মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চলতি বছরের এপ্রিলে প্রায় এক শতাব্দীর মধ্যে সর্বোচ্চ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। তাঁর দাবি ছিল, এই শুল্ক মার্কিন উৎপাদন খাতকে চাঙ্গা করবে, মধ্যবিত্তদের চাকরি ফিরিয়ে দেবে এবং অর্থনীতিকে নতুন গতি দেবে। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের বড় একটি অংশ তখনই আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এই সিদ্ধান্ত দেশকে মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে। কয়েক মাস পর বাস্তব চিত্র বলছে, দুই পক্ষেরই বড় ধরনের হিসাব ভুল হয়েছে।
ঘোষণা ও বাস্তবতার ফারাক
শুল্ক ঘোষণার পরপরই ট্রাম্প আশাবাদী সুরে বাজার চাঙা হওয়ার কথা বলেন। বিপরীতে বড় বিনিয়োগ সংস্থা ও ব্যাংকগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা তখন মন্দার সতর্কতা দেন। বাস্তবে এখন পর্যন্ত না বড় ধরনের অর্থনৈতিক পতন হয়েছে, না ট্রাম্পের প্রতিশ্রুত পূর্ণাঙ্গ পুনরুজ্জীবন দেখা গেছে। সরকারি তথ্য দেরিতে এলেও ইঙ্গিত মিলছে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি টিকে আছে এবং আগামী এক বছরে মন্দার সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
চাকরির বাজারে মিশ্র চিত্র
শুল্কের ফলে লক্ষ লক্ষ নতুন চাকরি হবে—এমন প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বরং বিভিন্ন শিল্পে ছাঁটাইয়ের খবর সামনে এসেছে। যদিও একটি মাসে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি চাকরি সৃষ্টি হয়েছে, সামগ্রিকভাবে বেকারত্বের হার বেড়ে চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। উৎপাদন খাত এখনো বিদেশি কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল, যা শুল্কের কারণে ব্যয় বাড়াচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে কারখানা বন্ধ ও কর্মসংস্থান হ্রাসে।
দামের চাপ ও মূল্যস্ফীতি
শুল্কের বোঝা অন্য দেশ বহন করবে—এই দাবি বাস্তবে মিলেনি। বড় খুচরা বিক্রেতারা দ্রুতই পণ্যের দাম বাড়িয়েছে, ফলে ভোক্তাদের ব্যয় বেড়েছে। তবে আশঙ্কা করা মাত্রায় মূল্যস্ফীতি বাড়েনি। সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি মাঝারি মাত্রায় থাকলেও শুল্কের পূর্ণ প্রভাব ধাপে ধাপে অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়বে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আশঙ্কা রয়েছে।
রাজস্ব বাড়লেও সীমা স্পষ্ট
শুল্ক থেকে সরকারের রাজস্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। কয়েক মাসেই মাসিক আদায় আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। তবু এই আয় আয়করকে প্রতিস্থাপন করার মতো নয়। ভবিষ্যতে এই রাজস্ব টিকে থাকবে কি না, তা অনেকটাই নির্ভর করছে শুল্ক আরোপের আইনি বৈধতা নিয়ে চলমান বিচারিক সিদ্ধান্তের ওপর।
প্রবৃদ্ধিতে অপ্রত্যাশিত সহায়তা
শুল্ক সত্ত্বেও সাম্প্রতিক প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি শক্ত অবস্থানে রয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে বিনিয়োগের জোয়ার অর্থনীতিকে বাড়তি গতি দিয়েছে। শেয়ারবাজারের উত্থান ভোক্তা ব্যয়ও ধরে রেখেছে। পাশাপাশি, চীনের সঙ্গে শুল্কহার ধাপে ধাপে কমানোসহ নীতিতে বারবার পরিবর্তন বাজারকে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে।
উৎপাদন খাতে অনিশ্চয়তা
দেশীয় শিল্প শক্তিশালী করার লক্ষ্য থাকলেও বাস্তবে উৎপাদন কার্যক্রম টানা কয়েক মাস সংকুচিত। শুল্ক নীতির ঘনঘন পরিবর্তন বিনিয়োগ পরিকল্পনায় অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে। বড় কোম্পানির ঘোষিত বিনিয়োগ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সময় লাগবে, আর সেগুলোর পেছনে শুল্ক ছাড়াও অন্যান্য কারণ রয়েছে বলে বিশ্লেষকদের মত।
বাণিজ্য ঘাটতির নতুন হিসাব
শুল্কের প্রভাবে আমদানি ও রপ্তানি প্রবাহে বড় ওঠানামা হয়েছে। এক পর্যায়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমলেও বছরের সামগ্রিক চিত্রে তা এখনো বেশি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাণিজ্য ঘাটতি সব সময় নেতিবাচক নয়; এটি সঞ্চয় ও বিনিয়োগের ধরনকেও প্রতিফলিত করে। বাজারে শুল্ক নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলে এই অস্থিরতা চলতেই থাকবে।
মূল বক্তব্য
ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে আশাবাদ ও ভয়—দুটোরই বড় অংশ বাস্তবে মিলেনি। অর্থনীতি ভেঙে পড়েনি, আবার প্রতিশ্রুত পুনর্জাগরণও আসেনি। সামনে কী হবে, তা নির্ভর করছে নীতির স্থিরতা, আইনি সিদ্ধান্ত এবং বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রবণতার ওপর।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















