মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপ করা নতুন নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার দুই শীর্ষ তেল কোম্পানি লুকওইল ও রোসনেফটকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে বড় ধরনের পুনর্বিন্যাসের ইঙ্গিত দিচ্ছে। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে জ্বালানি বিনিয়োগের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক প্রভাব বাড়ানোর যে কৌশল মস্কো অনুসরণ করে আসছিল, এই নিষেধাজ্ঞা তা কার্যত উল্টে দিতে পারে।
নভেম্বরে কার্যকর হওয়া নিষেধাজ্ঞার চাপ
গত অক্টোবরে ট্রাম্প প্রশাসন লুকওইল ও রোসনেফটের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যা আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয় একুশ নভেম্বর থেকে। এই দুই কোম্পানি সরাসরি ও পরোক্ষভাবে রাশিয়ার মোট তেল রপ্তানির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে নিষেধাজ্ঞার আঘাত গিয়ে পড়ে সরাসরি ক্রেমলিনের রাজস্বভিত্তিতে। হিসাব অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে রাশিয়ার তেল ও গ্যাস থেকে আয় এক বছর আগের তুলনায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে।
রাজস্ব সংকটে মস্কোর চাপ বাড়ছে
রাশিয়ার মোট ফেডারেল আয়ের প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে জ্বালানি খাত থেকে। ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের পর আরোপিত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই এই খাত চাপে ছিল। তবে এবার তেল কোম্পানিগুলোকেই সরাসরি লক্ষ্য করায় পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়েছে। তুরস্ক, ভারত ও ব্রাজিল ইতোমধ্যে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল কেনা কমিয়েছে। অনেক চালান ক্রেতা না পেয়ে সমুদ্রে ভাসছে, যা রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছেছে। চীন কিছু পরিমাণ তেল নিলেও রাশিয়াকে আগের চেয়ে আরও বড় ছাড়ে তেল বিক্রি করতে হচ্ছে।

আগের নিষেধাজ্ঞা কেন পুরোপুরি কাজ করেনি
এর আগে মূল্যসীমা, কূটনৈতিক চাপ ও নৌপরিবহন বিধিনিষেধ রাশিয়ার অর্থনীতিতে আংশিক প্রভাব ফেলেছিল। কারণ সেগুলো মূলত পরিবহন ও অর্থায়ন ব্যবস্থাকে লক্ষ্য করেছিল, কোম্পানির মূল কাঠামোকে নয়। এবার যুক্তরাষ্ট্র দেখিয়ে দিল, রাশিয়ার সবচেয়ে বড় তেল কোম্পানিগুলোও নিষেধাজ্ঞার বাইরে নয়।
সম্পদ বিক্রি ও মালিকানা বদলের সম্ভাবনা
নতুন নিষেধাজ্ঞার ফলে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় লুকওইল ও রোসনেফটের সম্পদ বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। এতে বড় বড় তেলক্ষেত্র ও শোধনাগারের মালিকানা বদল হবে এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলা নতুন পথে মোড় নেবে। এই পরিবর্তন শুধু স্বল্পমেয়াদি নয়, দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের ধারা ও বাণিজ্যিক সম্পর্কও বদলে দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িক অনুমোদনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই লুকওইল তাদের প্রায় দুই হাজার দুইশ কোটি ডলারের আন্তর্জাতিক সম্পদ বিক্রির চেষ্টা করছে। এতে পশ্চিমা বিনিয়োগকারী ও মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোর জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হতে পারে।
কোথায় বেশি আগ্রহ
বিনিয়োগকারীদের নজর রয়েছে ইরাকের ওয়েস্ট কুরনা ক্ষেত্র, কাজাখস্তানের কারাচাগানাক ও তেঙ্গিজ, আজারবাইজানের শাহ দেনিজসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রে। পাশাপাশি মেক্সিকো, ঘানা, নাইজেরিয়া ও মিসরেও রাশিয়ার সম্পদ নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে।
ইউরোপে রুশ প্রভাবের ক্ষয়
ইউরোপে লুকওইলের শোধনাগারগুলো ছিল রাশিয়ার জ্বালানি প্রভাবের মূল স্তম্ভ। বুলগেরিয়া, রোমানিয়া ও নেদারল্যান্ডসে এসব স্থাপনা বিক্রি করতে হতে পারে। ফিনল্যান্ডে চার শতাধিক জ্বালানি স্টেশন বন্ধের প্রস্তুতিও চলছে। বুলগেরিয়ায় সরকার ইতোমধ্যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা বসিয়ে এপ্রিলের শেষের মধ্যে সম্পদ বিক্রির প্রক্রিয়া শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে। রোমানিয়া নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি মানতে গিয়ে পেট্রোটেল শোধনাগার বিক্রির গতি বাড়িয়েছে। মলদোভা জ্বালানি সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে বিমান জ্বালানি অবকাঠামো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।

হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়ার ভূমিকা
ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া এখনো বিশেষ ছাড়ের আওতায় রাশিয়ার তেল আমদানি করছে। হাঙ্গেরি যদি এই আমদানি বন্ধ না করে, তাহলে সেটিই ইউরোপে রাশিয়ার শেষ বড় তেল বাজার হয়ে থাকতে পারে।
বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তনের ইঙ্গিত
এই নিষেধাজ্ঞা শুধু অপরিশোধিত তেল নয়, পরিশোধিত পণ্যের বাজারেও প্রভাব ফেলতে পারে। যদিও এসব পণ্যের উৎস শনাক্ত করা এখনো ইউরোপীয় কর্তৃপক্ষের জন্য কঠিন। তবুও বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে জ্বালানি কোম্পানির মাধ্যমে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের যে কৌশল রাশিয়া নিয়েছিল, তা এখন বড় মোড়ের মুখে। বৈশ্বিক জ্বালানি শক্তির ভারসাম্যে এক সিদ্ধান্তমূলক পরিবর্তন শুরু হয়ে যেতে পারে।
#রাশিয়ারতেলসংকট #ট্রাম্পনিষেধাজ্ঞা #বিশ্বজ্বালানিবাজার #রুশঅর্থনীতি #তেলরাজনীতি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















