০৪:০২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫
ডায়ানা ড্যানিয়েলের জন্য একটি নতুন সকাল প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩৩৭) বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও ২০২৫ সালে প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার চেয়ে ভালো প্যারিস থেকে তেঙ্গাহ: একটি ফরাসি রেট্রো থিমের বাসা অন্ধকার ভ্রমণের উত্থান: অতীতের ক্ষত দেখতেই কেন বাড়ছে পর্যটকের ভিড় সেনেগালে দুর্নীতি দমন না রাজনৈতিক প্রতিশোধ? ফায়ে–সোঙ্কো সরকারের কড়াকড়িতে বিতর্ক তুঙ্গে মরক্কোর দাখলা অ্যাটলান্টিক বন্দর: আফ্রিকা-সাহেল বাণিজ্যের নতুন প্রবেশদ্বার বিশ্বের ৯৯% চিপ প্রযুক্তির নায়ক: সেমিকন্ডাক্টর কিংবদন্তি চি-তাং সা’র অস্থি চীনে সমাহিত রাশিয়ায় নির্বাসন থেকে সিরীয় উপকূলে নতুন বিদ্রোহের ছক আঁকছেন আসাদের সাবেক গুপ্তচরপ্রধান ও কোটিপতি চাচাতো ভাই সপ্তাহের শুরুতেই শেয়ারবাজারে সূচকপতন

পাকিস্তানের “ ডনের প্রতিবেদন” : বাংলাদেশি জঙ্গীরা পাকিস্তানে, অবৈধ পথে ভারত হয়ে যাচ্ছে

ফয়সাল হোসেন পরিবারকে জানিয়েছিলেন যে তিনি দুবাইয়ে কাজ পেয়েছেন। বাস্তবেমাদারীপুরের এই ২২ বছর বয়সী যুবক ঢাকার প্রায় ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণের এক গ্রাম থেকে উঠে গিয়ে পাকিস্তানের নিষিদ্ধ সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-এর হয়ে যুদ্ধ করছিলেন। এই সংগঠনটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ চালিয়ে তাদের নিজস্ব শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে।

২০২৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরখাইবার পাখতুনখোয়ার করাক জেলায় এক অভিযানে পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী ফয়সালকে হত্যা করে। গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া লাশের ছবিতে তার ভাই আরমান তাকে শনাক্ত করেন।

ফয়সাল হোসেন এখন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে নিহত হওয়া অন্তত চার বাংলাদেশির একজনযারা পাকিস্তানে টিটিপির হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। বাংলাদেশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের তথ্য অনুযায়ীআরও অন্তত দুই ডজন বাংলাদেশি পাকিস্তানে অবস্থান করছেন এবং টিটিপি ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে লড়াই করছেন। ২০২৩ সাল থেকে এই প্রবণতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে এবং এটি ঢাকার নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর জন্য গুরুতর উদ্বেগের কারণ।

২২ বছর বয়সী দ্বিতীয় বাংলাদেশি যুবকজুবায়ের আহমেদএপ্রিল ২০২৫-এ নিহত হয়েছেন বলে পরিবার জানায়। তার মা আলেয়া আক্তার জানানএপ্রিলের শেষে একটি অজানা নম্বর থেকে ফোন আসে এবং বলা হয়তার ছেলে আর নেই।

একটি ভয়ংকর স্রোত: পাকিস্তানের চরমপন্থী সংগঠনে যোগ দিচ্ছে ডজন ডজন বাংলাদেশি তরুণ। তাদের এই অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক একটি নতুন রপ্তানি এবং দক্ষিণ এশিয়ার সশস্ত্র জঙ্গিবাদের মানচিত্রে বিস্ময়কর এক পরিবর্তন।

রাতান ধলির অনিশ্চিত পরিণতি
বাংলাদেশের ২৯ বছর বয়সী রতন ধলির ভাগ্য এখনো অজানা। নভেম্বরের শুরুতে সিটিটিসি তার পরিবারকে জানায় যে তিনিও ২৬ সেপ্টেম্বরের অভিযানে নিহত হয়েছেন। কিন্তু ১ ডিসেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েসেখানে দাবি করা হয়রতন এখনো জীবিত।

