সুদানের তাওইলা শহরের একটি ছোট অপারেশন থিয়েটারে তখন জীবন-মৃত্যুর লড়াই। সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের সময় হঠাৎ এক নারীর হৃদস্পন্দন থেমে যায়। এক্স-রে নেই, সিটি স্ক্যান নেই, এমনকি রক্তের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাও করার সুযোগ নেই। তবু শেষ শক্তিটুকু দিয়ে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা চালান চিকিৎসক অ্যানি লিন। কিছু সময়ের জন্য হৃদস্পন্দন ফিরলেও পরদিন সেই নারী মারা যান। রেখে যান দশ সন্তান। একদিনেই তারা হারায় তাদের মাকে।
এই অভিজ্ঞতাই সুদানে কাজ করা চিকিৎসক অ্যানি লিনের কাছে সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। তাইওয়ানের এই অ্যানেসথেটিস্ট আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা চিকিৎসকবিহীন সীমান্তের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের নগ্ন সত্য।
হঠাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে যাত্রা
ডা. অ্যানি লিনের পরিকল্পনায় সুদান ছিল না। তার লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ সুদান। কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে অ্যানেসথেটিস্ট প্রয়োজন হওয়ায় তাকে পাঠানো হয় তাওইলায়। দুই মাসের এই মিশন তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় বলে বর্ণনা করেন তিনি। এর আগে আফগানিস্তান ও সিয়েরা লিওনে কাজ করলেও সুদানকে তিনি বলেছেন সবচেয়ে অনুন্নত ও প্রতিকূল পরিবেশ। সেখানে প্রধান যাতায়াতের মাধ্যম গাধা ও উট।
তিন দিনের মরুভূমি পাড়ি
চাদ সীমান্ত থেকে তাওইলায় পৌঁছাতে লেগেছে প্রায় তিন দিন। চারপাশে শুধু বালি আর প্রচণ্ড তাপ। পৌঁছানোর পর দেখা যায়, লাগেজ থেকে শুরু করে থাকার জায়গা সবই ধুলা আর পোকামাকড়ে ভরা। হাসপাতালের অবস্থা আরও ভয়াবহ। কোনো এক্স-রে নেই, পরীক্ষাগারে কেবল হিমোগ্লোবিন ও রক্তে শর্করা মাপা যায়। প্রয়োজনীয় অন্যান্য পরীক্ষা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।

হাসপাতালের বাইরে রাস্তায় রাস্তায় শুয়ে আছে মানুষ। কারও জন্য বিছানা নেই, কেউ খোলা মাটিতে কম্বলের ওপর রাত কাটাচ্ছে। নভেম্বরের পর শীত নামলে রাতের তাপমাত্রা নেমে আসে পনেরো থেকে আঠারো ডিগ্রিতে।
অপ্রতুলতায় চিকিৎসা
সব বয়সের রোগীতে ভরে থাকে হাসপাতাল। অক্টোবরের আগে প্রতিদিন ছয় থেকে আটটি অস্ত্রোপচার হতো। কিন্তু ২৬ অক্টোবর এল ফাশার দখলের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। হাজার হাজার মানুষ মরুভূমি পেরিয়ে তাওইলায় আশ্রয় নেয়। গুলিবিদ্ধ, বোমার আঘাতে আহত রোগীতে অস্ত্রোপচার বেড়ে দাঁড়ায় দিনে চব্বিশটিতে।
মাত্র দুটি অপারেশন থিয়েটারে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করেন চিকিৎসকেরা। অনেক সময় না খেয়েই থাকতে হয়। পরে একটি তাঁবুতে আরও দুটি অপারেশন কক্ষ তৈরি করা হয়। স্থানীয় ও পালিয়ে আসা চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগ দেন আন্তর্জাতিক সহায়তাকারীরাও। তবু বিদ্যুৎ ও যোগাযোগব্যবস্থা ছিল অনিশ্চিত।
একবার খোলা পেটের অস্ত্রোপচারের সময় বিদ্যুৎ চলে গেলে হাতে ভেন্টিলেটর চালিয়ে রোগীকে বাঁচাতে হয়। অনেক সময় চিকিৎসকদের নিজেদের বিশেষতার বাইরে কাজ করতে হয়েছে। কানের সমস্যা থেকে শুরু করে চোখের অস্ত্রোপচার পর্যন্ত করতে হয়েছে সাধারণ সার্জনদের। ডা. লিন নিজেও বিশেষজ্ঞ না হয়েও কানের রোগীর চিকিৎসা করেছেন দূর থেকে পরামর্শ নিয়ে।
অর্ধেক বয়সের মতো শিশু
এক বছরের বেশি সময় ধরে অবরোধে খাবার ও ওষুধ প্রবেশ বন্ধ ছিল। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে শিশুদের ওপর। অনেক শিশুকে দেখে মনে হতো বয়স এক বা দুই বছর, অথচ প্রকৃত বয়স তিন বা চার। অধিকাংশই রক্তস্বল্পতায় ভুগছিল।

ভাষার দেয়াল
রোগী ও কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। মাত্র একজন অনুবাদক দুই অপারেশন কক্ষের মধ্যে ঘুরে ঘুরে কাজ করতেন। চিকিৎসা-ভাষা না জানায় অনেক সময় ইশারা আর ভঙ্গিমার ওপর ভরসা করতে হয়েছে। প্রয়োজনে মোবাইল অনুবাদ অ্যাপও ব্যবহার করেছেন ডা. লিন।
যুদ্ধ থামানোর আহ্বান
বিশ্ব কী করতে পারে জানতে চাইলে ডা. লিনের উত্তর ছিল স্পষ্ট। যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে, গণহত্যা থামাতে হবে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অর্থসহায়তা কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। মানুষের পাশে দাঁড়াতে এখন আগের চেয়ে বেশি আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন।
ফিরে যাওয়ার অঙ্গীকার
সব ক্লান্তি আর মানসিক আঘাত সত্ত্বেও ডা. অ্যানি লিন আবারও তাওইলায় ফিরতে প্রস্তুত। তার ভাষায়, যেসব জায়গায় তিনি কাজ করেছেন, তার মধ্যে সুদানেই সহায়তার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















