উৎসবের এই সময়টি, প্রিয় ঐতিহ্য, পারিবারিক মিলন আর আনন্দের বার্তা নিয়ে, সবচেয়ে অন্ধকার সময়েও মানুষের মনে আলোর রেখা জাগিয়ে তোলে।
হংকংয়ে এ বছর বড়দিনের উদযাপন আনন্দের পাশাপাশি গভীর শোকের ছায়ায় ঢাকা। তাই পো এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সাতটি আবাসিক ভবন পুড়ে অন্তত ১৬১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই দুর্ঘটনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে গিয়ে শহরজুড়ে উৎসবের আমেজ অনেকটাই স্তিমিত।
২৬ নভেম্বর এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে, ঠিক তখনই যখন মৌসুমি উৎসব শুরু হচ্ছিল। শহরজুড়ে নেমে আসে শোকের আবহ। যারা স্বজন বা ঘরবাড়ি হারিয়েছেন, তাদের পাশে দাঁড়াতে মানুষ এগিয়ে আসে। কনসার্ট থেকে শুরু করে বড়দিনের পার্টি—অনেক অনুষ্ঠান স্থগিত, সীমিত বা বাতিল করা হয়।
বন্দর এলাকায় আলো ও লেজারের সিম্ফনি অব লাইটস প্রদর্শনী দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ থাকে। শহরের কেন্দ্রে বড়দিন টাউনের আলোকসজ্জাও নিভিয়ে দেওয়া হয়। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে যে আতশবাজির প্রদর্শনী হওয়ার কথা ছিল, সেটিও বাতিল করা হয়েছে। সম্মান ও স্মরণের প্রয়োজন রয়েছে। তবে উৎসবের এই সময়টি দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে শহরকে মানসিক শক্তিও জোগাতে পারে।
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন যখন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছেন, তখন বড়দিনের চেতনা নতুন করে জেগে উঠছে। আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় যে ব্যাপক সামাজিক উদ্যোগ দেখা গেছে, তা এই উৎসবের গভীর তাৎপর্যের সঙ্গেই মানানসই।
আগের বছরের তুলনায় অনেকটাই নীরব হলেও বড়দিনের অনুষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে ফিরছে। কিছু আয়োজন নতুনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশাপাশি অন্যান্য দাতব্য কাজের জন্য তহবিল তোলা যায়।
৯ ডিসেম্বর বড়দিন টাউনের আলো আবার জ্বলে ওঠে। শহরের আটটি স্থাপনায় প্রজেকশন ও এলইডি অ্যানিমেশনের মাধ্যমে এক মনোমুগ্ধকর আলোক প্রদর্শনী চলছে। রয়েছে আলোকিত স্টারলাইট বুলেভার্ডও।
সুইর প্রপার্টিজ আয়োজিত চার দিনের হোয়াইট ক্রিসমাস স্ট্রিট ফেয়ার শুরু হয় ১১ ডিসেম্বর। সেখানে আগুনে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এই মেলায় তোলা অর্থ দেওয়া হয়েছে অপারেশন সান্তা ক্লজ তহবিলে, যা প্রতিবছর সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম ও একটি সংবাদপত্র যৌথভাবে পরিচালনা করে। এ বছর তহবিলে যুক্ত হয়েছে আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য জরুরি সহায়তা আবেদন এবং ১৩টি স্থানীয় দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য অনুদান সংগ্রহ।
বছরের এই সময়ে হংকং বহুদিন ধরেই পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র। মহামারির পর থেকে শহরটি উৎসব আয়োজন আরও জোরদার করেছে, পর্যটক টানা ও ব্যয় বাড়ানোর আশায়। হংকং পর্যটন বোর্ড শীতকালীন উৎসবের প্রচার করছে, যেখানে ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিক নানা আয়োজন একসঙ্গে রয়েছে। তুষারমানব, রেইনডিয়ার, সান্তা ক্লজের সঙ্গে দেখা, জিঞ্জারমাস ও রঙিন বেলুন শোভাযাত্রাও রয়েছে।
