বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি আসনে এবার প্রথমবারের মতো একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী।
খুলনার দাকোপ ও বটিয়াঘাটা নিয়ে গঠিত খুলনা-১ আসনে কৃষ্ণ নন্দীকে এই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
মি. নন্দী বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, তিনি ডুমুরিয়া উপজেলা জামায়াতের হিন্দু কমিটির সভাপতি।
গত নয়ই ফেব্রুয়ারি খুলনার ছয়টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে দলটি। বাকি পাঁচ আসনে প্রার্থীর ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন না আসলেও পহেলা ডিসেম্বর কেবলমাত্র খুলনা-১ এর এই আসনটিতেই পূর্বঘোষিত প্রার্থী পরিবর্তন করে মি. নন্দীকে মনোনয়ন দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
ওই আসনে প্রথমে প্রার্থী হিসেবে দলটির স্থানীয় নেতা আবু ইউসুফের নাম ঘোষণা করা হয়েছিলো।
ফলে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিয়ে ঠিক কী বার্তা দিতে চাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী?
দলটির রাজনৈতিক স্ট্রাটেজিতে কোনো ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে কি না বা আর কোনো আসনে ভিন্নধর্মের কাউকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হবে কি না এসব প্রশ্নও সামনে আসছে।
এদিকে, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং মিডিয়া বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, আরো কয়েকটি সংসদীয় আসনে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
এরই মধ্যে কিশোরগঞ্জের একটি আসনে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী কোনো ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং অন্য আরো দুই-একটি আসনেও ছয়-সাতজনের নামের প্রস্তাব আলোচনার টেবিলে রয়েছে বলে জানিয়েছেন মি. জুবায়ের।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন। তারা বলছেন, জামায়াতে ইসলামী নিজেদের রাজনীতিতে একটি উদারনৈতিক ধারা আনার চেষ্টা করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করার যে রাজনৈতিক কৌশল এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতের মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য দেখছি না”।
অন্যদিকে, বিএনপি বৃহস্পতিবার খুলনা-১ আসনে প্রার্থী হিসেবে আমির এজাজ খানকে মনোনয়ন দিয়েছে।

মি. নন্দী বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, তিনি ডুমুরিয়া উপজেলা জামায়াতের হিন্দু কমিটির সভাপতি।
কেন হিন্দু প্রার্থী ঘোষণা জামায়াতের?
খুলনার আট দলীয় বিভাগীয় সমাবেশে গত পহেলা ডিসেম্বর কৃষ্ণ নন্দীকে মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান।
পরে বুধবার দুপুরে ওই জেলার স্থানীয় নেতাদের সভায় এ বিষয়টি পর্যালোচনা করা হয়।
পরে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন দেওয়া হয় বলে ওইদিনই সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বিষয়টি নিশ্চিত করেন খুলনা জেলা জামায়াতের আমির ইমরান হোসেন।
মনোনয়ন পাওয়া কৃষ্ণ নন্দী বিবিসি বাংলার কাছে দাবি করেন, ২০০৩ সালে এক হাজার টাকা দিয়ে জামায়াতে ইসলামের ফরম পূরণ করে সদস্য হন তিনি।
পেশায় ব্যবসায়ী মি. নন্দী বলেন, দলটিতে হঠাৎ করে আবির্ভাব ঘটেনি তার। তিনি মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্যাতন-নিপীড়ন করে তার দলকে দমন করে রাখা হয়েছিলো।
ফলে তখন সেভাবে জামায়াতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রাজনীতি সেভাবে আলোচনায় আসেনি।
মি. নন্দী বলেন, “জামায়াতে ইসলাম চায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই একইসাথে দল করবে। এই হিসেবে তারা আমাকে হিন্দু প্রার্থী হিসেবে ওখানে মনোনয়ন দিয়েছে।”
এদিকে, জামায়াতে ইসলামীর নেতা মি. জুবায়ের জানান, ২০০৮ সালে যখন গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ আদেশ বা আরপিও হয়, তখন প্রায় বেশিরভাগ দলই তাদের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন করেছে।
“আমরাও করেছি। সেখানে অন্যান্য ধর্মের লোকও জামায়াতে ইসলামকে সমর্থন করতে পারে, সদস্য হতে পারে এই অপশনটা আমরা রেখেছি। এর আলোকেই আমরা বিভিন্ন ধর্মের যারা আছেন তাদের আমাদের সাথে একোমডেট করছি,” বলেন মি. জুবায়ের।
তিনি দাবি করেন, প্রতিটি আসনে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের পরামর্শ, তৃণমূল সংগঠনের মতামত এবং সার্ভে পরিচালনা করে জয়ের সম্ভাব্যতা নিয়ে নীতি – নির্ধারণী ফোরামে আলোচনা করে দলটি প্রার্থী মনোনয়ন দেয়।
“সামগ্রিকভাবে আমরা চেষ্টা করি সেখানে (নির্দিষ্ট আসন) কাকে দিলে কে পাস করবে, কার জনপ্রিয়তা আছে, জনগণ কাকে চায় এই অগ্রাধিকার আমরা দেই। তৃণমূল থেকেও পরামর্শ নেই আমরা। আগে এই সুযোগটা কম ছিল,” বলে মনে করেন তিনি।
এই জামায়াত নেতা বলেন, “জনগণের প্রত্যাশা বেড়েছে আমাদের ব্যাপারে, আমাদের তৃণমূল পর্যায় থেকেও এই বিষয়গুলো আসতেছে, এই কারণেই আমরা খুলনায় প্রার্থী পরিবর্তন করেছি। সেখানে এই ভদ্রলোক অত্যন্ত জনপ্রিয়।”

