০১:৩৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫
প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার ৯ অসময়ে ভাঙন, গড়াইয়ের পাড়জুড়ে আতঙ্ক একের পর হামলা-হত্যাকাণ্ড, প্রশাসন ‘নির্লিপ্ত’ কেন? যুক্তরাষ্ট্রে যৌন অপরাধী এপস্টাইনের তদন্তের নথি থেকে প্রকাশিত ছবি হঠাৎ সরিয়ে ফেলা ঘিরে বিতর্ক মুসলমানরা কম, হিন্দুদের নামই বেশি বাদ পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় ওজন কমাতে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের জন্য তৈরি ওষুধের ব্যবহার লালফিতার জট কাটিয়ে মিনিটেই অনুমোদন, সরকারি সেবায় বড় বদল মালয়েশিয়ায় মালয়েশিয়ায় নজিরবিহীন মাদক অভিযান, দেড় বিলিয়ন রিঙ্গিতের বেশি মাদক জব্দ স্কোয়াশে ঘুরে দাঁড়ানো এক কিশোরের গল্প: ভুলের অতীত ছাপিয়ে স্বপ্নের নতুন পথ স্তনে ব্যথা ও গাঁট, ক্যানসার নয় রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার আঘাতেই ভুগছিলেন তিনি

একের পর হামলা-হত্যাকাণ্ড, প্রশাসন ‘নির্লিপ্ত’ কেন?

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও জুলাই যোদ্ধা শরীফ ওসমান হাদির খুনির পালিয়ে যাওয়া, কিংবা হত্যাকাণ্ডের পর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ঘোষণা দিয়ে একের পর এক হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে৷ শুধু তাই নয়, ময়মনসিংহে এক হিন্দু যুবককে পিটিয়ে আহত করার পর গাছের সঙ্গে বেঁধে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ লক্ষ্মীপুরে একজন বিএনপি নেতার ঘরের দরোজা বন্ধ অবস্থায় আগুনে তার ৭ বছরের শিশুকন্যার মৃত্যু হয়েছে৷ অনেকেই অভিযোগ করেছেন, এসব ঘটনায় আইন শৃঙ্খলাবাহিনী অনেকটা নির্লিপ্ত ভুমিকায় ছিল৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটনার পর বা অনেক পর তারা সেখানে হাজির হয়েছে৷ অপরাধীদের গ্রেপ্তারেও শৈথিল্য দেখা গেছে৷

আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে হামলা, তারপরও নেই পুলিশ

গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর বাংলাদেশে পৌঁছলে তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা শাহবাগে জড়ো হতে থাকেন৷ রাত সাড়ে ১১টার দিকে একদল লোক শাহবাগ থেকে কারওয়ান বাজারে এসে প্রথমে প্রথম আলো এবং পরে ডেইলি স্টার ভবনে হামলা চালায়৷ ভাঙচুরের পর তারা লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দেয়৷ এরপর তারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে ভাঙচুর করে এবং রাত ৩টার দিকে ধানমন্ডিতে ছায়ানট ভবনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে৷ এক পর্যায়ে সাংস্কৃতিক সরঞ্জাম লুটপাট করে৷ পরদিন অর্থাৎ শুক্রবার সন্ধ্যায় একদল মানুষ গিয়ে তোপখানা রোডে উদীচীর ঢাকা অফিসে হামলা ও ভাঙচুর করে৷

বৃহস্পতিবার রাতে ছায়ানট ভবনে হামলা, ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে৷ এতে অজ্ঞাতনামা তিন শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে৷  ঘটনার পরে ক্ষতিগ্রস্ত ছায়ানট ভবন পরিদর্শন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাংস্কৃতিক বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী বলেছেন, সিসি ফুটেজ দেখে হামলায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে৷

ছায়ানটের সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা আগে থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরাপত্তার কথা বলেছিলাম৷ কিন্তু তারপরও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি৷ তবুও আমাদের সান্তনা যে ওরা আমাদের ভবনে আগুন দেয়নি৷ হয়ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পৌঁছে যাওয়ার কারণে তারা আগুন দিতে পারেনি৷ আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান৷ এখানে হামলার পর দেশের ভাবমুর্তি বিদেশে কি হবে?”