বড়দিন টাউনে রয়েছে ২০ মিটার উঁচু একটি গাছ, খেলনা, মহাকাশযান, পুতুল ও ট্রেনে সাজানো। পশ্চিম কোলুন সাংস্কৃতিক জেলায় তৈরি হয়েছে কল্পনাময় গাছঘরসহ বড়দিনের বন। ঘুরন্ত ক্যারোসেল, উৎসবের খাবার ও উপহারের স্টল তো আছেই, এমনকি পোষা প্রাণীর জন্যও বিশেষ খাবার রয়েছে।
হংকংয়ে থাকার সময় আমি বড়দিন উপভোগ করেছি। ভালো আবহাওয়া, বন্দর এলাকার ঝলমলে আলো আর যুক্তরাজ্যের মতো দোকান বন্ধ না থাকার বিষয়টি ছিল আলাদা আনন্দের।
ঐতিহ্য ধরে রাখাও ছিল মজার। এক বছর ডিসকভারি বেতে এক বেকারি থেকে রান্না করা টার্কি কিনে ফেরিতে করে মুই উ-তে ফিরেছিলাম। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে টার্কি ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল, তবু সেটি ছাড়া বড়দিন অসম্পূর্ণ মনে হতো।
যুক্তরাজ্যে ফিরে এসব ঐতিহ্য মানা এখন সহজ। কাছের একটি এস্টেট থেকে কাটা বড়দিনের গাছ, স্থানীয় খামারের টার্কি, গ্রামের আলো—সবই মন ভরায়। সামনে ঠান্ডা পড়ার সম্ভাবনা, এমনকি সাদা বড়দিনেরও ক্ষীণ আশা আছে। তবে সব প্রস্তুতি নির্বিঘ্ন নয়। ফ্লু বাড়ায় হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে। এমন সময় আবাসিক চিকিৎসকদের পাঁচ দিনের ধর্মঘট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।

ডারহামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের স্মরণে লাগানো একটি বড়দিনের গাছ ভাঙচুর করা হয়েছিল। উৎসবের চেতনায় স্থানীয়রা সেটি আবার জোড়া লাগিয়ে মেরামত করেছেন এবং নতুন গাছের জন্য তহবিল তুলছেন।
এক সুপারমার্কেট চেইন একটি বড়দিনের কার্ড দোকান থেকে সরিয়ে নিয়েছে, যেটিকে কেউ কেউ আপত্তিকর বলে মনে করেছেন। আর একটি সফটওয়্যার কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা কেমব্রিজে একটি বড়দিনের মেলার জায়গা নিজেদের কর্মীদের পার্টির জন্য দখল করে নিয়েছিল, ফলে সাধারণ মানুষ ও শিশুরা হতাশ হয়ে ফিরেছে।
সবাই উচ্ছ্বসিত উৎসব পছন্দ করেন না। লন্ডনের এক বাসিন্দা নিজের বাড়ির সামনে বিশাল স্নোম্যান ও সান্তা বসানোর পর প্রতিবেশীর অভিযোগপত্রও পেয়েছেন।
এই সময়টি হাসি-ঠাট্টার হলেও বড়দিনের একটি গভীর, সার্বজনীন বার্তা রয়েছে। যিশুর জন্ম উদযাপনকারী এই খ্রিস্টীয় উৎসবটি আজ সারা বিশ্বে নানা সংস্কৃতিতে গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষও এটি উপভোগ করেন।
বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে একত্র হওয়ার, দেওয়ার ও ভাবার সময় এটি। শুধু আনন্দ নয়, যাদের সহায়তা দরকার, তাদের কথা ভাবার সুযোগও বড়দিন এনে দেয়।
হংকংয়ে আগুনের শিকার মানুষজন সবার মনে রয়েছেন। সিডনিতে একটি ভয়াবহ হামলায় ১৫ জনের মৃত্যুতে মানুষ শোকাহত। ইউক্রেন থেকে সুদান—যুদ্ধ চলছে নানা প্রান্তে। গাজা সংঘাতের কারণে দুই বছর বন্ধ থাকার পর বেথলেহেমে আবার বড়দিনের গাছ উঠেছে, যদিও শান্তি নাজুক।
জাতিসংঘের মতে, বিশ্বজুড়ে ২৪ কোটি মানুষ জরুরি সহায়তার প্রয়োজনীয়তায় রয়েছে। তবে সরকারি তহবিল সংকটে আগামী বছর তারা মাত্র ৮ কোটি ৭০ লাখ মানুষকে সহায়তা দিতে পারবে।
বছরের শেষে এসে উদারতা, শান্তি ও শুভকামনার বড়দিনের চেতনা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রয়োজন। উৎসবের আনন্দ যেমন স্বস্তি দেয়, তেমনি ভবিষ্যতের জন্য আশা জাগায়।
ক্লিফ বাডল 



















