বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে নানা ইস্যুতে নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক দেখা যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য-স্থাপনায় হামলা থেকে শুরু করে যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা নিয়েও নতুন করে বিতর্ক হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ঐতিহাসিক স্থাপনার সুরক্ষার প্রশ্নে সমালোচনা আছে। কারণ দেশের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ বহু মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ও একাধিক যাদুঘরে হামলা ভাঙচুর হলেও সেগুলোর সংস্কার করা হয়নি।
একাত্তরের ১৭ই এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন ও শপথ গ্রহণের ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে মেহেরপুর জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স। সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ ছাড়াও ছোট বড় চারশর মতো ভাস্কর্য ছিল। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, ঘটনা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও যুদ্ধের ভয়াবহতা মিলিয়ে এক নজরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছিল ওই কমপ্লেক্সে।
৫ই অগাস্ট মুজিবনগরে শত শত ভাস্কর্য ভাঙচুর লুটপাট করা হয়েছে যেগুলো এখনো সংস্কার বা পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। সরেজমিন মুজিবনগর গিয়ে দেখা যায় মুজিবনগর কমপ্লেক্সের অধিকাংশ ভাস্কর্য এখনো ক্ষতিগ্রস্ত।
মুজিবনগর কমপ্লেক্সের সম্মুখে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যটি একেবারে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সালাম গ্রহণের অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাস্কর্যের মাথাটিও ধ্বংস করা হয়েছে।

গার্ড অফ অনার দেয়া আনসারদের ভাস্কর্যগুলোর প্রায় প্রতিটি হাত ও হাতিয়ার ভেঙে দেয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারকে গার্ড অফ অনার দেয়া আনসারদের বারোজনের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদ আজিমুদ্দিন শেখ। ঐতিহাসিক এই কমপ্লেক্সে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট নিয়ে দুঃখ ও হতাশা ব্যক্ত করেন এই মুক্তিযোদ্ধা।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “এটা বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রশ্ন। আমাদের আর অস্তিত্ব আছে বলুন। বলবো আমরা কী, এটা সহ্য করার বাইরে।”
মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে মানচিত্রের আদলে তৈরি বৃত্তাকার স্থানে তিন শতাধিক ভাস্কর্যে এগারোটি সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় তুলে ধরা হয়েছিল। মুজিবনগরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানচিত্রের ভেতরে নির্মিত তিন শতাধিক ভাস্কর্য ।
মুক্তিযোদ্ধা আজিমুদ্দিনের ভাষায়, “এটা মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা। আমরা যে কত পরিশ্রম করেছি তা বলে বোঝানে যাবে না, এখন কী বলবো, আমাদের কিছু করার নাই। “
মুজিবনগরে একাত্তরের সতেরই এপ্রিল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের একজন প্রত্যক্ষদর্শী সুভাষ মল্লিক। যিনি স্মৃতিস্তম্ভ এলাকায় নিজ উদ্যোগে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ করেন এবং ভ্রমণকারীদের কাছে ইতিহাস তুলে ধরেন।
তিনিও বলেন, ভাস্কর্য ভাঙচুর হামলা ও লুটপাটের পর থেকে দর্শনার্থীর সংখ্যা কমে গেছে।
“আপনি জিজ্ঞেস করছেন আমার অন্তর কানছে। বিনা বেতনে সতের বছর কাজ করেছি। ঝাড়ু দিয়ে পরিস্কার করেছি। সেই জন্য আমার দরদ লাগে। জায়গাটা নষ্ট হয়ে গেল, লোকজন আসছে না।”
তিনি দাবি করেন, ভোটের মাধ্যমে যে সরকারই আসুক না কেন এ ঐতিহাসিক স্থানটি যেন সংস্কার করা হয়।
“আবার যেন আমরা স্মৃতি ফিরে পাই। ইতিহাসটা বজায় থাক।”
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম গত ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর কমপ্লেক্স পরিদর্শন করেছিলেন। জায়গাটি সংরক্ষণ এবং ভাস্কর্য সংস্কার নিয়ে বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। উপদেষ্টা জানান স্থানীয় গণপূর্ত বিভাগকে এ ব্যাপারে প্রস্তাব পাঠাতে বলা হয়েছে।

“বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে রিলেটেড একটা বিষয় এত অবহেলায় তৈরি করতে পারে এটা ফার্স্টটাইম দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। আমি পৃথিবীর অনেক দেশে গিয়েছি আমি এই ধরনের অনেক স্থাপনা দেখেছি। এগুলির আরো অনেক স্মার্ট প্রকাশ আছে। এটা সেইরকম করে হতে পারতো। এটা ওইরকম এটা করা যায় কি না এটারো একটা নির্দেশনা আমরা তাদের কাছে চেয়েছি,” বলেন মি. আজম।
৫ই আগস্ট এবং তারপরেও সারা বাংলাদেশে একাত্তরের স্মৃতিচিহ্ন ভাস্কর্য, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন যাদুঘর ভাঙচুর ও হামলা লুটপাট হয়েছে। ঐতিহাসিক সাতই মার্চ ও আত্মসমর্পণের স্থান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থিত জাদুঘরটিও ব্যাপক ভাঙচুর ও তছনছ করা হয়েছে। হামলার শিকার ভাস্কর্য, মুক্তিযুদ্ধে যাদুঘর ঐতিহাসিক স্থান সংস্কারে দৃশ্যমান কিছু হয়নি।
এ ব্যাপারে উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, “অবহেলা মোটেও নাই। সরকারি কাজগুলো যেভাবে ঢিমেতালে হয়। এটা ওইরকমই একটা ব্যাপার আরকি।”
সরকার উদাসীন নয় উপদেষ্টা এমন দাবি করলেও বাস্তবতা হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে থাকাকালীন মব সৃষ্টি করে ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের ভূমিকা নিয়ে নিয়েও নানা বিতর্কিত মন্তব্য দেখা যাচ্ছে। সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র স্বাধীনতা যুদ্ধকে প্রতিরোধযুদ্ধ উল্লেখ করা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। এছাড়া গণঅভ্যুত্থানের পর বিজয় দিবস, মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের কটাক্ষ করা হয়েছে এমন সমালোচনা রয়েছে। সর্বোপরি এ সময়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার একটি পাল্টা রাজনৈতিক বয়ান বা ন্যারেটিভ তুলে ধরার প্রচেষ্টা দৃশ্যমান হয়েছে।
এর বিশ্লেষণে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন,
“একাত্তরের যুদ্ধে দুইটা পক্ষ ছিল আমাদের দেশে বোঝা যায়। একটা দল ওই যুদ্ধে হেরে গেছে আরেকটা দল জিতে গেছে। যারা হেরে গেছে তাদের অনেকে এখন মনে করছে যে পাঁচই আগস্টের পর তারা জিতে গেছে। তাদেরকে যারা হারিয়ে দিয়েছিল তাদেরকে তারা হারিয়ে দিয়েছে। এইভাবে ন্যারেটিভটা আবার পাল্টে যাচ্ছে। এখন আমরা দেখি যে একাত্তর পরবর্তী সময়ে যেসমস্ত ঘটনা ঘটেছিল পাঁচই অগাস্টের পরে তার ঠিক উল্টোটা ঘটছে। অর্থাৎ তখনকার পরাজিত পক্ষ এখন নিজেকে বিজয়ী মনে করছে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা ও ইতিহাস নিয়ে প্রতিটি সরকার রাজনীতি করেছে। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, এই সরকার একটা দোদুল্যমান অবস্থায় আছে।
“এই সরকার দেখছে যে এটা ন্যারেটিভ তৈরি হচ্ছে কাউন্টার ন্যারেটিভ সেটার উপর ভর করে কিন্তু এই সরকার আছে। এটা একটা শক্তিও দেয় এ সরকারকে। সেটাকে তারা অস্বীকার করতে পারছে না। আবার বাংলাদেশের অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে আছে একাত্তর, ওটাকেও অস্বীকার করা খুব কঠিন। তো এরকম একটা অবস্থার মধ্যে আছে। পেন্ডুলামের মতো ঘুরছে আমরা দেখছি। সরকারের লোকেরা অনেক সময় অনেক কথা বলেন ভাসা ভাসা আবার কয়েকজন আছে এমনভাবে কথা বলেন মনে হয় যেন আগে যা করেছি সবই ভুল, এখন যা করছে সবই ঠিক।”
তবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজমের দাবি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে বিতর্ক নানা মহল সৃষ্টি করছে সেগুলো রাজনৈতিক এবং তাদেরকেই এর দায় নিতে হবে।
“কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ কিংবা কারো কোনো পরিকল্পনা বা ন্যারেটিভ ক্যারি ফরোয়ার্ড করার আমাদের কোনো দায় নাই। আমরা সেটা করছিও না। বিজয় দিবসকে নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধকে নিয়ে কারা ওউন করবে, কারা ডিজওউন করবে, কারা কী করবে এটার দায় তাদেরকেই বহন করতে হবে। যারা এ সমস্ত নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করছে এই বিতর্ক নিরসনের দায়ও তাদের। তারা মানুষের সামনে ওইটা নিয়েই দাঁড়াবে।”

বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও পরিবর্তন একটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ইতিহাস গবেষক ও বিশ্লেষকরা মনে করেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নির্মোহ উপস্থাপন এদেশে কখনোই হয়নি।
মহিউদ্দিন আহমদের ভাষায়, “এই মুহূর্তে একদম ফ্লুইড। মানে এখন বোঝা যাচ্ছে না কোনদিকে যাবে। সোজা কথা বলি আমি এখন যে পর্যায়ে আমরা আছি এটাকে সত্যিকার অর্থে আমি বলি একটা গৃহযুদ্ধের পর্যায়। এই গৃহযুদ্ধটা রাস্তাঘাটে মারামারির মধ্যে না, আমি বলছি এটা আমাদের চিন্তায়, মননে, তর্কে এই গৃহযুদ্ধটা কিন্তু চলছে। এই গৃহযুদ্ধের কারণে একটা ইউনিফাইড ন্যারেটিভ তৈরি হচ্ছে না।”
মহিউদ্দিন আহমদ বলনে, যতদিন বাংলাদেশের মানুষ সচেতন শিক্ষিত এনলাইটেন্ড না হবে ততদিন এগুলো চলতে থাকবে।
BBC News বাংলা
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















