সিরিয়ায় সাম্প্রতিক এক হামলায় দুই মার্কিন সেনা সদস্য ও এক মার্কিন বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। ইসলামিক স্টেট (আইএস)–এর সন্দেহভাজন এক সদস্যের চালানো এই হামলাটি ছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এক বছরের মধ্যে প্রথম প্রাণঘাতী ঘটনা। এর ফলে প্রশ্ন উঠেছে—সিরিয়ায় কেন এখনো মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে এবং তাদের বর্তমান ভূমিকা কী।
সিরিয়ায় মার্কিন উপস্থিতির সূচনা
২০১১ সালে সিরিয়ায় সরকারবিরোধী গণবিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে বাশার আল-আসাদ সরকারের কঠোর পদক্ষেপ দেশটিকে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। প্রায় ১৪ বছর ধরে চলা এই সংঘাতের অবসান ঘটে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে, যখন আসাদ ক্ষমতা হারান।
ইরাক ও আফগানিস্তানে দীর্ঘ যুদ্ধের অভিজ্ঞতার পর মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি ব্যয়বহুল ও অজনপ্রিয় যুদ্ধে জড়াতে অনিচ্ছুক ছিল ওয়াশিংটন। তাই শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ এড়িয়ে গিয়ে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সীমিত সহায়তা দেয়।
আইএসের উত্থান ও মার্কিন সামরিক অভিযান
পরিস্থিতি বদলে যায় ইসলামিক স্টেটের উত্থানের পর। আইএস শুধু ইরাক ও সিরিয়ায় ব্যাপক এলাকা দখলই করেনি, বরং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে হামলা চালিয়েছে। একপর্যায়ে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা যুক্তরাজ্যের প্রায় অর্ধেকের সমান হয়ে যায়। দখলকৃত অঞ্চলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতাবলম্বী মুসলমানদের ওপর তাদের নির্মমতা আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়িয়ে তোলে।
এর প্রেক্ষাপটে ২০১৪ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসবিরোধী বিমান হামলা শুরু করে। ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো মার্কিন স্থলবাহিনী সিরিয়ায় প্রবেশ করে এবং দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ)-এর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ শুরু করে।
২০১৯ সালের মধ্যে আইএস তাদের দখল করা সব এলাকা হারালেও সংগঠনটির ‘স্লিপার সেল’ এখনো বিচ্ছিন্ন হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
মার্কিন সেনা কোথায় এবং কী করছে
এক দশকের বেশি সময় ধরে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনা উপস্থিতি অব্যাহত রয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রধান লক্ষ্য আইএস দমন। পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিকভাবে ইরান ও ইরান-সমর্থিত যোদ্ধা ও অস্ত্রের ইরাক থেকে সিরিয়ায় প্রবেশ ঠেকাতেও এই উপস্থিতিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়।
বর্তমানে সিরিয়ায় মার্কিন সেনার সংখ্যা প্রায় ৯০০। তারা মূলত কুর্দি নিয়ন্ত্রিত উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং ইরাক ও জর্ডান সীমান্তসংলগ্ন দক্ষিণ-পূর্ব মরুভূমির আল-তানফ ঘাঁটিতে অবস্থান করছে।
সিরীয় সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের পরিবর্তন
আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে ওয়াশিংটন ও দামেস্কের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না এবং মার্কিন সেনারা সরাসরি সিরীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করত না। তবে গত এক বছরে এই বাস্তবতায় পরিবর্তন এসেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সিরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমাদ আল-শারা’র প্রশাসনের মধ্যে সম্পর্ক উষ্ণ হয়েছে। আল-শারা আগে ইসলামপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের নেতা ছিলেন, যাকে একসময় যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিল।
নভেম্বরে তিনি ১৯৪৬ সালে সিরিয়ার স্বাধীনতার পর প্রথম কোনো সিরীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওয়াশিংটন সফর করেন। ওই সফরে সিরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামিক স্টেটবিরোধী বৈশ্বিক জোটে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেয়, যেখানে বর্তমানে ৮৯টি দেশ রয়েছে।
যৌথ অভিযান ও সীমাবদ্ধতা
যদিও বৈশ্বিক জোটে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও সিরিয়ার সামরিক সমন্বয়ের ইঙ্গিত মিলেছে, তবু সিরীয় নিরাপত্তা বাহিনী এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ‘অপারেশন ইনহেরেন্ট রিজলভ’-এ যুক্ত হয়নি। এই যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন অভিযানটি দীর্ঘদিন ধরে উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় কুর্দি নেতৃত্বাধীন এসডিএফ-এর সঙ্গে যৌথভাবে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসছে।
ভবিষ্যতে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার হবে কি
সিরিয়ায় মার্কিন সেনা সংখ্যা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে সব সেনা প্রত্যাহারের চেষ্টা করেছিলেন। তবে পেন্টাগনের আপত্তির মুখে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। তাদের যুক্তি ছিল, এতে কুর্দি মিত্রদের পরিত্যাগ করা হবে এবং তারা তুরস্কের সামরিক অভিযানের ঝুঁকিতে পড়বে।
তুরস্ক এসডিএফকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে দেখে, কারণ এই বাহিনীর সঙ্গে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে)-এর সম্পর্ক রয়েছে, যারা তুরস্কে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্রোহ চালিয়ে আসছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েল আক্রমণের পর গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো মার্কিন স্বার্থে হামলা শুরু করলে সিরিয়ায় মার্কিন সেনা সংখ্যা বেড়ে দুই হাজারের বেশি হয়। পরে তা আবার কমিয়ে প্রায় ৯০০-তে নামানো হয়। তবে ট্রাম্প শিগগিরই পূর্ণ প্রত্যাহারের কোনো ইঙ্গিত দেননি।
সাম্প্রতিক হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান
সাম্প্রতিক হামলার পর সিরিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন দূত টম ব্যারাক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেন, আইএসকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করার লক্ষ্যেই সীমিত সংখ্যক মার্কিন সেনা এখনো সিরিয়ায় রয়েছে।
তার ভাষায়, এই উপস্থিতি স্থানীয় সক্ষম সিরীয় অংশীদারদের শক্তিশালী করছে, যাতে তারা মাটিতে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে আরেকটি বড় আকারের, ব্যয়বহুল মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে জড়াতে না হয়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আইএস পুরোপুরি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত এই মিশন থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে আসবে না।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















