ভেনেজুয়েলার ওপর চাপ প্রয়োগের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থান ক্রমেই জটিল ও অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। প্রশাসনের ভেতরে ভেতরে একাধিক যুক্তি তুলে ধরে এই চাপের অভিযান চালানো হলেও, এর চূড়ান্ত লক্ষ্য কী—তা স্পষ্ট নয়। ফলে ট্রাম্পের সহযোগীরাও নিশ্চিত নন, শেষ পর্যন্ত কোন পথে এগোচ্ছে হোয়াইট হাউস।
গত মাসে শীর্ষ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সঙ্গে টানা তিন দিনের কৌশলগত বৈঠকের পর ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য একটি সামরিক পদক্ষেপ নিয়ে তিনি ‘মোটামুটি’ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। তবে সেই পদক্ষেপ কী হতে পারে, সে বিষয়ে তিনি সাংবাদিকদের কিছু জানাননি। এই বক্তব্য একদিকে ভেনেজুয়েলার ওপর চাপ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিলেও অন্যদিকে ট্রাম্পের উদ্দেশ্য নিয়ে অনিশ্চয়তাই বাড়িয়ে দেয়।
এই সপ্তাহে সেই চাপ নতুন মাত্রা পায়, যখন ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানির ওপর আংশিক অবরোধ আরোপের নির্দেশ দেন এবং দখল করে নেওয়া মার্কিন তেল সম্পদ ফেরত দেওয়ার দাবি তোলেন। এর আগে তিনি ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাং সদস্য ও অভিবাসী পাঠানো বন্ধ করতে, মাদক পাচারকারীদের ঠেকাতে এবং ক্ষমতা ছাড়তে।
তবে ট্রাম্প কত দূর পর্যন্ত যেতে প্রস্তুত, তা এখনো অজানা। দক্ষিণ ক্যারোলিনার রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসি গ্রাহাম বলেন, “আমি জানতে চাই, এরপর কী হবে। মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে নামানোই যদি নীতি না হয়, তবে সেটাই হওয়া উচিত।” মঙ্গলবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথের গোপন ব্রিফিংয়ের পর তিনি ভেনেজুয়েলা নীতিকে ‘বিভ্রান্তিকর’ বলে মন্তব্য করেন।
শেষ লক্ষ্য অস্পষ্ট
নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচন সামনে রেখে কিছু রিপাবলিকান উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, ভেনেজুয়েলায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপকে ‘মাগা’ সমর্থকদের কাছে সমর্থনযোগ্য করে তোলা কঠিন হতে পারে। কারণ এটি ঠিক সেই ধরনের দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি হস্তক্ষেপ, যেটির বিরুদ্ধে ট্রাম্প বরাবরই কথা বলে এসেছেন। তবে হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ সুজি ওয়াইলস ভ্যানিটি ফেয়ারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ট্রাম্পের লক্ষ্য মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র আন্না কেলি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে মাদক প্রবাহ বন্ধ করতে এবং দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে প্রেসিডেন্ট আমেরিকার সব ধরনের শক্তি ব্যবহারে প্রস্তুত।”
তবে কলোরাডোর ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি জেসন ক্রো, যিনি সশস্ত্র বাহিনী ও গোয়েন্দা কমিটির সদস্য, বলেন, “যদি কোনো সুসংহত কৌশল থেকে থাকে, কংগ্রেস তা শোনেনি। এখানে কোনো স্পষ্ট শেষ লক্ষ্য দেখা যাচ্ছে না।”
বিশ্লেষকদের মতে, মাদুরোকে সরানোকে প্রকাশ্যে লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করতে ট্রাম্পের অনীহার পেছনে রয়েছে তাঁর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি এবং বিদেশে সরকার উৎখাতের চেষ্টা তাঁকে সেই ধরনের সংঘাতে জড়িয়ে ফেলতে পারে—যার তিনি বরাবর বিরোধিতা করে এসেছেন।
মার্কিন কর্মকর্তাদের কেউ কেউ জানান, প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ আলোচনায় চাপ প্রয়োগের পক্ষে একাধিক যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে। এতে তারা নিজেরাও নিশ্চিত নন, হোয়াইট হাউস কি সত্যিই মাদুরোকে উৎখাত করতে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
‘একটি নিখুঁত ঝড়’
একই সঙ্গে ভেনেজুয়েলা ট্রাম্পের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কারণ এটি তাঁর বদলে যাওয়া অগ্রাধিকারের বহু বিষয়কে একত্র করেছে—অভিবাসী বিতাড়ন, মাদক পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই, পশ্চিম গোলার্ধজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা জোরদার এবং দেশটির বিশাল তেল ভাণ্ডারে প্রবেশাধিকার।
প্রথম ট্রাম্প প্রশাসনে ভেনেজুয়েলা–বিষয়ক দায়িত্বে থাকা সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এলিয়ট অ্যাব্রামস বলেন, “এটি একটি নিখুঁত ঝড়। ট্রাম্প প্রশাসন যে সব বিষয়ে উদ্বিগ্ন, তার সবই এখানে একসঙ্গে রয়েছে।”