সিটিটিসির পুলিশ সুপার রওশন সাদিয়া আফরোজ জানিয়েছেনভিডিওটি তারা তদন্ত করে ভুয়া হিসেবে শনাক্ত করেছেন এবং এর ফরেনসিক বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। পাকিস্তানের টিটিপির মুখপাত্র ইমরান হায়দারও প্রথমে রতনের মৃত্যুর খবর দিলেও পরে তা প্রত্যাহার করে বলেনতাকে নিখোঁজ মনে করে এই তথ্য দেওয়া হয়েছিল।

রতনের পরিবার দুশ্চিন্তায় অসহায়। তার বাবা আনোয়ার ধলি বলেন, “দিন আগে পুলিশ বলল আমার ছেলে পাকিস্তানে মারা গেছে। এখন আল্লাহই জানেনসে বেঁচে আছে কিনা।

২০২৪ সালের ঈদের দিন রতন শেষবার তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। ভিডিও কলে তিনি মাকে জানানতিনি দিল্লিতে আছেন এবং শিগগিরই দুবাই যাবেন। তারপর থেকে আর কোনো যোগাযোগ নেই।

নিয়োগের পদ্ধতি
২০২৪ সালের মার্চে ফয়সাল পরিবারকে জানায় যে সে দুবাই যাবে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তারা এতে সম্মত না হলেও কয়েকদিন পর ফয়সাল জানায়একজন বড়ভাই’ তার যাবতীয় খরচ বহন করবেন এবং দুবাই পৌঁছে সে বেতনের টাকা দিয়ে দেনা শোধ করবে।

যাত্রার আগে ভাই আরমান তাকে জিজ্ঞেস করেন ভিসার ব্যাপারে। ফয়সাল জানায়তার ভিসা হবে ভারত থেকে। এতে আরমান বিস্মিত হন।

মার্চেই রতনও বাবাকে জানানদুবাইয়ে একটি ক্লিনিকে কাজ করবেন। প্রায় ২০ দিন পর তিনি মাকে ফোনে জানান তিনি ভারতে আছেন এবং সেখান থেকে দুবাই যাবেন।

বাস্তবেদুজনই প্রথমে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেনকলকাতা ও দিল্লিতে কয়েকদিন অবস্থান করেন এবং পরে আফগানিস্তান হয়ে অবৈধভাবে পাকিস্তানে পৌঁছানযেখানে তারা টিটিপিতে যোগ দেন।

জুবায়েরের পথ ছিল ভিন্ন। তিনি ২০২৪ সালের নভেম্বরে ওমরাহ করার উদ্দেশ্যে সৌদি আরব যান এবং দেশে আর ফিরে আসেননি। সিটিটিসির তথ্য অনুযায়ীতিনি সৌদি আরব থেকে বৈধভাবে পাকিস্তানে প্রবেশ করেন।

ঝুঁকিপূর্ণ তরুণদের লক্ষ্যবস্তু
তিনজনের অভিজ্ঞতা এক জায়গায় মেলেতারা সবাই নিম্ন বা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা।

পরিবারগুলো অভিযোগ করেছে যে তাদের সন্তানদের প্রতারণা করে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। তারা সরকারের কাছে কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেনগ্রামীণ বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের বেকার তরুণরা সহজেই এই ধরনের প্রলোভনে পড়ে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুবাশশির হাসান বলেন, “টাকার লোভ দেখিয়ে তাদের সহজেই প্রভাবিত করা হয়।

অন্যদিকে টিটিপির মুখপাত্র হায়দার দাবি করেনকেউ জোর বা প্রতারণা করে সংগঠনটিতে যোগ দেয়নি।

সমস্যার পরিধি
সিটিটিসির তথ্য অনুযায়ীবাংলাদেশি তরুণরা শুধু টিটিপি নয়পাকিস্তানের আরও দুই জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিচ্ছেতেহরিক-ই-লাবাইক পাকিস্তান (টিএলপি) ও ইত্তেহাদ-উল-মুজাহিদিন পাকিস্তান (আইএমপি)।

বাংলাদেশি কর্মকর্তারা বলেনতারা এখন পর্যন্ত ২৫৩০ জনকে শনাক্ত করেছেন যারা পাকিস্তানে যুদ্ধ করছে। অনলাইনে ধর্মীয় বক্তব্য বিকৃত করে এই নিয়োগের বেশির ভাগই সম্পন্ন হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞানী তৌহিদুল হক জানানসাম্প্রতিক বছরগুলোতে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশি তরুণদের সম্পৃক্ততা বেড়েছে এবং তারা এখন অনলাইনে সক্রিয় হয়ে আরও গোপনীয়ভাবে কাজ করছে।