উদীচী অফিসে হামলা হয়েছে ছায়ানটে হামলার একদিন পর অর্থাৎ শুক্রবার৷ একদিন পরও কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিতে পারেনি সেই প্রশ্ন তুলেছেন উদীচী সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘ওরা আগে থেকেই ঘোষণা দিয়েছিল আমাদের এখানে হামলা করবে৷ ফেসবুকে সেই ঘোষণা ঘুরে বেড়াচ্ছিল৷ তারপরও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কোন ব্যবস্থা নিল না৷ এই হামলার দায় তো সরকার এড়াতে পারে না৷”

পুড়ে যাওয়া প্রথম আলো কার্যালয় রোববার পরিদর্শনে এসেছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলা মানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত৷ এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি ভয়াবহ মুহূর্ত ছিল৷ আমরা এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না৷”

ড. কামাল হোসেন পরিদর্শনে গিয়ে বলেছেন, যারা প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা করেছে, তারা গণবিরোধী শক্তি৷ ওইদিন রাতে ডেইলি স্টারে গিয়ে হেনস্তার শিকার হয়েছে নিউ এইজ সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের সভাপনি নুরুল কবীর৷ প্রধান উপদেষ্ঠার দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, দু’টি গণমাধ্যমে হামলার ঘটনায় দুইজনকে আটক করা হয়েছে৷ আরও ৩০ জনকে সনাক্ত করা হয়েছে৷

পুলিশ ও প্রশাসন কী বলছে?

সরকার কেন এসব ঘটনায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি? আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কেন নির্লিপ্ত ছিল? জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সেক্রেটারী ফয়েজ আহম্মদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুরো পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে রোববার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ সেখানে এসব ঘটনায় গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে৷ তবে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলার ঘটনা বিশ্লেষন করে দেখা গেছে, ওসমান হাদির সহকর্মীরা যখন শাহবাগে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তখন কিছু দুষ্কৃতকারী এতে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানটে হামলা চালায়৷ এদের দুইজনকে ইতিমধ্যে আটক করা হয়েছে এবং ৩০ জনকে সনাক্ত করা হয়েছে৷ অন্যান্য ঘটনাগুলোতেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷ ফলে সরকার যে পদক্ষেপ নেয়নি বা নিচ্ছে না এমন অভিযোগ করা ঠিক হবে না৷”

একটার পর একটা হামলার ঘটনা ঘোষণা দিয়ে করা হয়েছে৷ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী চাইলে কি আগে থেকে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারত না? জানতে চাইলে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খন্দকার রফিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুলিশ যে ব্যবস্থা নেয়নি, বিষয়টি এমন নয়৷ তবে আপনাদের বুঝতে হবে এতদিন মানুষ যে ধরনের পুলিশিং দেখে আসছে, এখন আমরা সেই ধরনের পুলিশিং করছি না৷ আমরা জনগনকে বোঝানোর চেষ্টা করছি৷ আগে যেমন কোন ঘটনার পর একটা ক্রসফায়ার হলে মানুষ মনে করত, ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷ এখন তো আর ক্রসফায়ার হয় না৷ আমরা লাঠিচার্জ করি না, কাউকে গুলি করি না৷ ফলে আমাদের সাধ্যের মধ্যে এগুলো নিয়ন্ত্রণে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন সেগুলো নেওয়া হচ্ছে৷”

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অতি দ্রুত যৌথ অভিযান শুরু হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ৷ তিনি বলেন, ‘‘মেসেজ ক্লিয়ার, কাউকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করতে দেওয়া হবে না৷” রোববার আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন৷

দিপু হত্যাকাণ্ডে ১২ সন্দেহভাজন গ্রেপ্তার

গত বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহ জেলার ভালুকায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী পোশাক কারখানার কর্মকর্তা দিপু চন্দ্র দাসকে ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ তুলে দলবদ্ধ হয়ে পিটিয়ে ও গাছে বেঁধে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ তবে এ ঘটনায় ‘ধর্ম অবমাননার’ কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে র‌্যাব৷ পিটিয়ে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার ভিডিও বিশ্লেষণ করে দুই জনকে আটক করে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে আরও পাঁচ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব৷ রোববার রাত পর্যন্ত এই ঘটনায় ১২ জনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছে পুলিশ৷

নিহত যুবকের কাকাতো ভাই কার্তিক চন্দ্র দাস ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘ঘটনায় কারা জড়িত তা ভিডিওতে আছে৷ এলাকার মানুষ জানে আমার ভাই কেমন মানুষ ছিল৷ তাকে মিথ্যা অভিযোগ করে খুন করা হয়েছে৷ আমরা এই ঘটনার বিচার চাই৷ দিপুর দেড় বছর বয়সী একটি কন্যা সন্তান রয়েছে৷ তার দায়িত্ব কে নেবে? মেয়েটা বড় হবে কিভাবে?”

