ডেনমার্কের ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান নোভো নরডিস্ক সম্প্রতি তাদের বহুল আলোচিত ওষুধ ওজেম্পিক ভারতে বাজারে ছেড়েছে।
এই ওষুধ মূলত টাইপ-২ ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। তবে ওজন কমানোর (ফ্যাট লস) ক্ষেত্রে ওজেম্পিকের ব্যবহার কিন্তু বিশ্বজুড়ে আলোচিত।
২০২৩ সালে ‘দ্য ল্যানসেট ডায়াবেটিস অ্যান্ড এন্ডোক্রিনোলজি’তে প্রকাশিত সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে প্রায় দশ কোটি দশ লক্ষ মানুষ ডায়াবেটিস বা মধুমেহ রোগে আক্রান্ত। এদের মধ্যে বেশিরভাগেরই টাইপ-২ ডায়াবেটি আছে এবং এই জাতীয় ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
ভারতের কেন্দ্র সরকারের অধীনস্থ ন্যাশনাল হেলথ মিশনের আওতায় সচেতনতামূলক প্রচারের উপর জোর দিলেও তৃণমূলস্তরে ডায়াবেটিস এখনো চ্যালেঞ্জ হিসাবেই রয়ে গিয়েছে।
ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত কিছু নতুন ওষুধ (বিশেষত জিএলপি-১ ভিত্তিক) এখন ‘ফ্যাট লস’-এর ওষুধ হিসাবেও আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।
জিএলপি-১ হলো এক জাতীয় প্রাকৃতিক হরমোন যা অন্ত্র নিঃসৃত হয়। এটা শরীরে ইনসুলিন নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়, পাচন পদ্ধতিকে ধীর করে এবং খিদে হ্রাস করে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।
সম্প্রতি, এই জাতীয় ওষুধগুলো টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং ওজন হ্রাস (স্থূলতা কমানোর) করার জন্য ইঞ্জেকশন বা পিল হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
এগুলো কী ধরনের ওষুধ, কীভাবে কাজ করে, এর উপকারিতা কী? ব্যবহার করলে তার কী ঝুঁকি রয়েছে সেই সমস্ত বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি নিউজ হিন্দি। জানার চেষ্টা করেছে এই ওষুধ কি এখন স্থূলতা কমানোর ‘শর্টকার্ট’ হয়ে উঠছে?

ভারতে টাইপ-২ ডায়াবেটিস
‘ফোর্টিস-সি-ডক সেন্টার অফ এক্সিলেন্স ফর ডায়াবেটিস’-এর সভাপতি ও চিকিৎসক ডা. অনুপ মিশ্র বলেছেন, “ভারতে টাইপ-২ ডায়াবেটিস এক এমন এক জাতীয় ক্রমবর্ধমান বোঝা যা পাবলিক হেলথ ইমারজেন্সি (জনস্বাস্থ্য বিষয়ক জরুরি অবস্থা) হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
তার কথায়, “নগরায়ন, যে জীবনযাত্রায় মূলত বসে কাজ করতে হয়, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, জিনগত কারণের পাশাপাশি মানসিক চাপ এবং দূষণও এই সমস্যার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে।”
“অন্যদিকে, দশ মিনিটের মধ্যে ফাস্টফুড ডেলিভারি এই আগুনে ইন্ধন যোগ করেছে। এখন কুড়ির কোঠায় থাকা তরুণ প্রজন্মও এই রোগের কবলে পড়েছে।”
ডা. মিশ্রের মতে, “পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় ভারতীয়দের মধ্যে কম ওজন এবং অল্প বয়সেই ডায়াবেটিস শুরু হয়। এই পরিস্থিতিতে ডায়াবেটিসের চিকিৎসার পাশাপাশি প্রতিরোধের ব্যাপারেও জোর দেওয়া অত্যন্ত দরকার।”
ম্যাক্স হেলথকেয়ারের এন্ডোক্রিনোলজি এবং ডায়াবেটিস বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. অম্বরিশ মিত্তল টাইপ-২ ডায়াবেটিসের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত ওষুধের প্রসঙ্গে বলেছেন, “ওজন কমানোর ক্ষেত্রে সেমাগ্লুটাইড (ওজেম্পিক / ওয়েগোভি) এবং টিরজেপাটাইড (মাউনজারো)-র মতো নতুন ওষুধগুলোর প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে দেখা গিয়েছে।”