প্রণোদনা ও উদ্দেশ্য
বাংলাদেশি নাগরিকদের পাকিস্তানের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বিশেষজ্ঞদের কাছে বিস্ময়কর।
টিটিপির মুখপাত্র হায়দার বলেনতাদের লক্ষ্য পাকিস্তানে শরিয়া ভিত্তিক শাসন প্রতিষ্ঠা।

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক এই ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “আরেকটি মুসলিম দেশে সশস্ত্র যুদ্ধ করতে যাওয়াকে ইসলাম সমর্থন করে না।

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ
বাংলাদেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে জঙ্গিবাদ অনেকটাই দমন করতে সক্ষম হয়েছে। তবে বিদেশে যুদ্ধ করতে যাওয়া তরুণদের প্রবণতা ইঙ্গিত দেয়জঙ্গি নেটওয়ার্কগুলো কৌশল পরিবর্তন করেছে। তারা অনলাইনে প্রভাব বিস্তার করছে এবং তরুণদের সীমান্ত পেরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

২০২৫ সালের জুলাইয়ে সাভার থানায় একটি মামলায় অভিযোগ আনা হয়কয়েকজন ব্যক্তি পাকিস্তানের টিটিপির পক্ষে অপর একটি দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল।

এছাড়া জুলাইয়ে টিটিপির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

বাংলাদেশে সর্বশেষ বড় জঙ্গি হামলা ঘটে ২০১৬ সালের ১ জুলাইযখন ঢাকার হলি আর্টিসান বেকারিতে হামলা চালিয়ে পাঁচ জঙ্গি ২০ জনকে হত্যা করে। পরে সরকার আইএস-এর দাবি প্রত্যাখ্যান করে এটিকে নব্য জেএমবি’–র কাজ বলে ঘোষণা করে।

যদিও বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন নিষিদ্ধতবুও কিছু সংগঠন মাঝে মাঝে পুনরুত্থানের চেষ্টা করেযেমন ২০০৯ সালে নিষিদ্ধ হিজবুত তাহরিরের সদস্যরা ২০২৪ সালে রাজধানীতে প্রকাশ্যে মিছিল বের করে।

রতন ধলির পরিবারের মতো আরও বহু পরিবার এখন অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেতারা জানে না তাদের সন্তান আদৌ বেঁচে আছেনাকি দূরদেশের এক অচেনা যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে।

এই অনিশ্চয়তাই হয়তো বাংলাদেশি জঙ্গিবাদের নতুন অধ্যায়যেখানে তরুণরা অদৃশ্যভাবে সীমান্ত পেরিয়ে হারিয়ে যাচ্ছেআর পরিবারগুলো বেদনাহত অন্ধকারে অপেক্ষা করছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

ডায়ানা ড্যানিয়েলের জন্য একটি নতুন সকাল

পাকিস্তানের “ ডনের প্রতিবেদন” : বাংলাদেশি জঙ্গীরা পাকিস্তানে, অবৈধ পথে ভারত হয়ে যাচ্ছে

০৫:৪৬:০৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২৫

ফয়সাল হোসেন পরিবারকে জানিয়েছিলেন যে তিনি দুবাইয়ে কাজ পেয়েছেন। বাস্তবেমাদারীপুরের এই ২২ বছর বয়সী যুবক ঢাকার প্রায় ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণের এক গ্রাম থেকে উঠে গিয়ে পাকিস্তানের নিষিদ্ধ সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-এর হয়ে যুদ্ধ করছিলেন। এই সংগঠনটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ চালিয়ে তাদের নিজস্ব শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে।

২০২৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরখাইবার পাখতুনখোয়ার করাক জেলায় এক অভিযানে পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী ফয়সালকে হত্যা করে। গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া লাশের ছবিতে তার ভাই আরমান তাকে শনাক্ত করেন।

ফয়সাল হোসেন এখন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে নিহত হওয়া অন্তত চার বাংলাদেশির একজনযারা পাকিস্তানে টিটিপির হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। বাংলাদেশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের তথ্য অনুযায়ীআরও অন্তত দুই ডজন বাংলাদেশি পাকিস্তানে অবস্থান করছেন এবং টিটিপি ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে লড়াই করছেন। ২০২৩ সাল থেকে এই প্রবণতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে এবং এটি ঢাকার নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর জন্য গুরুতর উদ্বেগের কারণ।

