২০২৫ সাল শেষ করছেন ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফের্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র এক ধরনের স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে। তাঁর প্রশাসন একাধিকবার সম্ভাব্য পতনের মুখ থেকে কোনোমতে বেঁচে গেছে।
দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি কেলেঙ্কারির মধ্যেই মার্কোস জুনিয়রকে মোকাবিলা করতে হয়েছে ব্যাপক জনবিক্ষোভ। অভিযোগ উঠেছে, কিছু সাবেক জেনারেল ও অসন্তুষ্ট সেনা কর্মকর্তা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। শক্তিশালী ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্যসহ কয়েক লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তাদের কারাবাসের দাবিতে নজিরবিহীন সমাবেশ করেন। পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর হয়ে ওঠে যে, প্রেসিডেন্টের বোন ও সিনেটর ইমি মার্কোস পর্যন্ত তাঁর ‘অদক্ষতা’ ও ‘মাদকসেবনের অভিযোগ’ তুলে ধরে ভাইয়ের পদত্যাগ দাবি করেন।
অর্থনীতির অবস্থাও শোচনীয়। ডলারের বিপরীতে ফিলিপাইন পেসো নেমেছে ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে। শেয়ারবাজারে চলছে তীব্র অস্থিরতা, দেশের শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠীগুলোর বাজারমূল্য কমেছে কয়েক দশক বিলিয়ন ডলার। এর চেয়েও উদ্বেগজনক হলো, বড় সব সরকারি অবকাঠামো প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তৃতীয় প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৪ শতাংশে, যা মহামারি বাদ দিলে এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এর প্রভাব পড়েছে জনমতেও। প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা নেমে এসেছে সাম্প্রতিক ফিলিপাইনের ইতিহাসে সর্বনিম্ন পর্যায়গুলোর একটিতে, যা তুলনীয় বিতর্কিত গ্লোরিয়া ম্যাকাপাগাল অ্যারোইও সরকারের সময়কার অবস্থার সঙ্গে, যিনি একাধিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা টিকে গিয়েছিলেন।
তবু ২০২৬ সাল হতে পারে মার্কোস জুনিয়রের পুনরুদ্ধারের সুযোগ। তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন, এমনকি তাঁর নিজের ছেলে, কংগ্রেস সদস্য ফের্দিনান্দ ‘স্যান্ড্রো’ মার্কোস তৃতীয়কেও জনসমক্ষে তদন্তের মুখে পড়তে হয়েছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক রাজবংশ নিষিদ্ধ করতে একটি নতুন আইনের জন্য চাপ দিয়েছেন, যাতে অল্প কয়েকটি পরিবারের হাতে নির্বাচিত ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন কমানো যায়।
আরও কঠোর পদক্ষেপ হিসেবে, আগের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতের্তের পরিবারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন শীর্ষ সহযোগীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সম্ভাব্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকরের পথে এগোতে পারে সরকার। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে এই উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। পাশাপাশি ভাইস প্রেসিডেন্ট সারা দুতের্তের বিরুদ্ধেও নতুন করে দুর্নীতির তদন্ত শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে আসিয়ানের ঘূর্ণায়মান সভাপতির দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে ফিলিপাইন, ফলে বিশ্বনেতাদের স্বাগত জানানোর প্রস্তুতিও চলছে।
এই প্রেক্ষাপটে মার্কোস জুনিয়রের সামনে রয়েছে বৈশ্বিক নেতৃত্ব প্রদর্শনের সুযোগ। দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে দৃঢ় অবস্থানের কারণে তিনি দেশটিকে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে পারেন এবং উচ্চমানের বড় বিনিয়োগের জন্য ফিলিপাইনকে আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরতে পারেন। সব মিলিয়ে ২০২৬ সাল হতে পারে তাঁর জন্য ভাগ্য নির্ধারণের বছর।