শুক্রবার অন্তর্বর্তী সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ময়মনসিংহে এক হিন্দু ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আমরা গভীরভাবে নিন্দা জানাই৷ নতুন বাংলাদেশে এ ধরনের সহিংসতার কোনো স্থান নেই৷ এই নৃশংস অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না৷’

অন্যদিকে লক্ষ্মীপুরে দরজায় তালা লাগিয়ে ও পেট্রল ঢেলে বেলাল হোসেন নামের এক বিএনপি নেতার ঘরে আগুন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে৷ এ সময় ঘরের ভেতর আগুনে পুড়ে ওই বিএনপি নেতার সাত বছর বয়সী মেয়ে আয়েশা আক্তারের মৃত্যু হয়েছে৷ এছাড়া ওই বিএনপি নেতা এবং তার আরও দুই মেয়ে বীথি আক্তার (১৭) ও স্মৃতি আক্তার (১৪) আগুনে দগ্ধ হয়েছেন৷ শুক্রবার গভীর রাতে এই ঘটনা ঘটে৷ বেলাল হোসেন লক্ষ্মীপুরের ভবানীগঞ্জ ইউনিয়ন বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক এবং সূতারগোপ্তা বাজারের সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী৷ পুলিশ বলছে, তারা নাশকতার ‘বিশ্বাসযোগ্য’ প্রমাণ পায়নি৷ তবে গণমাধ্যমকে বিএনপি নেতা বলেছেন, দরজা বাইরে থেকে তালা দিয়ে আগুন লাগানো হয়েছে৷

এসব ঘটনায় চাইলে কি আইন শৃঙ্খলাবাহিনী আগে থেকে কোন পদক্ষেপ নিতে পারত  কি না জানতে চাইলে মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আইন শৃঙ্খলাবাহিনী তো পরের কথা, সরকার এখানে নির্লিপ্ত ভুমিকা পালন করছে৷ ঘোষণা দিয়ে দু’টি পত্রিকা অফিসে হামলা, ছায়ানট, উদীচীতে হামলা, গাছে বেঁধে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন পুড়িয়ে হত্যার দায় সরকার কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারবে না৷ আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের দেশ সম্পর্কে কী বার্তা যাচ্ছে? ফলে এসব ঘটনায় শুধু বিবৃতি দিয়ে সরকার দায় শোধ করতে পারে না৷”

জনপ্রিয় সংবাদ

প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার ৯

একের পর হামলা-হত্যাকাণ্ড, প্রশাসন ‘নির্লিপ্ত’ কেন?

১২:০৩:৫১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও জুলাই যোদ্ধা শরীফ ওসমান হাদির খুনির পালিয়ে যাওয়া, কিংবা হত্যাকাণ্ডের পর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ঘোষণা দিয়ে একের পর এক হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে৷ শুধু তাই নয়, ময়মনসিংহে এক হিন্দু যুবককে পিটিয়ে আহত করার পর গাছের সঙ্গে বেঁধে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ লক্ষ্মীপুরে একজন বিএনপি নেতার ঘরের দরোজা বন্ধ অবস্থায় আগুনে তার ৭ বছরের শিশুকন্যার মৃত্যু হয়েছে৷ অনেকেই অভিযোগ করেছেন, এসব ঘটনায় আইন শৃঙ্খলাবাহিনী অনেকটা নির্লিপ্ত ভুমিকায় ছিল৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটনার পর বা অনেক পর তারা সেখানে হাজির হয়েছে৷ অপরাধীদের গ্রেপ্তারেও শৈথিল্য দেখা গেছে৷