২২ বছর বয়সী দ্বিতীয় বাংলাদেশি যুবকজুবায়ের আহমেদএপ্রিল ২০২৫-এ নিহত হয়েছেন বলে পরিবার জানায়। তার মা আলেয়া আক্তার জানানএপ্রিলের শেষে একটি অজানা নম্বর থেকে ফোন আসে এবং বলা হয়তার ছেলে আর নেই।

একটি ভয়ংকর স্রোত: পাকিস্তানের চরমপন্থী সংগঠনে যোগ দিচ্ছে ডজন ডজন বাংলাদেশি তরুণ। তাদের এই অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক একটি নতুন রপ্তানি এবং দক্ষিণ এশিয়ার সশস্ত্র জঙ্গিবাদের মানচিত্রে বিস্ময়কর এক পরিবর্তন।

রাতান ধলির অনিশ্চিত পরিণতি
বাংলাদেশের ২৯ বছর বয়সী রতন ধলির ভাগ্য এখনো অজানা। নভেম্বরের শুরুতে সিটিটিসি তার পরিবারকে জানায় যে তিনিও ২৬ সেপ্টেম্বরের অভিযানে নিহত হয়েছেন। কিন্তু ১ ডিসেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েসেখানে দাবি করা হয়রতন এখনো জীবিত।

সিটিটিসির পুলিশ সুপার রওশন সাদিয়া আফরোজ জানিয়েছেনভিডিওটি তারা তদন্ত করে ভুয়া হিসেবে শনাক্ত করেছেন এবং এর ফরেনসিক বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। পাকিস্তানের টিটিপির মুখপাত্র ইমরান হায়দারও প্রথমে রতনের মৃত্যুর খবর দিলেও পরে তা প্রত্যাহার করে বলেনতাকে নিখোঁজ মনে করে এই তথ্য দেওয়া হয়েছিল।

রতনের পরিবার দুশ্চিন্তায় অসহায়। তার বাবা আনোয়ার ধলি বলেন, “দিন আগে পুলিশ বলল আমার ছেলে পাকিস্তানে মারা গেছে। এখন আল্লাহই জানেনসে বেঁচে আছে কিনা।

২০২৪ সালের ঈদের দিন রতন শেষবার তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। ভিডিও কলে তিনি মাকে জানানতিনি দিল্লিতে আছেন এবং শিগগিরই দুবাই যাবেন। তারপর থেকে আর কোনো যোগাযোগ নেই।

নিয়োগের পদ্ধতি
২০২৪ সালের মার্চে ফয়সাল পরিবারকে জানায় যে সে দুবাই যাবে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তারা এতে সম্মত না হলেও কয়েকদিন পর ফয়সাল জানায়একজন বড়ভাই’ তার যাবতীয় খরচ বহন করবেন এবং দুবাই পৌঁছে সে বেতনের টাকা দিয়ে দেনা শোধ করবে।

যাত্রার আগে ভাই আরমান তাকে জিজ্ঞেস করেন ভিসার ব্যাপারে। ফয়সাল জানায়তার ভিসা হবে ভারত থেকে। এতে আরমান বিস্মিত হন।

মার্চেই রতনও বাবাকে জানানদুবাইয়ে একটি ক্লিনিকে কাজ করবেন। প্রায় ২০ দিন পর তিনি মাকে ফোনে জানান তিনি ভারতে আছেন এবং সেখান থেকে দুবাই যাবেন।

বাস্তবেদুজনই প্রথমে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেনকলকাতা ও দিল্লিতে কয়েকদিন অবস্থান করেন এবং পরে আফগানিস্তান হয়ে অবৈধভাবে পাকিস্তানে পৌঁছানযেখানে তারা টিটিপিতে যোগ দেন।

জুবায়েরের পথ ছিল ভিন্ন। তিনি ২০২৪ সালের নভেম্বরে ওমরাহ করার উদ্দেশ্যে সৌদি আরব যান এবং দেশে আর ফিরে আসেননি। সিটিটিসির তথ্য অনুযায়ীতিনি সৌদি আরব থেকে বৈধভাবে পাকিস্তানে প্রবেশ করেন।

ঝুঁকিপূর্ণ তরুণদের লক্ষ্যবস্তু
তিনজনের অভিজ্ঞতা এক জায়গায় মেলেতারা সবাই নিম্ন বা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা।

