মানবদেহে বার্ধক্য কীভাবে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়, কোষ ও ডিএনএ পর্যায়ে কোন পরিবর্তনগুলো ঘটে—তা এবার আরও স্পষ্ট করে দেখাল বিজ্ঞানীদের তৈরি করা সবচেয়ে বিস্তৃত ‘এজিং অ্যাটলাস’। ১৫ হাজারের বেশি নমুনা থেকে সংগৃহীত ডেটা বিশ্লেষণ করে তৈরি এই মানচিত্র বার্ধক্যের আণবিক রূপ ও অঙ্গভিত্তিক পরিবর্তন একসঙ্গে তুলে ধরেছে।
উদ্ভাবিত এজিং অ্যাটলাস
গবেষণার আন্তর্জাতিক দল ১৭ ধরনের মানব টিস্যুর ডিএনএ মিথাইলেশনের পরিবর্তন অনুসরণ করে এজিং অ্যাটলাস তৈরি করে। মিথাইলেশন জিনকে কীভাবে চালু বা বন্ধ করে এবং বয়সের সঙ্গে এগুলো কীভাবে বদলে যায়—সেটাই ছিল তাদের অনুসন্ধানের মূল কেন্দ্র।
ডিএনএ মিথাইলেশন বোঝা
ড. জেসি পোগানিক, হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষক, জানান যে ডিএনএ মিথাইলেশন এক ধরনের রাসায়নিক সংশোধন, যা ঠিক করে দেয় কোন জিন সক্রিয় থাকবে। একই জিনোম থাকা সত্ত্বেও ফুসফুস, ত্বক বা মস্তিষ্কের কোষ ভিন্নভাবে কাজ করে—এই পার্থক্য তৈরি করে মিথাইলেশন।
বার্ধক্য ও এপিজেনেটিক পরিবর্তন
বার্ধক্য বোঝার ক্ষেত্রে মিথাইলেশনের গুরুত্ব অনেক। এটি ডিএনএ কোড না বদলে জিন নিয়ন্ত্রণ করে এবং খাদ্যাভ্যাস, পরিবেশ, সংক্রমণ বা ব্যায়ামের প্রতিক্রিয়ায় দ্রুত বদলে যেতে পারে। এই পরিবর্তন থেকেই তৈরি হয় ‘এপিজেনেটিক ক্লক’। তবে রক্তভিত্তিক গবেষণার বাইরে অন্য টিস্যুতে কী ঘটে, তা এতদিন পরিষ্কার ছিল না।

বিস্তৃত ডেটা বিশ্লেষণ
এই সীমাবদ্ধতা কাটাতে গবেষকেরা বিশ্বের সব পাবলিক মিথাইলেশন ডেটাসেট একত্র করে নতুন তথ্য যোগ করে প্রায় এক মিলিয়ন জিনোমিক পয়েন্ট বিশ্লেষণ করেন—মস্তিষ্ক, ত্বক, হৃদযন্ত্র, পাকস্থলী থেকে রেটিনা পর্যন্ত।
টিস্যুভেদে পরিবর্তনের বৈচিত্র্য
এজিং অ্যাটলাসে দেখা যায়, বিভিন্ন টিস্যুতে মিথাইলেশন ট্যাগের বিস্তার ভিন্ন। সার্ভিক্সে প্রায় ৩৮ শতাংশ ট্যাগ পাওয়া গেলেও রেটিনায় তা ৬০ শতাংশের বেশি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশিরভাগ টিস্যুতে ডিএনএ ক্রমশ ‘হাইপারমিথাইলেটেড’ হয়, অর্থাৎ বেশি জায়গায় ট্যাগ যুক্ত হয় এবং কিছু জিন বন্ধ হতে থাকে।
ব্যতিক্রমী অঙ্গ: ফুসফুস ও কঙ্কাল পেশি
তবে ফুসফুস ও কঙ্কাল পেশি এই নিয়মের ব্যতিক্রম। এসব টিস্যুতে মিথাইলেশন ট্যাগ কমে যায়, যা জিন কার্যক্রমকে অস্বাভাবিকভাবে সক্রিয় বা অস্থির করে তুলতে পারে।
অঙ্গভেদে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া
ড. ম্যাক্সু জ্যাক্স জানান, সামগ্রিকভাবে হাইপারমিথাইলেশন দেখা গেলেও, অঙ্গভেদে প্যাটার্ন ভিন্ন। চর্বি টিস্যুতে পরিবর্তন দ্রুত হলেও মস্তিষ্কে তা অনেক ভারসাম্যপূর্ণ। বিভিন্ন অঙ্গ কীভাবে বয়সজনিত চাপ সামলায়—সেটাই এই পার্থক্য দেখায়।
সবচেয়ে পরিবর্তনশীল ও কম পরিবর্তনশীল অঙ্গ
মস্তিষ্ক, যকৃত ও ফুসফুসে পরিবর্তন সবচেয়ে স্পষ্ট। ত্বক ও কোলনেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গেছে। অন্যদিকে রেটিনা, অগ্ন্যাশয় ও প্রোস্টেটে পরিবর্তন তুলনামূলক কম—সম্ভবত তথ্যের সীমাবদ্ধতা বা অঙ্গের নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে।
অনিশ্চয়তার ক্ষেত্র
গবেষকেরা সতর্ক করছেন—এতে ভুলভাবে যেন মনে না হয় কিছু অঙ্গ দ্রুত বুড়ো হয়। নমুনার বৈচিত্র্য ও পরিসংখ্যানগত সীমাবদ্ধতার কারণে এমন সিদ্ধান্ত এখনই টানা যাবে না। একইভাবে এখনো পরিষ্কার নয়—মিথাইলেশন কি বার্ধক্য ঘটায়, নাকি বার্ধক্যের ফল।

বার্ধক্যের সাধারণ ছন্দ
তবুও পোগানিক মনে করেন, মিথাইলেশনের কিছু পরিবর্তন বার্ধক্যের নির্দিষ্ট দিকের জন্য দায়ী হতে পারে। এজিং অ্যাটলাস প্রথমবারের মতো দেখিয়েছে—দেহজুড়ে বয়সের একটি সাধারণ জীববৈজ্ঞানিক ছন্দ রয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন বনাম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
সব পরিবর্তন যে সমান গুরুত্বপূর্ণ, তা নয়। অনেক পরিবর্তন কেবল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। অ্যাটলাস গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনকে আলাদা করে না, তবে ভবিষ্যৎ গবেষণার জন্য নতুন পথ খুলে দেয়। এটি উন্মুক্তভাবে অনলাইনে পাওয়া যাবে এবং আরও বিস্তৃত সহযোগিতার সুযোগ তৈরি করবে।
পরবর্তী ধাপ
পরবর্তী ধাপে গবেষকেরা এমন পরিবর্তনগুলো খুঁজে দেখবেন, যা সব অঙ্গজুড়ে একইভাবে দেখা যায় এবং বার্ধক্যের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য বায়োমার্কারও বিশ্লেষণ করা হবে। পোগানিকের মতে, ক্যান্সার গবেষণার তুলনায় বার্ধক্য নিয়ে গবেষণা এখনো পিছিয়ে, আর এই অ্যাটলাস সেই ব্যবধান কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















