বাংলাদেশের একজন সিনিয়র সাংবাদিক আনিস আলমগীরকে রাতভর ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে আটক রাখার পর সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা একটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। ওই মামলায় অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনসহ আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে।
সোমবার বিকালে আদালতে হাজিরের পর আনিস আলমগীরকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
মামলায় গ্রেফতার দেখানোর আগে তাদের বিরুদ্ধে থানায় যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে তাতে, সামাজিক মাধ্যম ও টকশোতে বসে ‘আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনার প্রোপাগান্ডা চালানোর’ অভিযোগ আনা হয়েছে।
মি. আলমগীর সাম্প্রতিক সময়ে টেলিভিশন টকশো ও সামাজিক মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমালোচনা করে আলোচনায় এসেছিলেন।
ফলে তাকে গ্রেফতার করায় প্রশ্ন উঠছে, ‘সরকারের সমালোচনা’ করা গ্রহণ করা হবে না, এমন বার্তাই এই গ্রেফতারের মাধ্যমে দেওয়া হলো কিনা।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলার যে অভিযোগ উঠেছিল, এখন আবার সেই ভয়ের সংস্কৃতিই ফিরে এসেছে কিনা সেই প্রশ্নও উঠছে।
এই গ্রেফতারের ঘটনায় উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র। এ ধরনের গ্রেফতার ‘ভিন্নমত দমনের একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে,’ বলে মন্তব্য করেছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশের ‘কর্তৃত্ববাদ পতন-পরবর্তী বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিস্থিতি’ নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি।
সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ডঃ ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, “যে যুক্তিতেই (মি.আলমগীরকে) আটক করা হোক না কেন এটি প্রশ্নবিদ্ধ। সরকার ভুল বার্তা দিচ্ছে”।
“মুক্ত গণমাধ্যম, বাকস্বাধীনতা ও ভিন্নমত দমনে অব্যাহত বলপ্রয়োগ, আইনের অপপ্রয়োগ ও রাষ্ট্রীয় সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার অপব্যবহারের দায় অন্তর্বর্তী সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারেনা”, বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন।
অন্যদিকে পরিস্থিতিকে দুর্ভাগ্যজনক আখ্যায়িত করে দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, চব্বিশের পরিবর্তনের পরে এমন পরিস্থিতি তিনি আশা করেননি।
“আশা করেছিলাম মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। স্বাধীনতার নামে হঠকারিতা যেন না করি তাও খেয়াল রাখতে হবে। তবে এসব ঘটনা আমাকে আতঙ্কিত করে। কেন জানি মনে হয় আগের পরিস্থিতিতির দিকেই যাচ্ছি আমরা। আমার মনে হয় সরকার প্রধান দৃষ্টি না দিলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে,” বলছিলেন মি. চৌধুরী।
এই গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়ে সম্পাদক পরিষদ বলেছে, ”এ ধরনের আচরণ অতীতের স্বৈরাচারী শাসনামলে সাংবাদিকদের প্রতি রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের স্মৃতি উসকে দেয়”। একজন সাংবাদিককে অভিযোগ ছাড়াই ডিবি কার্যালয়ে ডেকে নেওয়া, সেখানে আটকে রাখা, পরে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেফতার দেখানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আনিস আলমগীরকে ঘিরে যা ঘটেছে
এক সময়ের জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক আজকের কাগজ এর সাংবাদিক হিসেবে ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধ কাভার করতে গিয়ে দেশজুড়ে পরিচিতি পেয়েছিলেন আনিস আলমগীর।
এরপর তিনি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে কাজের পাশাপাশি বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার শিক্ষকতা করেছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে টেলিভিশন টকশো ও সামাজিক মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের কড়া সমালোচনা করে আলোচনায় এসেছেন তিনি।
এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পাল্টা আক্রমণেরও শিকার হচ্ছিলেন তিনি।
রোববার সন্ধ্যায় ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার একটি জিম থেকে ডিবি প্রধান কথা বলবেন- এই কথা বলে তাকে ডিবি অফিসে নিয়ে যায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বা ডিবির একটি দল।
এরপর গভীর রাতে আনিস আলমগীর ও অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনসহ আরও মোট পাঁচজনের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি অভিযোগ দেন ‘জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স’ নামে একটি সংগঠনের সংগঠক আরিয়ান আহমেদ।
তিনি তার অভিযোগে বলেন, “অভিযুক্তরা ২০২৪ সালের পাঁচই আগস্টের পর থেকে সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন টেলিভিশনের টকশোতে বসে নিষিদ্ধ সংগঠনকে (আওয়ামী লীগ) ফিরিয়ে আনার প্রোপাগান্ডা চালিয়ে আসছে। এর মাধ্যমে তারা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের পাঁয়তারা করছে”।
সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে পরে হওয়া মামলায় মি. আলমগীরকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান শফিকুল ইসলাম।
সোমবার বিকালে তাকে ঢাকার আদালতে হাজির করে সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। আদালত পাঁচদিনের রিমান্ড দিয়েছে।

সমালোচনা না করার বার্তা?
মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন বলছেন, “স্বৈরাচারের সময়ে কণ্ঠরোধের জন্য যা করা হতো দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ সরকারের সময়ে তাই করা হলো এবং এটার সাথে যোগ হয়েছে মব । এ বিষয়ে সরকার নতজানু দৃষ্টিভঙ্গিই দেখিয়েছে”।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৪ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া তার প্রথম ভাষণে সবাইকে মন খুলে সমালোচনার আহবান জানিয়েছিলেন।
তিনি তখন বলেছিলেন, “সংবাদমাধ্যম ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ইতোমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা সবাইকে বলে দিয়েছি, আপনারা মন খুলে আমাদের সমালোচনা করেন। আমরা সবার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল”।
যদিও এই সময়ের মধ্যেই অন্তত ১৮ জন সাংবাদিককে গ্রেফতার ও তিনশর বেশি সাংবাদিককে বিভিন্ন মামলার আসামি করা হয়েছে।
বাংলাদেশে কারাবন্দি চার সাংবাদিক ফারজানা রূপা, শাকিল আহমেদ, মোজাম্মেল বাবু ও শ্যামল দত্তকে দীর্ঘদিন ধরে বন্দি করে রাখায় ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করে তাদের মুক্তি দিতে সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা -কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)।
সংস্থাটি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে লেখা এক চিঠিতে বলেছে, তাদের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে চারজন সাংবাদিক হত্যা মামলায় আটক আছেন, যে অভিযোগগুলোর পক্ষে ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই’ এবং তাদের ‘সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে’ তাদের এসব মামলায় জড়ানো হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
এই চার সাংবাদিককে হত্যা মামলার আসামি করা নিয়ে অনেক আগেই প্রশ্ন উঠছিলো। এছাড়া চলতি বছর অগাস্টে একটি আলোচনা সভায় যোগ দিতে গিয়ে ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্না সহ কয়েকজনকে।
টিআইবির পক্ষ থেকে গত ৯ই ডিসেম্বর কর্তৃত্ববাদের পতন-পরবর্তী বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিস্থিতি শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ৫ই অগাস্টের পর থেকে চলতি বছর পহেলা নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে কমবেশি ৪৭৬টি ঘটনায় ১০৭৩ জন গণমাধ্যম কর্মী হামলা, মামলা, হত্যা, হয়রানিসহ বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ডঃ ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, তারা তিনশর বেশি সাংবাদিককে মামলার আসামি করার তথ্য পেয়েছেন।

এছাড়া চলতি বছর নভেম্বরের শুরুতে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পর হত্যা ও সহিংসতা মামলার বেড়াজালে জড়িয়ে আছে অন্তত ২৯৬ জন সাংবাদিকের নাম”।
মামলাগুলো বিশ্লেষণ করে পত্রিকাটি মন্তব্য করেছে: “বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জুলাইয়ে নিহতদের ত্যাগের বিচার প্রতিষ্ঠার বদলে মামলাগুলো এখন রাজনৈতিক লড়াইয়ের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে”।
অন্যদিকে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের অগাস্ট থেকে ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৫২৩টি সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে আনিস আলমগীরের গ্রেফতারের পর সে কারণেই অনেকে প্রশ্ন তুলছেন যে – সরকারের সমালোচনা করা যাবে না – এই ইঙ্গিতই তাকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে দেয়া হলো কিনা।
ডঃ ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, তিনি (আনিস আলমগীর) একজন গণমাধ্যম কর্মী এবং এ ধরনের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন বিবেচনা করার কোনো সুযোগ নেই।
” বরং প্রশাসন, আইনপ্রয়োগকারী, নজরদারি ও গোয়েন্দা সংস্থা এবং ন্যয়বিচারে নিবেদিত সংশ্লিষ্ট মহলের কর্তৃত্ববাদী চর্চায় যে কোনো পরিবর্তন হয়নি, তারই উদ্বেগজনক উদাহরণ। রাষ্ট্রসংস্কারের মাধ্যমে জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে যেমন ক্রমাগত ধুলিস্যাত হচ্ছে, তেমনি নির্বাচন পরবর্তী রাষ্ট্রকাঠামোতে এই চর্চা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনাও প্রতিনিয়ত বাড়ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
আনিস আলমগীরের গ্রেফতারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলেছে, ”একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রয়োগ করা হয়েছে, যা স্পষ্টতই আইনটির উদ্দেশ্য ও পরিধির অপপ্রয়োগের শামিল”।
”মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। এই অধিকার খর্ব করতে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মতো কঠোর আইন ব্যবহার করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।…গ্রেফতারকে যেন ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা না হয়” বলেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র।
যদিও সরকারের তরফ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে সংবাদপত্র বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়নি। যাদের আটক করা হয়েছে বা যেসব সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তাদের ‘স্বৈরাচারের দোসর” কিংবা ‘বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী’ হিসেবেও সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করছেন সরকারপন্থি হিসেবে পরিচিত অনেকেই।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, “গত ৫৩ বছরে স্বাধীনতার পর গণমাধ্যমে এত বেশি স্বাধীনতা কেউ কোনও দিন এনজয় করেননি”।
নভেম্বরে তিনি সিরডাপ মিলনায়তনে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা : ইশতেহারে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি প্রসঙ্গ’ শীর্ষক সংলাপে অংশ নিয়ে বলেছেন “অন্তর্বর্তী সরকারের সময় গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা সুরক্ষিত আছে। আওয়ামী লীগের আমলে সাংবাদিকতা তলানিতে ঠেকিয়েছিল। সে জায়গা থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি”।
বিবিসি বাংলা
Sarakhon Report 


