পরিবারগুলো অভিযোগ করেছে যে তাদের সন্তানদের প্রতারণা করে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। তারা সরকারের কাছে কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেনগ্রামীণ বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের বেকার তরুণরা সহজেই এই ধরনের প্রলোভনে পড়ে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুবাশশির হাসান বলেন, “টাকার লোভ দেখিয়ে তাদের সহজেই প্রভাবিত করা হয়।

অন্যদিকে টিটিপির মুখপাত্র হায়দার দাবি করেনকেউ জোর বা প্রতারণা করে সংগঠনটিতে যোগ দেয়নি।

সমস্যার পরিধি
সিটিটিসির তথ্য অনুযায়ীবাংলাদেশি তরুণরা শুধু টিটিপি নয়পাকিস্তানের আরও দুই জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিচ্ছেতেহরিক-ই-লাবাইক পাকিস্তান (টিএলপি) ও ইত্তেহাদ-উল-মুজাহিদিন পাকিস্তান (আইএমপি)।

বাংলাদেশি কর্মকর্তারা বলেনতারা এখন পর্যন্ত ২৫৩০ জনকে শনাক্ত করেছেন যারা পাকিস্তানে যুদ্ধ করছে। অনলাইনে ধর্মীয় বক্তব্য বিকৃত করে এই নিয়োগের বেশির ভাগই সম্পন্ন হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞানী তৌহিদুল হক জানানসাম্প্রতিক বছরগুলোতে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশি তরুণদের সম্পৃক্ততা বেড়েছে এবং তারা এখন অনলাইনে সক্রিয় হয়ে আরও গোপনীয়ভাবে কাজ করছে।

প্রণোদনা ও উদ্দেশ্য
বাংলাদেশি নাগরিকদের পাকিস্তানের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বিশেষজ্ঞদের কাছে বিস্ময়কর।
টিটিপির মুখপাত্র হায়দার বলেনতাদের লক্ষ্য পাকিস্তানে শরিয়া ভিত্তিক শাসন প্রতিষ্ঠা।

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক এই ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “আরেকটি মুসলিম দেশে সশস্ত্র যুদ্ধ করতে যাওয়াকে ইসলাম সমর্থন করে না।

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ
বাংলাদেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে জঙ্গিবাদ অনেকটাই দমন করতে সক্ষম হয়েছে। তবে বিদেশে যুদ্ধ করতে যাওয়া তরুণদের প্রবণতা ইঙ্গিত দেয়জঙ্গি নেটওয়ার্কগুলো কৌশল পরিবর্তন করেছে। তারা অনলাইনে প্রভাব বিস্তার করছে এবং তরুণদের সীমান্ত পেরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

২০২৫ সালের জুলাইয়ে সাভার থানায় একটি মামলায় অভিযোগ আনা হয়কয়েকজন ব্যক্তি পাকিস্তানের টিটিপির পক্ষে অপর একটি দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল।

এছাড়া জুলাইয়ে টিটিপির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

বাংলাদেশে সর্বশেষ বড় জঙ্গি হামলা ঘটে ২০১৬ সালের ১ জুলাইযখন ঢাকার হলি আর্টিসান বেকারিতে হামলা চালিয়ে পাঁচ জঙ্গি ২০ জনকে হত্যা করে। পরে সরকার আইএস-এর দাবি প্রত্যাখ্যান করে এটিকে নব্য জেএমবি’–র কাজ বলে ঘোষণা করে।

যদিও বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন নিষিদ্ধতবুও কিছু সংগঠন মাঝে মাঝে পুনরুত্থানের চেষ্টা করেযেমন ২০০৯ সালে নিষিদ্ধ হিজবুত তাহরিরের সদস্যরা ২০২৪ সালে রাজধানীতে প্রকাশ্যে মিছিল বের করে।

রতন ধলির পরিবারের মতো আরও বহু পরিবার এখন অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেতারা জানে না তাদের সন্তান আদৌ বেঁচে আছেনাকি দূরদেশের এক অচেনা যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে।

এই অনিশ্চয়তাই হয়তো বাংলাদেশি জঙ্গিবাদের নতুন অধ্যায়যেখানে তরুণরা অদৃশ্যভাবে সীমান্ত পেরিয়ে হারিয়ে যাচ্ছেআর পরিবারগুলো বেদনাহত অন্ধকারে অপেক্ষা করছে।