“আসলে এই ওষুধগুলো শুধু রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখে না, খিদে কমায় এবং দ্রুত পেট ভরে গিয়েছে এমন অনুভূতি দেয়। এই জাতীয় ওষুধ ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ওজন হ্রাস করতে পারে।”

চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লুএইচও)-র তরফে স্থূলতা কমানোর জন্য জিএলপি-১ ব্যবহারের বিষয়ে প্রথমবার বিশ্বব্যাপী নির্দেশিকা জারি করা হয়।
ডাব্লুএইচও ওবেসিটিকে দীর্ঘস্থায়ী এবং পুনরাবৃত্তিমূলক রোগ হিসাবে আখ্যা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে জারি করা নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, “জিএলপি-১ জাতীয় ওষুধগুলো প্রাপ্তবয়স্কদের স্থূলতা কমাতে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে এই জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা উচিত। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা দরকার।”
ডাব্লুএইচও’র মহাপরিচালক ডা. টেড্রোস গেব্রিয়েসুস বলেছেন, “শুধুমাত্র ওষুধ সেবন করে এই বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সঙ্কটের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তবে জিএলপি-১ ওষুধ লক্ষ লক্ষ মানুষকে ওবেসিটির সঙ্গে যুঝতে সাহায্য করতে পারে। একই সঙ্গে এর ওবেসিটির কারণে যে ক্ষতি হয়, তার প্রভাবের সঙ্গে মোকাবিলা করতেও সহায়তা করতে পারে।”
ছবির উৎস,Getty Images
ফ্যাট লসের জন্য ব্যবহৃত ওষুধ কীভাবে কাজ করে?
ডা. অম্বরিশ মিত্তল ব্যাখ্যা করেছেন, “আমাদের শরীরে জিএলপি-১ নামে এক জাতীয় প্রাকৃতিক হরমোন রয়েছে। খাওয়ার সময় অন্ত্র থেকে এটা নির্গত হয়।”
“এই হরমোন খিদে নিয়ন্ত্রণ করে, পেট ধীরে ধীরে খালি হতে দেয় এবং ইনসুলিনের মাধ্যমে রক্তে শর্করাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।”
“স্থূলতার চিকিৎসার জন্য এই জাতীয় ওষুধগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ এবং ইউরোপের স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোও অনুমোদন করেছে। সাধারণত ৩০ বা তার বেশি বিএমআই (বডি মাস ইনডেক্স বা দেহের ভর সূচক) যুক্ত ব্যক্তিদের ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয় এই ওষুধ। বা সেই সমস্ত ব্যক্তিদের ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয় যারা নিজেদের জীবনযাত্রা পরিবর্তন করা সত্ত্বেও কোনো উল্লেখযোগ্য বদল দেখেননি।”
এই ওষুধগুলো শুধুমাত্র ওজন কমাতেই সাহায্য করে না, স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করতে পারে বলেও দাবি করা হয়।
ডা. মিত্থাল মনে করেন, এই জাতীয় ওষুধকে ‘কসমেটিক’ হিসেবে বিবেচনা করাটা ভুল। তার কথায়, “ওবেসিটি নিজেই একটা মারাত্মক রোগ, যা ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং ফ্যাটি লিভারের মতো সমস্যার জন্ম দেয়।”
ডা. অম্বরিশ মিত্তলের মতে, এই জাতীয় ওষুধের সম্ভাব্য উপকারিতার তালিকায় টাইপ-২ ডায়াবেটিস আরো ভালভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, ওজন হ্রাসের কারণে অনেক রোগের ঝুঁকি হ্রাসও রয়েছে।