খুলনায় জামায়াতের ‘হিন্দু সম্মেলনে’ দলটির দাঁড়িপাল্লা প্রতীক হাতে একজন সমর্থক, গতমাসের ছবি
ওই আসনকেই কেন বেছে নেওয়া হলো?
খুলনায় গত কয়েক মাস ধরে জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশে এরই মধ্যে মি. নন্দীকে দেখা গেছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচনাও হয়েছে।
সবশেষে গত সপ্তাহ তিনেক আগে, খুলনা – ৫ আসনে (ফুলতলা ও ডুমুরিয়া) দলটির আরেক প্রার্থী মিয়া গোলাম পরওয়ারের বিভিন্ন সমাবেশে মি. নন্দীর উপস্থিতি নিয়ে বেশ আলোচনাও হয়।
এদিকে, যে দুইটি উপজেলা নিয়ে খুলনা-১ আসনটি গঠিত সেই এলাকাগুলো মূলত হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা।
নির্বাচনী ভোট ব্যাংকের হিসেবে এই এলাকার ভোটার সংখ্যা বেশ বড় বলে জানান দলটির নেতারা।
ওই আসনের নির্বাচনী পরিসংখ্যানেও প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রায় বেশিরভাগ নির্বাচনেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হিন্দু নেতারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
এদিকে, বুধবার খুলনা-১ আসনে দলটির পূর্বঘোষিত প্রার্থীর পরিবর্তে মি. নন্দীকে নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া চূড়ান্ত করে দলটির স্থানীয় বোর্ড।
মি. নন্দী জানান, আগের প্রার্থী দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইতোমধ্যেই তার পক্ষে নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
“এখানে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। তারপরে আমি সনাতন ধর্মের মানুষ। যে প্রার্থী ছিলেন তিনিও এখন আমার হয়ে কাজ করবেন। আমার নির্বাচন পরিচালক, উনি আমার পক্ষে সব কাজ করছেন। মানে গতকালকে আমাদের সভায় সিদ্ধান্ত হলে সেই থেকেই তিনি কাজে লেগে পড়েছেন,” বলেন মি. নন্দী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের ওই এলাকার নির্বাচনের জয়ের ইতিহাসে বেশিরভাগই হিন্দু নেতাদের নাম রয়েছে।
এই আসনে এতোদিন আওয়ামী লীগের আধিপত্যই দেখা গেছে, কেননা তারা হিন্দু সম্প্রদায়কে ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করেছে বলে উল্লেখ করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ।
আওয়ামী লীগের মতো এখন জামায়াতে ইসলামীও এই হিন্দু ভোট ব্যাংকটি ব্যবহার করার জন্য মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে একজন হিন্দুকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন মি. আহমদ।
“অর্থাৎ হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করার যে রাজনৈতিক কৌশল এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতের মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য দেখছি না,” বলেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

গত বছর আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই দেশের বিভিন্ন আলেম-উলামা ও সমমনাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছে জামায়াত, ২০২৪ সালের অগাস্টের ছবি
জামায়াতে ইসলামী কী বার্তা দিতে চাচ্ছে?
জামায়াত একটি ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল, যেখানে মুসলিম ধর্ম বিশ্বাস এবং ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা গুরুত্বপূর্ণ।
দলটির উপরের স্তরে উঠতে কিংবা নেতৃত্বে জায়গা পেতে ধর্মীয় বিষয়গুলো মূল ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার প্রায় ১০ শতাংশ। বিভিন্ন আসনে নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে সংখ্যালঘু ভোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
পাঁচই অগাস্ট পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ থাকায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভোট কোন দিকে যাবে সেটা একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
তবে অনেকেই মনে করেন, সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিএনপির অবস্থান থাকলেও ইসলামপন্থি দল হওয়াসহ ঐতিহাসিক বিভিন্ন কারণে জামায়াত সেখানে সুবিধাজনক অবস্থানে নেই।
ফলে গত কয়েক মাসেই অমুসলিম সমর্থক বৃদ্ধিতে জোর দিতে দেখা গেছে জামায়াতকে, তার একটা বড় কারণ এই সংখ্যালঘু ভোটার আকৃষ্ট করা।
নভেম্বর মাসের শুরুতে খুলনায় শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে জামায়াতের যে ‘হিন্দু সম্মেলন’ হয়েছে, সেটাও ছিল মূলত নির্বাচনী জনসভা। যেখানে জামায়াতের প্রার্থীর পক্ষে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে অংশ নিতে দেখা যায়।
গেল বছর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।
পাঁচই অগাস্টের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদগুলোতে শিবিরের প্রার্থীদের জয়লাভ উল্লেখযোগ্য ছিল।
ডাকসুতে শিবির প্যানেল থেকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির সর্বমিত্র চাকমাকে মনোনয়ন দেওয়া হলে জয়লাভ করেন তিনি।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, “অন্য ধর্ম, বর্ণ, মতের যারা আছে তাদের সম্মান করা এবং দেশ, জাতি ও সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণটাকেও নিশ্চিত করা আমরা এই দৃষ্টিভঙ্গি আগেও রেখেছি, এখন যেহেতু সুযোগ এসেছে তাই সেটাকেই আমরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ মনে করেন, জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ধারা পরিবর্তনের যে ইঙ্গিত, তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনেও দেখা গেছে।
“জামায়াত তাদের পলিটিকসে বা পলিটিকেল কালচারে একটা লিবারেল বা উদার নৈতিক ধারা তৈরির চেষ্টা করছে, যেহেতু তারা একটা ইসলামভিত্তিক রাজনীতি করে। এই সিদ্ধান্তের ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে,” বলেন মি. আহমেদ।
বিবিসি নিউজ বাংলা
জান্নাতুল তানভী 


















