টানা তিন দশক ধরে বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থান ঘটেছিল অবিরাম বিনিয়োগের জোরে। নতুন কারখানা, অবকাঠামো, আবাসন—সব ক্ষেত্রেই প্রতি বছর বাড়ছিল ব্যয়। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতা এবার ভাঙতে চলেছে। চলতি বছর চীনের সামগ্রিক বিনিয়োগ আশির দশকের শেষের পর প্রথমবারের মতো কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা দেশটির অর্থনীতিতে এক বড় ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিনিয়োগে ছন্দপতন এবং নতুন বাস্তবতা
অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত সম্পদভিত্তিক বিনিয়োগে জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আগের বছরের তুলনায় প্রায় দুই শতাংশ হ্রাস দেখা গেছে। বছরের দ্বিতীয়ার্ধে শুরু হওয়া এই পতন অক্টোবরে এসে আরও তীব্র হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, নভেম্বরেও এই ধারা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা প্রবল। একসময় কোনো একটি খাতে মন্দা দেখা দিলে অন্য খাতের বিনিয়োগ তা সামলে নিত। কিন্তু এবার সম্পত্তি, অবকাঠামো ও উৎপাদন—এই তিন প্রধান খাতেই একসঙ্গে ধস নামছে, যা চীনের জন্য বিরল ঘটনা।
রিয়েল এস্টেট সংকটের দীর্ঘ ছায়া
পাঁচ বছর ধরে চলা আবাসন খাতের সংকট চীনের অর্থনীতিকে ভেতর থেকে দুর্বল করে তুলেছে। অতিরিক্ত ফ্ল্যাট, দাম কমতে থাকা সম্পত্তি এবং ক্রেতাদের অনাস্থা ব্যবসায়িক আস্থায় বড় ধাক্কা দিয়েছে। স্থানীয় সরকারগুলোও রাজস্ব সংকটে পড়ে আগের মতো অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থ ঢালতে পারছে না। ফলে বিমানবন্দর, সড়ক কিংবা দ্রুতগতির রেল প্রকল্পে নতুন করে গতি আসেনি।
সরকারের সংযত নীতি ও বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা
আগে অর্থনৈতিক ধাক্কা সামাল দিতে সরকার উদারভাবে ব্যয় বাড়াত। কিন্তু এবার বেইজিং তুলনামূলকভাবে সংযত অবস্থানে। অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা ঠেকাতে নেওয়া সরকারি পদক্ষেপ উৎপাদন খাতে বিনিয়োগের আগ্রহও কমিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, রপ্তানির ওপর আস্থা রেখেই সরকার আপাতত বড় প্রণোদনা থেকে দূরে থাকছে, যদিও বৈশ্বিক সুরক্ষাবাদ ও শুল্ক অনিশ্চয়তা সেই আস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে।
বড় কোম্পানির সংকট এবং বাজারের বার্তা
চীনের অন্যতম বৃহৎ আবাসন কোম্পানি ভানকের আর্থিক টানাপোড়েন বিনিয়োগ সংকটের বাস্তব চিত্র তুলে ধরছে। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে কোম্পানিটি প্রথমবারের মতো বন্ড পরিশোধে সময় চাইতে বাধ্য হয়েছে। এতে স্পষ্ট হচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সহায়তার সীমাও হয়তো ছুঁয়ে গেছে। একই সঙ্গে উৎপাদন ও বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, অনিশ্চয়তার কারণে অনেক কারখানা বিনিয়োগ স্থগিত বা সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছে।
অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্বন্দ্ব
সরকার যেখানে পাঁচ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যের কথা বলছে, সেখানে কিছু গবেষণা সংস্থা মনে করছে প্রকৃত প্রবৃদ্ধি তার চেয়ে কম। বিনিয়োগ জিডিপির বড় অংশ হওয়ায় এই মন্দা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিকে চাপে ফেলতে পারে। যদিও সরকারি গণমাধ্যম বলছে, চীন এখন উচ্চমানের উন্নয়নের নতুন ধাপে প্রবেশ করছে এবং বিনিয়োগ কমা মানেই সংকট নয়।
বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বার্তা
চীনের বিনিয়োগে এই ঐতিহাসিক মোড় কেবল দেশটির ভেতরেই নয়, বৈশ্বিক বাজারেও প্রভাব ফেলতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে নিশ্চিত বলে মনে করা চীনে বিনিয়োগ এখন আর আগের মতো নির্ভরযোগ্য মনে হচ্ছে না। ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের ভূমিকা নতুনভাবে মূল্যায়নের সময় এসে গেছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