আগে থেকে ঘোষণা দিয়ে হামলা, তারপরও নেই পুলিশ

গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর বাংলাদেশে পৌঁছলে তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা শাহবাগে জড়ো হতে থাকেন৷ রাত সাড়ে ১১টার দিকে একদল লোক শাহবাগ থেকে কারওয়ান বাজারে এসে প্রথমে প্রথম আলো এবং পরে ডেইলি স্টার ভবনে হামলা চালায়৷ ভাঙচুরের পর তারা লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দেয়৷ এরপর তারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে ভাঙচুর করে এবং রাত ৩টার দিকে ধানমন্ডিতে ছায়ানট ভবনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে৷ এক পর্যায়ে সাংস্কৃতিক সরঞ্জাম লুটপাট করে৷ পরদিন অর্থাৎ শুক্রবার সন্ধ্যায় একদল মানুষ গিয়ে তোপখানা রোডে উদীচীর ঢাকা অফিসে হামলা ও ভাঙচুর করে৷

বৃহস্পতিবার রাতে ছায়ানট ভবনে হামলা, ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে৷ এতে অজ্ঞাতনামা তিন শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে৷  ঘটনার পরে ক্ষতিগ্রস্ত ছায়ানট ভবন পরিদর্শন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাংস্কৃতিক বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী বলেছেন, সিসি ফুটেজ দেখে হামলায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে৷

ছায়ানটের সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা আগে থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরাপত্তার কথা বলেছিলাম৷ কিন্তু তারপরও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি৷ তবুও আমাদের সান্তনা যে ওরা আমাদের ভবনে আগুন দেয়নি৷ হয়ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পৌঁছে যাওয়ার কারণে তারা আগুন দিতে পারেনি৷ আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান৷ এখানে হামলার পর দেশের ভাবমুর্তি বিদেশে কি হবে?”

উদীচী অফিসে হামলা হয়েছে ছায়ানটে হামলার একদিন পর অর্থাৎ শুক্রবার৷ একদিন পরও কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিতে পারেনি সেই প্রশ্ন তুলেছেন উদীচী সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘ওরা আগে থেকেই ঘোষণা দিয়েছিল আমাদের এখানে হামলা করবে৷ ফেসবুকে সেই ঘোষণা ঘুরে বেড়াচ্ছিল৷ তারপরও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কোন ব্যবস্থা নিল না৷ এই হামলার দায় তো সরকার এড়াতে পারে না৷”

পুড়ে যাওয়া প্রথম আলো কার্যালয় রোববার পরিদর্শনে এসেছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলা মানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত৷ এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি ভয়াবহ মুহূর্ত ছিল৷ আমরা এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না৷”

ড. কামাল হোসেন পরিদর্শনে গিয়ে বলেছেন, যারা প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা করেছে, তারা গণবিরোধী শক্তি৷ ওইদিন রাতে ডেইলি স্টারে গিয়ে হেনস্তার শিকার হয়েছে নিউ এইজ সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের সভাপনি নুরুল কবীর৷ প্রধান উপদেষ্ঠার দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, দু’টি গণমাধ্যমে হামলার ঘটনায় দুইজনকে আটক করা হয়েছে৷ আরও ৩০ জনকে সনাক্ত করা হয়েছে৷

পুলিশ ও প্রশাসন কী বলছে?

সরকার কেন এসব ঘটনায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি? আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কেন নির্লিপ্ত ছিল? জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সেক্রেটারী ফয়েজ আহম্মদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুরো পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে রোববার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ সেখানে এসব ঘটনায় গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে৷ তবে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলার ঘটনা বিশ্লেষন করে দেখা গেছে, ওসমান হাদির সহকর্মীরা যখন শাহবাগে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তখন কিছু দুষ্কৃতকারী এতে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানটে হামলা চালায়৷ এদের দুইজনকে ইতিমধ্যে আটক করা হয়েছে এবং ৩০ জনকে সনাক্ত করা হয়েছে৷ অন্যান্য ঘটনাগুলোতেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷ ফলে সরকার যে পদক্ষেপ নেয়নি বা নিচ্ছে না এমন অভিযোগ করা ঠিক হবে না৷”

একটার পর একটা হামলার ঘটনা ঘোষণা দিয়ে করা হয়েছে৷ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী চাইলে কি আগে থেকে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারত না? জানতে চাইলে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খন্দকার রফিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুলিশ যে ব্যবস্থা নেয়নি, বিষয়টি এমন নয়৷ তবে আপনাদের বুঝতে হবে এতদিন মানুষ যে ধরনের পুলিশিং দেখে আসছে, এখন আমরা সেই ধরনের পুলিশিং করছি না৷ আমরা জনগনকে বোঝানোর চেষ্টা করছি৷ আগে যেমন কোন ঘটনার পর একটা ক্রসফায়ার হলে মানুষ মনে করত, ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷ এখন তো আর ক্রসফায়ার হয় না৷ আমরা লাঠিচার্জ করি না, কাউকে গুলি করি না৷ ফলে আমাদের সাধ্যের মধ্যে এগুলো নিয়ন্ত্রণে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন সেগুলো নেওয়া হচ্ছে৷”