উদাহরণ স্বরূপ ওজন কমলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি ২০ শতাংশ কমার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া ফ্যাটি লিভার এবং কিডনি সঙ্ক্রান্ত সমস্যা প্রতিরোধ করতে সাহায্য মিলতে পারে।
তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে জাঙ্ক ফুড, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, মানসিক চাপ এবং দূষণের কারণে ভারতে স্থূলতা এবং ডায়াবেটিস বাড়ছে।
বিশেষ করে পাকস্থলীর চারপাশে জমে থাকা ফ্যাট (সেন্ট্রাল ওবেসিটি)-কে বেশি বিপজ্জনক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ও সতর্কতা
ডা. মিত্তল এই ওষুধগুলোর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেও সতর্ক করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে এই যে জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা শুরুর পর থেকে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষের পেটের সমস্যা দেখা দিতে পারে যেমন অ্যাসিডিটি, ব্লোটিং (পেটে ফোলা ভাব), কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া হতে পারে। পাশাপাশি বমিবমি ভাবও দেখা দিতে পারে।
তিনি সতর্ক করেছেন এই জাতীয় ওষুধের ব্যবহারে দ্রুত ওজন কমে গেলে ২০-৪০ শতাংশ মাংসপেশী কমে যেতে পারে। এই জাতীয় বিষয় এড়াতে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিনযুক্ত খাবার খাওয়া এবং স্ট্রেন্থ ট্রেনিং-এর প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তিনি।
ডা. অনুপ মিশ্র ওষুধের ব্যবহার সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, “এগুলো সবার ব্যবহারের জন্য নয়। এগুলো শীর্ণকায় ব্যক্তি, টাইপ -১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, প্যানক্রিয়াটাইটিস রোগী বা কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে থাইরয়েড ক্যান্সারের ইতিহাস রয়েছে এমন ব্যক্তিদের জন্য ভাল নয়।”
“তাছাড়া ভারতে এই ওষুধের চড়া দাম এবং সীমিতভাবে মেলার বিষয়ও বড় চ্যালেঞ্জ।”
এখন প্রশ্ন হলো এগুলো কী ওজন কমানোর শর্টকাট?

ওজন কমানোর শর্টকার্ট?
চিকিৎসক অনুপ মিশ্র জিএলপি -১ ওষুধের ভূমিকা সম্পর্কে বলেছেন “এই ওষুধগুলো কিছু নির্দিষ্ট সমস্যার সঙ্গে যুঝছেন যেমন স্থূলতা রয়েছে, চিকিৎসা করেও যাদের রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না, বা যাদের হার্ট, কিডনি, ফ্যাটি লিভার বা স্লিপ অ্যাপনিয়ার ঝুঁকি বেশি রয়েছে এমন ব্যক্তিদের জন্য লাভজনক হতে পারে।”
পাশাপাশি, তিনি তার অন্য উদ্বেগের কথাও জানিয়েছেন। তার উদ্বেগের কারণ হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং চেহারার বিষয়ে সচেতনতার কারণে অনেকে চাপে পড়ে চিকিৎসাজনিত প্রয়োজন ছাড়াই এই ওষুধ ব্যবহার করছেন। এই জাতীয় ওষুধকে ওজন কমানোর হ্রাসের শর্টকাট হিসাবে বিবেচনা করেন তারা।
এই প্রসঙ্গে তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, “ভারতে অপুষ্টি এবং স্থূলতা, দুই-ই দেখা যায়। বিশেষজ্ঞদের কাছে পরামর্শের নেওয়ার পরই এই ওষুধ ব্যবহার করা উচিত।”
BBC News বাংলা
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















