পৃথিবীর সবচেয়ে শুষ্ক অঞ্চলগুলোর একটি ওমান। যেখানে বছরের পর বছর বৃষ্টি না হওয়াই স্বাভাবিক, সেখানেই এখন বারবার নামছে প্রাণঘাতী ঢল। পাহাড়ি মরুভূমির ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া শুকনো খাল বা ওয়াদি মুহূর্তে রূপ নিচ্ছে উত্তাল নদীতে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অতিবৃষ্টি এখন ওমানের নতুন বাস্তবতা হয়ে উঠেছে, আর সেই বাস্তবতা কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ, ভেঙে দিচ্ছে শতাব্দীপ্রাচীন জীবনব্যবস্থা।
শান্ত গ্রামের শেষ সকাল
মাস্কাটের দক্ষিণে পাহাড়ঘেরা গ্রাম সামাদ আল শান। এপ্রিলের এক সকালে দুই প্রবীণ শেখ, সাইফ ও নাসের আল মাওয়ালি, সাদা গাড়িতে করে যাচ্ছিলেন এক জানাজায়। একই পাড়ায় থাকা, একসঙ্গে নামাজ পড়া, আজীবনের বন্ধু এই দুই চাচাতো ভাই বুঝতেই পারেননি, আকাশের কালচে রং তাদের শেষ যাত্রার ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক বছরের বেশি বৃষ্টি একসঙ্গে নেমে আসে গ্রামে। ওয়াদি মুহূর্তে ফুলে ওঠে। গাড়ি থেকে নামিয়ে বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে সাইফ নিজেও আর ফিরতে পারেননি। এখন তারা পাশাপাশি শুয়ে আছেন একই কবরস্থানে।
ওয়াদির গ্রামে আতঙ্ক
ওমানে বহু গ্রাম গড়ে উঠেছে ওয়াদির ধার ঘেঁষে। বছরের বেশির ভাগ সময় শুকনো থাকায় এসব জায়গায় বসতি গড়া সহজ ছিল। কিন্তু এখন অতিবৃষ্টির ফলে এই ওয়াদিগুলোই হয়ে উঠছে মৃত্যুফাঁদ। সামাদ আল শানে মানুষ দেখেছে, পরিচিত শান্ত খাল কয়েক মিনিটে কীভাবে ভয়ংকর নদীতে বদলে যায়। যাদের দুই বাড়ি ছিল, এক নিচে এক উঁচুতে, তারাও সময়মতো সরে যেতে পারেননি।
শিশুদের মৃত্যু, ক্ষত এখনো টাটকা
সেই দিনের বন্যায় সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি ঘটে একটি স্কুলকে ঘিরে। ঝড় শুরু হলেও একটি স্কুলে শিক্ষার্থীদের ছুটি দেওয়া হয়নি। অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে এলেও দেরি হয়ে যায়। একটি গাড়ি ওয়াদি পার হতে গিয়ে আটকে পড়ে। পরিবারের দশটি শিশু স্রোতে ভেসে মারা যায়। আজও সেই শোক সামাদ আল শানের মানুষের কণ্ঠে। পরিবারগুলো সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। অভিযোগ, সতর্কতা যথেষ্ট ছিল না।
মরুভূমিতে বদলে যাওয়া আবহাওয়া
ওমানে বছরে গড়ে চার ইঞ্চিরও কম বৃষ্টি হয়। পানীয় জলের বড় অংশ আসে সমুদ্রের পানি শোধন করে। কিন্তু উষ্ণ সমুদ্র থেকে বেশি জলীয় বাষ্প টেনে নিচ্ছে ঘূর্ণিঝড় ও ঝড়বৃষ্টি। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টির দিন কমলেও অল্প সময়ে অত্যন্ত বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। গত তিন দশকে আকাশের শক্তিশালী আর্দ্রতা প্রবাহ ওমানের ওপর আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়।
ঘূর্ণিঝড়ের বাড়বাড়ন্ত
এক সময় আরব সাগরের শক্তিশালী ঝড় খুব কমই ওমানে আঘাত হানত। কিন্তু দুই হাজার সাত সালে ঘূর্ণিঝড় গোনু মাস্কাটে আঘাত হেনে সব পাল্টে দেয়। এরপর একের পর এক শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় উপকূলে এসেছে। দুই হাজার একুশ সালের ঘূর্ণিঝড় শাহিন একাই কিছু এলাকায় বছরের ছয় গুণ বৃষ্টি ঝরিয়েছে। বাঁধ উপচে পড়েছে, শত শত ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে।
বিজ্ঞানীদের সতর্কতা ও উপেক্ষা
ওমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা বহু বছর ধরেই সতর্ক করে আসছেন। ওয়াদিতে হঠাৎ বন্যার ঝুঁকি বোঝার জন্য মানচিত্র ও পূর্বাভাস ব্যবস্থার প্রস্তাব দিলেও শুরুতে তা গুরুত্ব পায়নি। শাহিনের পর পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। এখন ড্রোন ও উপগ্রহচিত্র ব্যবহার করে ওয়াদির আচরণ বোঝার চেষ্টা চলছে। লক্ষ্য একটাই, বৃষ্টি হলে কত পানি নামবে, কত দ্রুত নামবে, তা আগেই জানা।
বাঁধ, সুড়ঙ্গ আর প্রকৌশল সমাধান
ওমানে পাহাড়ে পাহাড়ে বাঁধ নির্মাণ চলছে, যাতে হঠাৎ নেমে আসা পানি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। নতুন আশ্রয়কেন্দ্রের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেশী দুবাই আরও এক ধাপ এগিয়ে ভূগর্ভে বিশাল জলনিষ্কাশন সুড়ঙ্গ বানাচ্ছে, যাতে শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ঝড়েও শহর ডুবে না যায়। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, প্রকৌশল কি প্রকৃতির গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে?
পুরোনো ভুল, নতুন বিপদ
সব প্রচেষ্টার মাঝেও মানুষ আবার ওয়াদির ভেতর ঘর তুলছে। সস্তা জমি, সহজ সম্প্রসারণের লোভ ছাড়তে পারছে না অনেকে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ত্রিশ বছর আগের ওয়াদি আর আজকের ওয়াদি এক নয়। কিন্তু এই উপলব্ধি এখনো সবার মধ্যে পৌঁছায়নি।
হঠাৎ নেমে আসা মৃত্যুর ঢল
সেই বন্যার সকালে এক বাসচালক বুদ্ধিমত্তায় শিক্ষার্থীদের উঁচু জায়গায় পাঠিয়ে নিজে বেঁচে যান। কিন্তু অন্য অনেকেই পারেননি। সামাদ আল শানে আজও মানুষ বলে, এই বন্যা কোনো সতর্ক সংকেত ছাড়াই এসেছিল। দুই প্রবীণ শেখের গল্প সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়। একজন হয়তো বাঁচতে পারতেন, কিন্তু বন্ধুকে ফেলে যেতে পারেননি।
মরুভূমির দেশে বৃষ্টি ছিল আনন্দের উৎস। এখন সেই বৃষ্টি আতঙ্কের নাম। ওমানের সামনে প্রশ্ন একটাই, বদলে যাওয়া প্রকৃতির সঙ্গে তাল মেলাতে তারা কতটা প্রস্তুত।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















