পূর্ব কঙ্গোর সংঘাতপীড়িত শহর গোমায় বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ, ভেঙে পড়া অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে গর্ভবতী নারীদের ওপর। সরকারের বিনা খরচের প্রসূতি সেবা কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অসংখ্য নারী এখন অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রসবের মুখে পড়েছেন।
বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রণে আতঙ্কিত মাতৃত্ব
গোমার একটি মাতৃসদনে বসে নিজের ফোলা পেটের ওপর হাত রেখে ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন ইরিনে নাবুদেবা। পাঁচ সন্তানের এই মা জানেন না, ষষ্ঠ সন্তানের জন্মের সময় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা তিনি আদৌ পাবেন কি না। শহরটি বিদ্রোহী এম২৩-এর নিয়ন্ত্রণে থাকায় হাসপাতাল পর্যন্ত যাতায়াতও তার জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে।
সংঘাতের কারণে চিকিৎসা সংকট
চলতি বছরে নতুন করে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ায় ফ্রন্টলাইনের ওপারে আটকে গেছে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম। গোমার মতো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও মানবিক কেন্দ্রেও পানির সরবরাহসহ মৌলিক অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে। এর মধ্যেই সরকারের বিনা খরচের মাতৃত্বকালীন সেবা কর্মসূচি জুনে নবায়ন না হওয়ায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। কেন এই কর্মসূচি বন্ধ হলো, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
বিনা খরচের সেবা বন্ধ, ঝুঁকিতে নারীরা
২০২৩ সালে চালু হওয়া এই কর্মসূচির আওতায় নির্বাচিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে গর্ভকালীন পরীক্ষা, জটিলতা মোকাবিলা ও চিকিৎসা বিনা খরচে দেওয়া হতো। এর লক্ষ্য ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ মাতৃ ও নবজাতক মৃত্যুহার কমানো। কিন্তু কর্মসূচি বন্ধ হওয়ার পর অনেক নারী আর চিকিৎসা নিতে পারছেন না।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে মাতৃমৃত্যুর দিক থেকে কঙ্গোর অবস্থান ছিল বিশ্বে দ্বিতীয়, যেখানে প্রায় ১৯ হাজার নারী প্রসবজনিত কারণে মারা যান।
ঘরে ঘরে ঝুঁকিপূর্ণ প্রসব
স্বাস্থ্যকর্মীরা জানিয়েছেন, গোমায় এখন আগের চেয়ে বেশি নারী বাড়িতেই সন্তান জন্ম দিচ্ছেন, অনেক সময় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ও প্রশিক্ষিত সহায়তা ছাড়া। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, সংক্রমণ এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়েছে।
চলমান সংঘাত ও পরিষেবা ভেঙে পড়া
যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের মধ্যস্থতায় শান্তি প্রচেষ্টা চললেও সাম্প্রতিক সময়ে আবার সংঘর্ষ বেড়েছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, এতে সাত লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সরকারি প্রতিষ্ঠান কার্যত অচল, স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত।
এম২৩ বিদ্রোহীদের এক নেতা দাবি করেছেন, বিনা খরচের প্রসূতি কর্মসূচি ব্যর্থ হওয়ায় তা নবায়ন করা হয়নি। তবে তিনি এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেননি। এ বিষয়ে কঙ্গো সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
ওষুধ সংকট ও কর্মী পালায়ন
আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির এক মূল্যায়নে দেখা গেছে, পূর্ব কঙ্গোর অন্তত ৮৫ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ওষুধের তীব্র সংকট রয়েছে। প্রায় ৪০ শতাংশ কেন্দ্রে সংঘাতের কারণে চিকিৎসক ও নার্সরা এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। লুটপাট ও সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শতাধিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র পুরোপুরি ওষুধশূন্য হয়ে পড়েছে।
৫ ডলারও অযোগ্য ব্যয়
গোমায় এখন একটি ক্লিনিকে সন্তান জন্ম দিতে খরচ পড়ছে ৫ থেকে ১০ ডলার। অথচ বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই অঞ্চলের ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ দিনে ২.১৫ ডলারেরও কম আয়ে জীবনযাপন করেন।
আফিয়া হিমবি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রধান নার্স ফ্রাঁক এনদাশেতেরে কানডোনি জানান, বিনা খরচের কর্মসূচি চলাকালে সেখানে মাসে গড়ে ২০টির বেশি প্রসব হতো। কর্মসূচি বন্ধ হওয়ার পর সেই সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ৯-এ।
যুদ্ধ ও দারিদ্র্যের চাপে পরিবারগুলো
যুদ্ধের কারণে অনেক পরিবারই আয়ের সব পথ হারিয়েছে। ইরিনে নাবুদেবার স্বামী জানুয়ারি থেকে বেকার। তিনি বলেন, যুদ্ধ শুরুর পর তাদের সব কিছুই হারিয়ে গেছে, এখন তারা কোনোভাবে টিকে আছেন।
নবম সন্তানের অপেক্ষায় আরেক মা আর্নেস্তিন বালেকে জানান, তার স্বামীর চাকরি চলে গেছে, বাড়িও পুড়ে গেছে। প্রসবের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ তো দূরের কথা, তার পকেটে ১০০ ফ্রাঁকও নেই।
আহ্বান বিনা খরচের সেবা ফেরানোর
হাসপাতালে যাতায়াতের ভাড়াও দিতে না পেরে অনেক নারী হেঁটেই আসছেন। আর্নেস্তিন বালেকে বলেন, বিনা খরচের স্বাস্থ্যসেবা পুনর্বহাল না হলে অনেক নারী ঘরেই সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যেতে পারেন।
এই সংকটময় সময়ে বিনা খরচের প্রসূতি সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পূর্ব কঙ্গোর গর্ভবতী নারীরা এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















