সাধারণত যে বিতরণ-অধিকার ফি প্রকাশকদের দিতে হয়, এপিগ্রাম তা মাফ করে দিয়ে বিক্রি হওয়া প্রতিটি বইয়ের ওপর বেশি রয়্যালটির ব্যবস্থা করেছে। এডমন্ড উই বলেন, এটি একটি বৃহত্তর উদ্দেশ্যের জন্য নেওয়া ঝুঁকি।
তার ভাষায়, “আমি বুঝলাম—আগে পাঠক তৈরি করতে হবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যদি মাত্র ১০ শতাংশ মানুষও ইংরেজি পড়ে, তা হলে সেটা ৭ কোটি মানুষ। আমাদের একে অন্যকে জানতে হবে। কীভাবে জানব? একে অন্যের গল্প পড়ে।”
২০১১ সালে এপিগ্রাম বুকস প্রতিষ্ঠার পর থেকে সিঙ্গ লিট নিয়ে তিনি এমন বহু সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ছোট বাজার, সীমিত পাঠকসংখ্যা, ডিজিটাল পরিবর্তন এবং ব্যয়বহুল খরচের চাপে থাকা এই খাতে তিনি বারবার নতুন পথ তৈরি করেছেন। মেইহান বোয়ের “মিস ক্যাসিডি” সিরিজের বইগুলো ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, আলবেনিয়া ও ইতালিতে নিয়ে যাওয়ার সাফল্যও তার নেতৃত্বে এসেছে।
এই অবদানের জন্য তিনি স্ট্রেইটস টাইমসের ১১তম সিঙ্গাপুরিয়ান অব দ্য ইয়ার (SOTY) পুরস্কারের পাঁচ ফাইনালিস্টের একজন।
তিনি সিঙ্গাপুর বুক পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও—৬৭ সদস্যের এই সংগঠনকে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এটি একটি কঠিন কাজ, তবু পুরো শিল্পকে দেখার মানসিকতা থেকেই তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন।
তিনি বলেন, “খুব কম মানুষই নিজেদের সংস্থার বাইরে বড় করে ভাবতে চায় বা পারে। অথচ তা জরুরি। প্রকাশনার জন্য অনেক কিছু করার আছে। কেউ না কেউ সমস্যাগুলো বলতে হবে।”
তিনি সিঙ্গাপুরের লাইব্রেরিগুলোকে প্রকাশিত বইয়ের বেশি কপি কেনার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। সেই সঙ্গে ‘পাবলিক লেন্ডিং রাইটস’ চালুর দাবি তুলেছেন—যেখানে বই ধার দেওয়া হলে লেখক পারিশ্রমিক পাবেন। প্রায় ৩৫টি দেশে এই ব্যবস্থা চালু আছে।
স্থানীয় ভাষার প্রকাশকদের জন্য আরও কাঠামোগত সহায়তার প্রয়োজনীয়তার কথাও তিনি সরকারকে জানাচ্ছেন। তার হিসাব অনুযায়ী, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চুক্তি ইংরেজি বইয়ের প্রিন্ট রান ১,০০০ কপি থেকে কয়েকগুণ বাড়াবে, কিন্তু মালয় ও তামিল প্রকাশকদের প্রথম মুদ্রণ সাধারণত মাত্র ৩০০ থেকে ৫০০ কপি। এতে টিকে থাকা কঠিন। “না হলে ধরে নিতে হবে—বাজারের নিয়মেই তারা হারিয়ে যাবে।”
সবচেয়ে বড় স্বপ্ন—একটি আসিয়ান সাহিত্য পুরস্কারের জন্য বড় আকারে তহবিল গঠন। ৭০০ মিলিয়ন মানুষের এশিয়ার এই অঞ্চলে কোনো নোবেলজয়ী সাহিত্যিক নেই—এর একটি কারণ হলো আঞ্চলিক ভাষার বইগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ ও প্রচারে কোনো বড় উদ্যোগ নেই।
তার প্রস্তাব—প্রতিটি দেশ ১০ থেকে ১৫ লাখ ডলার তহবিল গঠন করবে। অনেক দেশ আগ্রহ দেখালেও প্রকাশনার অধিকার কিংবা অনুবাদের খরচ কে দেবে—এসব খুঁটিনাটি নিয়ে দ্বিধা আছে। উই-এর উত্তর, “আগে রাজি হোন, পরে বিস্তারিত আলোচনা হবে। সব সমাধান করা যায়।”
২০২২ সালে তার তৃতীয় ধাপের প্রোস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়লেও সিঙ্গ লিট প্রচারের কাজ থেমে যায়নি। তিনি বই প্রকাশ করেছেন, ফিকশন প্রাইজ চালু রেখেছেন, শিশুতোষ বই উৎসব শুরু করেছেন, তহবিল সংগ্রহ করেছেন। এখন তার ক্যান্সার মার্কার কমে গেছে, যদিও তিনি পুরোপুরি সুস্থ নন।
কেন এত বাধা সত্ত্বেও এগিয়ে যান? তার উত্তর—“যা সত্যিকারভাবে বদলাতে পারে, সেটাই করতে চাই।” যখন অন্য প্রকাশকরা বছরে ৬টি বই প্রকাশে নেমে এসেছে, তিনি বছরে ২৫-৩০টি নতুন বই আনছেন।
এপিগ্রাম বুকস ফিকশন প্রাইজ এখনো অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার—২৫ হাজার ডলার পুরস্কার ও প্রকাশনার চুক্তিসহ—এবং এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লেখকদের জন্যও উন্মুক্ত।
তিনি বলেন, “বছরের পর বছর হয়তো কয়েক মিলিয়ন ডলার হারিয়েছি, কিন্তু ঋণ নেই।”
যদি তিনি SOTY-এর ২০ হাজার ডলারের পুরস্কার জিতেন, তার বেশিরভাগই যাবে এপিগ্রামে।
ডিজাইন ব্যবসা ছেড়ে প্রকাশনার জগতে আসার পেছনের অনুভূতিটা তিনি এখনো মনে রাখেন: “আপনি বার্ষিক রিপোর্টের সেরা ডিজাইন করতে পারেন, বিদেশে পুরস্কার জিততে পারেন। কিন্তু তাতে কী বদলায়?
একটি ভালো বই প্রকাশ করলে—তা চিরকাল টিকে থাকবে।”
ক্লেমেন্ট ইয়ং 


















