ভবিষ্যৎ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলাতে ভারতকে কী ধরনের কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে? কোন কোন সম্পদ তার হাতে আছে এবং কোন সীমাবদ্ধতাগুলো তাকে মোকাবিলা করতে হবে—এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই ভারতের অগ্রযাত্রার ভিত্তি তৈরি করবে। দেশের সামগ্রিক সম্পদ ও দুর্বলতাকে সামনে রেখে এগোনোর মধ্যেই আছে উন্নতির পথ।
বিশ্বপরিস্থিতির ট্রেন্ড: প্রধান চালিকাশক্তি প্রযুক্তি
বিশ্বের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, তবে একটি বিষয় স্পষ্ট—প্রযুক্তিই আগামী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও রাষ্ট্রীয় শক্তির মূল ভিত্তি হবে। ভারতের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত জনবল বিপুল এবং ক্রমবর্ধমান। তবে মহাকাশ কর্মসূচি, ডিজিটাল স্ট্যাক বা গ্লোবাল ক্যাপাবিলিটি সেন্টারের মতো কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দেশজুড়ে এখনো এমন কোনো পরিপূর্ণ ইকোসিস্টেম তৈরি হয়নি, যা এই মানবসম্পদকে সর্বোচ্চ মাত্রায় কাজে লাগাতে পারে।
বর্তমান নীতিতে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন জনবলের বিদেশগমনের প্রবণতাই বেশি দেখা যায়, যা দেশের আধুনিকায়ন ও সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য যথেষ্ট সহায়ক নয়। অথচ যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশে ভারতীয় বংশোদ্ভূত দক্ষ জনবল বৈশ্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে—যাদের অনেকেই বিদেশে বৈষম্য বা শত্রুভাবাপন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। এই সংকটই হতে পারে ভারতের সুযোগ—তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে উন্নয়নযাত্রায় যুক্ত করা যেতে পারে। ভবিষ্যতের লক্ষ্য হওয়া উচিত দক্ষ জনবলের দেশে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা।

উন্নত প্রযুক্তি অর্জনে আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব
ভারতের উন্নয়নধারায় অগ্রসর প্রযুক্তিসম্পন্ন দেশগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্ব অপরিহার্য। তবে এ ক্ষেত্রে ইতিহাসের শিক্ষাকে বিবেচনায় রাখা জরুরি। উন্নয়নশীল দেশগুলো সাধারণত তিন ধাপ অতিক্রম করে—প্রথমে উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণ, পরে তা শিখে আত্মস্থ করা, এবং শেষে নিজস্ব জ্ঞান উৎপাদনে সক্ষম হওয়া। অতীতের বৈজ্ঞানিক সাফল্য অনুপ্রেরণা হতে পারে, কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জনের বিকল্প নেই।
যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলেও প্রযুক্তিগত দিক থেকে দেশটি এখনো বিশ্বের শীর্ষে। তাই ভারত-যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তি অংশীদারত্ব বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে অংশীদারত্বও উন্নত প্রযুক্তি অর্জনে সহায়তা করবে। বিশেষ ক্ষেত্রে রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবেই থাকবে। আর পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তিতে চীন এখন বড় শক্তি—সম্পর্কে সতর্কতার প্রয়োজন থাকলেও সুযোগগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে।
ভারতের স্থিতিশীলতা: একটি বড় সুবিধা
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মতো পরিণত গণতন্ত্রগুলো রাজনৈতিক বিভাজন ও অস্থিরতায় ভুগলেও ভারত দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রেখেছে। গণতন্ত্র কিছু চাপে থাকলেও ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে—যা ভারতের জন্য বড় শক্তি।
যদিও মাথাপিছু আয় এখনো কম, তবে বৈশ্বিক অর্থনীতি মন্থর হওয়ার পরও ধারাবাহিক ৬-৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ভারতকে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির অবস্থানে রেখেছে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় ভারতকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। জলবায়ু পরিবর্তন বা মহামারীর মতো বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায়ও ভারতের অংশগ্রহণ অনিবার্য।
ডিজিটাল জনপরিকাঠামো: বৈশ্বিক সম্পদ হিসেবে ভারতের সুযোগ
ভারতের ডিজিটাল পাবলিক ইন্সট্রাকচার ইতোমধ্যে একটি বৈশ্বিক সম্পদে পরিণত হয়েছে, যা উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার বড় সুযোগ তৈরি করছে।

পড়োশি সম্পর্ক: চ্যালেঞ্জ নাকি সম্ভাবনা?
অনেক বিশ্লেষক ভারতের প্রতিবেশীকেই দায় হিসেবে দেখেন। উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ও সামরিকভাবে শক্তিশালী দেশ হওয়ায় ছোট দেশগুলো ভারতের প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। তাই তারা চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তির দিকে ঝুঁকে ভারতের প্রভাব মোকাবিলা করতে চায়। পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট উদাহরণ—চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে ভারতের জন্য দুই-মুখী নিরাপত্তা চাপ সৃষ্টি করছে, যা সাম্প্রতিক ‘অপারেশন সিন্ধুর’-এও দেখা গেছে। চীন পাকিস্তানকে সামরিক ভারসাম্য ধরে রাখতে সব রকম সহায়তা দেবে—এটাই বাস্তবতা।
প্রতিবেশী নীতিতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন
শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর জোর দিলে ভারতের দুর্বলতা আরও বাড়তে পারে। এর বদলে আঞ্চলিক সংহতির ধারণাকে সামনে এনে প্রতিবেশীদের কাছে ভারতের অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করতে হবে। এতে ভারতের খরচ সামান্য হলেও পুরো অঞ্চলের প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন হয়ে উঠতে পারে ভারত। বিস্তৃত যোগাযোগব্যবস্থা, আঞ্চলিক ট্রানজিট এবং জ্বালানি সহযোগিতা বাড়ালে প্রতিবেশীরা ভারতের অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কের অংশ হয়ে উঠবে। BBIN কাঠামোর পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের বাইরেও দক্ষিণ এশিয়ার জ্বালানি কেন্দ্র হতে পারে ভারত।
প্রতিবেশীরা কোনো বাধা নয়—বরং বড় সুযোগ। পাকিস্তানের সঙ্গে ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য সম্পর্ক বজায় রাখাও ভবিষ্যতের কৌশলে বিবেচনায় রাখা জরুরি, যদিও বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে তা কঠিন।
লেখক: শান্তনু শরণ, ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