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অতি দ্রুত যৌথ অভিযান শুরু হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ৷ তিনি বলেন, ‘‘মেসেজ ক্লিয়ার, কাউকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করতে দেওয়া হবে না৷” রোববার আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন৷

দিপু হত্যাকাণ্ডে ১২ সন্দেহভাজন গ্রেপ্তার

গত বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহ জেলার ভালুকায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী পোশাক কারখানার কর্মকর্তা দিপু চন্দ্র দাসকে ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ তুলে দলবদ্ধ হয়ে পিটিয়ে ও গাছে বেঁধে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ তবে এ ঘটনায় ‘ধর্ম অবমাননার’ কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে র‌্যাব৷ পিটিয়ে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার ভিডিও বিশ্লেষণ করে দুই জনকে আটক করে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে আরও পাঁচ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব৷ রোববার রাত পর্যন্ত এই ঘটনায় ১২ জনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছে পুলিশ৷

নিহত যুবকের কাকাতো ভাই কার্তিক চন্দ্র দাস ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘ঘটনায় কারা জড়িত তা ভিডিওতে আছে৷ এলাকার মানুষ জানে আমার ভাই কেমন মানুষ ছিল৷ তাকে মিথ্যা অভিযোগ করে খুন করা হয়েছে৷ আমরা এই ঘটনার বিচার চাই৷ দিপুর দেড় বছর বয়সী একটি কন্যা সন্তান রয়েছে৷ তার দায়িত্ব কে নেবে? মেয়েটা বড় হবে কিভাবে?”

শুক্রবার অন্তর্বর্তী সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ময়মনসিংহে এক হিন্দু ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আমরা গভীরভাবে নিন্দা জানাই৷ নতুন বাংলাদেশে এ ধরনের সহিংসতার কোনো স্থান নেই৷ এই নৃশংস অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না৷’

অন্যদিকে লক্ষ্মীপুরে দরজায় তালা লাগিয়ে ও পেট্রল ঢেলে বেলাল হোসেন নামের এক বিএনপি নেতার ঘরে আগুন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে৷ এ সময় ঘরের ভেতর আগুনে পুড়ে ওই বিএনপি নেতার সাত বছর বয়সী মেয়ে আয়েশা আক্তারের মৃত্যু হয়েছে৷ এছাড়া ওই বিএনপি নেতা এবং তার আরও দুই মেয়ে বীথি আক্তার (১৭) ও স্মৃতি আক্তার (১৪) আগুনে দগ্ধ হয়েছেন৷ শুক্রবার গভীর রাতে এই ঘটনা ঘটে৷ বেলাল হোসেন লক্ষ্মীপুরের ভবানীগঞ্জ ইউনিয়ন বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক এবং সূতারগোপ্তা বাজারের সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী৷ পুলিশ বলছে, তারা নাশকতার ‘বিশ্বাসযোগ্য’ প্রমাণ পায়নি৷ তবে গণমাধ্যমকে বিএনপি নেতা বলেছেন, দরজা বাইরে থেকে তালা দিয়ে আগুন লাগানো হয়েছে৷

এসব ঘটনায় চাইলে কি আইন শৃঙ্খলাবাহিনী আগে থেকে কোন পদক্ষেপ নিতে পারত  কি না জানতে চাইলে মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আইন শৃঙ্খলাবাহিনী তো পরের কথা, সরকার এখানে নির্লিপ্ত ভুমিকা পালন করছে৷ ঘোষণা দিয়ে দু’টি পত্রিকা অফিসে হামলা, ছায়ানট, উদীচীতে হামলা, গাছে বেঁধে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন পুড়িয়ে হত্যার দায় সরকার কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারবে না৷ আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের দেশ সম্পর্কে কী বার্তা যাচ্ছে? ফলে এসব ঘটনায় শুধু বিবৃতি দিয়ে সরকার দায় শোধ করতে পারে না৷”