ট্রাম্প নিজেও বলেছেন, লক্ষ্য অর্জন করা যেতে পারে ‘সহজ পথে’—আলোচনার মাধ্যমে—অথবা ‘কঠিন পথে’, যা ভেনেজুয়েলায় সরকার পরিবর্তনে সামরিক শক্তি ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়। সেপ্টেম্বরের শুরুতে কথিত একটি মাদকবাহী নৌযানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম হামলার পর তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি কি সরকার পরিবর্তন চান। উত্তরে তিনি বলেন, “আমরা সে বিষয়ে কথা বলছি না।”
তবে গত মাসে এক ফোনালাপে ট্রাম্প মাদুরোকে জানান, তিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা না ছাড়লে যুক্তরাষ্ট্র শক্তি ব্যবহারের কথা বিবেচনা করবে। আলোচনায় মাদুরো, তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও তাঁদের পরিবারের জন্য সাধারণ ক্ষমার দাবি উঠে আসে। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধেই ফৌজদারি মামলা ও মার্কিন আর্থিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
মাদুরো এই চাপকে যুক্তরাষ্ট্রের ব্লাফ হিসেবে দেখছেন এবং মনে করছেন, এটি ভেনেজুয়েলার প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের কৌশল। বুধবার ভেনেজুয়েলার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিমির পাদ্রিনো বলেন, “এটা তেলের জন্য, আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য। এটা মাদক পাচার বা অপরাধী গ্যাং নিয়ে নয়।”
ভেনেজুয়েলার তেল পরিবহনের বিরুদ্ধে প্রশাসনের সর্বশেষ পদক্ষেপও ট্রাম্পের কৌশল ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ট্রাম্প এটিকে ‘সম্পূর্ণ অবরোধ’ বললেও, কিছু মার্কিন কর্মকর্তা একে ‘কোয়ারেন্টিন’ হিসেবে বর্ণনা করছেন—যেখানে অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত জাহাজ চলাচল লক্ষ্য করা হবে, তবে অন্যান্য বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ হবে না। উপকূলরক্ষী বাহিনী না নৌবাহিনী—কে নেতৃত্ব দেবে, সেটিও এখনো পরিষ্কার নয়।
যে অভিযান শুরু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ড থেকে কথিত ভেনেজুয়েলান গ্যাং সদস্যদের সরানোর উদ্যোগ হিসেবে, সেটিই সেপ্টেম্বর নাগাদ রূপ নেয় সন্দেহভাজন মাদক পাচারকারী নৌযানে বোমা হামলার সামরিক অভিযানে।
তখন ট্রাম্প বলেছিলেন, “ট্রেন দে আরাগুয়াকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো বন্ধ করুন। মাদক পাঠানো বন্ধ করুন। আপনার কারাগার থেকে লোক পাঠানো বন্ধ করুন।”
এর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ২৭টি নৌযানে হামলা চালিয়েছে এবং ৯০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। ট্রাম্প একে মাদকবিরোধী যুদ্ধের নতুন অধ্যায় হিসেবে তুলে ধরলেও, একই সঙ্গে তাঁর প্রশাসন মাদুরোর ওপর চাপ আরও বাড়িয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ ভেনেজুয়েলার নেতাকে গ্রেপ্তারের তথ্যের জন্য পুরস্কার দ্বিগুণ করে ৫ কোটি ডলার করেছে এবং তাঁকে একটি গোপন মাদক পাচার নেটওয়ার্কের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত করেছে, যেটিকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
রুবিওর ভূমিকা
ট্রাম্প যখন আবার হোয়াইট হাউসে ফেরেন, তখন তিনি ইঙ্গিত দেন যে, নব–রক্ষণশীল যুদ্ধপন্থীদের প্রশাসন ও পররাষ্ট্রনীতির প্রভাব থেকে দূরে রাখবেন। কিন্তু ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করা মার্কো রুবিও লাতিন আমেরিকায় মাদুরো ও অন্যান্য বামপন্থী শাসকদের উৎখাতের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা পোষণ করে আসছেন, বিশেষ করে কিউবার ক্ষেত্রে।
সাবেক ফ্লোরিডা সিনেটর রুবিও ও তাঁর সহযোগীরা ট্রাম্পকে মাদুরোর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ চাপের নীতি নতুন করে জোরদার করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁদের যুক্তি, দুর্বল বা উৎখাত হওয়া মাদুরো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লাভজনক হবে।
তবে কিছু বিশ্লেষকের মতে, তেলবাহী জাহাজের বিরুদ্ধে সর্বশেষ পদক্ষেপসহ ট্রাম্পের এই চাপের অভিযান উল্টো ফল দিতে পারে। তাঁদের মতে, স্বৈরশাসকদের সম্পদ থেকে বঞ্চিত করলে অনেক সময় দরিদ্র জনগোষ্ঠী সরকারের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, ফলে শাসকের প্রতি সমর্থনই বাড়ে।
বাইডেন প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে লাতিন আমেরিকা–বিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা ছিলেন এমন হুয়ান গনসালেস বলেন, “যদি ট্রাম্পের উদ্দেশ্য আলোচনার পরিসর নির্ধারণ করা হয়, তাহলে অবরোধ খুব খারাপ পদক্ষেপ নয়। কিন্তু তেল অবরোধে মাদুরো ক্ষমতা ছাড়বেন—এমনটা ভাবলে প্রশাসন ভুল করবে।”
ভেনা বার্গেনগ্রুয়েন ও আলেকজান্ডার ওয়ার্ড 



















