‘সংস্কৃতি অব পিস’ কেবল সংঘাতহীন অবস্থাই নয়, বরং ন্যায়বিচার, সহমর্মিতা ও মানবিক মর্যাদার ওপর প্রতিষ্ঠিত—এই দর্শন থেকেই বাংলাদেশ ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, গণহত্যার শিকার এসব রোহিঙ্গার নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জরুরি দায়িত্ব।
ঘৃণা ও সহিংসতার বিরুদ্ধে বৈশ্বিক অবস্থান
সৌদি আরবের রিয়াদে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সভ্যতা সংলাপ জোটের (ইউএনএওসি) ১১তম বৈশ্বিক ফোরামে বক্তব্য দিতে গিয়ে উপদেষ্টা বলেন, অনলাইন ও অফলাইনে ঘৃণা ছড়ানোর সব ধরনের উসকানি প্রত্যাখ্যান করতে হবে। সহিংসতা, অসহিষ্ণুতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।
ঐক্য, বৈচিত্র্য ও মানবিক মূল্যবোধ
মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, বিশ্বকে ঐক্যের পথে এগিয়ে নিতে পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়াতে হবে এবং বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য উদযাপন করতে হবে। মানবিক মূল্যবোধ রক্ষার মাধ্যমেই বিভক্ত বিশ্বে শান্তির পথ আলোকিত হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তরুণদের ভূমিকা ও শিক্ষায় বিনিয়োগ
তিনি বলেন, তরুণদের ক্ষমতায়ন ও প্রজন্মভিত্তিক সংলাপ জোরদার করা জরুরি। সভ্যতা, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা গড়ে তুলতে তরুণদের বৈশ্বিক উদ্যোগের কেন্দ্রে রাখতে হবে। শান্তি ও সহনশীলতা নিশ্চিত করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষায় বিনিয়োগের ওপরও গুরুত্ব দেন তিনি।
সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও গণমাধ্যমের দায়িত্ব
উপদেষ্টার মতে, সাংস্কৃতিক বিনিময়, শিল্পকলা, ক্রীড়া ও দায়িত্বশীল গণমাধ্যম সমাজে সহমর্মিতা ও আস্থা তৈরিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এসব ক্ষেত্রকে আরও বিস্তৃত করার আহ্বান জানান তিনি।
বিচার ও জবাবদিহির প্রশ্ন
জাতিগত বৈষম্যের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার তাগিদ দেন তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি শুধু মানবিক সংকট নয়, এটি বিশ্ব বিবেকের জন্যও গভীর আঘাত।

ইউএনএওসি ফোরাম ও বাংলাদেশের অবস্থান
সৌদি আরব সরকারের আয়োজনে দুই দিনব্যাপী এই ফোরাম অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শনিবার রিয়াদে পৌঁছানো উপদেষ্টা মঙ্গলবার দেশে ফেরার কথা রয়েছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান। ফোরামে স্পেন ও তুরস্কসহ ইউএনএওসি’র বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর নেতৃত্বের প্রশংসা করেন তিনি।
শান্তির পক্ষে বাংলাদেশের ভূমিকা
তিনি বলেন, ইউএনএওসি’র চূড়ান্ত লক্ষ্য শান্তি, আর বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অন্যতম শীর্ষ সেনা প্রেরণকারী দেশ। এ প্রেক্ষাপটে সুদানের কাদুগলিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী লজিস্টিক ঘাঁটিতে সাম্প্রতিক হামলার তীব্র নিন্দা জানান তিনি। ওই হামলায় ছয়জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত এবং কয়েকজন আহত হন।
বিশ্ব সংকট ও ডিজিটাল হুমকি
এই হামলা বিশ্বজুড়ে বাড়তে থাকা সংঘাত ও মানবিক সংকটের বাস্তবতা তুলে ধরে বলে মন্তব্য করেন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, জেনোফোবিয়া, বর্ণবাদ, অসহিষ্ণুতা ও ইসলামোফোবিয়া বিভিন্ন মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। একই সঙ্গে ভুয়া তথ্য, ঘৃণাত্মক বক্তব্য ও ডিপফেক প্রযুক্তি শান্তির জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে।
রোহিঙ্গা ইস্যু ও সংস্কৃতি অব পিস
এই বাস্তবতায় আন্তঃসাংস্কৃতিক ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপের পক্ষে ইউএনএওসি’র বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে একাত্ম বলে জানান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘কালচার অব পিস’ বিষয়ে বাংলাদেশের বার্ষিক জাতিসংঘ প্রস্তাব প্রমাণ করে যে শান্তি কেবল সংঘাতের অনুপস্থিতি নয়, বরং ন্যায়বিচার, সহমর্মিতা ও মানবিক মর্যাদার ওপর প্রতিষ্ঠিত।
তিনি আরও বলেন, এই বিশ্বাস থেকেই বাংলাদেশ মিয়ানমারে গণহত্যার শিকার ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে এবং তাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
সংলাপের পথেই শান্তি
উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ইউএনএওসি আজ সংলাপের এক গুরুত্বপূর্ণ আলোকবর্তিকা, যেখানে পার্থক্য বোঝাপড়ায় রূপ নেয় এবং বৈচিত্র্য যৌথ শক্তিতে পরিণত হয়। তবে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় আরও কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