২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে তাঁর পক্ষে ছিল। মধ্যবর্তী নির্বাচনে স্থানীয় সরকার ও কংগ্রেসে মার্কোসপন্থীরা বড় সাফল্য পায়, যদিও জাতীয় পর্যায়ের সিনেট নির্বাচন কিছুটা হাড্ডাহাড্ডি হয়। অর্থনীতিও তখনো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দ্রুততম প্রবৃদ্ধির তালিকায় ছিল, যা সরকারকে ‘উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ’ হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছিল।
একই সময়ে দুতের্তে পরিবার চাপে পড়ে। সাবেক প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতের্তেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে হস্তান্তর করা হয়, যেখানে তিনি জীবনের বাকি সময় কাটাতে পারেন। তাঁর সন্তান কংগ্রেস সদস্য পাওলো দুতের্তে ও দাভাওয়ের মেয়র সেবাস্তিয়ান দুতের্তে ব্যাপক অদক্ষতার অভিযোগে সমালোচিত হন। ভাইস প্রেসিডেন্ট সারা দুতের্তের বিরুদ্ধেও সিনেটে অভিশংসনের সম্ভাবনা তৈরি হয়।

কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়। প্রথমত, সুপ্রিম কোর্ট হঠাৎ এক সিদ্ধান্তে ভাইস প্রেসিডেন্টের অভিশংসন প্রক্রিয়া বাতিল করে দেয়, যা দেশজুড়ে শীর্ষ আইনবিদ ও আইন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। এরপর আরেক চমক আসে, যখন প্রেসিডেন্ট নিজেই জাতির উদ্দেশে ভাষণে বহু বিলিয়ন ডলারের বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের কথা স্বীকার করেন।
এর পরবর্তী মাসগুলোতে তাঁর চাচাতো ভাই ও স্পিকার মার্টিন রোমুয়ালদেজ পদত্যাগে বাধ্য হন, একাধিক শীর্ষ মন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু এতে জনরোষ কমেনি; বরং বিরোধীরা সরকারের পতনের দাবিতে আরও আক্রমণাত্মক হয়, কেউ কেউ সামরিক জান্তা বা অন্তর্বর্তী পরিষদের প্রস্তাবও তোলে। এমনকি সেনাবাহিনী বিদেশি মদদে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগও তোলে।
এই টালমাটাল সময়ে নানা সমঝোতা, নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি সমন্বয়ের মাধ্যমে মার্কোস জুনিয়র টিকে যান। সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল, প্রগতিশীল ও উদারপন্থী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দুতের্তের প্রত্যাবর্তন বা সামরিক জান্তার আশঙ্কা, যা বর্তমান সরকারকে সমর্থনের দিকে ঠেলে দেয়।
আগামী বছরটি তাই হতে পারে ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। দুতের্তে শিবিরের শীর্ষ দুই সিনেটর ক্রিস্টোফার গো ও রোনাল্ড ডেলা রোসার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকরের পথে এগোলে রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে যেতে পারে। পাশাপাশি নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ওম্বাডসম্যান যিশু ক্রিসপিন রেমুলা দুতের্তে পরিবারের আর্থিক অনিয়ম তদন্ত করে ভাইস প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিশংসনের সুপারিশও করতে পারেন।
এর বাইরে আসিয়ান সভাপতির দায়িত্ব কাজে লাগিয়ে ফিলিপাইনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, মানবসম্পদ, পর্যটন সম্ভাবনা ও বিনিয়োগের সুযোগ বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে পারেন মার্কোস জুনিয়র। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান এবং মানবাধিকার ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সঙ্গে সহযোগিতা তাঁকে নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার পক্ষে এক গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠে পরিণত করতে পারে।
আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের শীর্ষ নেতা শি জিনপিংসহ বিশ্বনেতাদের স্বাগত জানাতে পারলে আঞ্চলিক উত্তেজনা কমানো এবং নতুন অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা চুক্তির পথও খুলতে পারে। সঠিক কৌশল নিলে ২০২৬ সাল হতে পারে তাঁর সবচেয়ে কঠিন, আবার সবচেয়ে ফলপ্রসূ বছর।
রিচার্ড হেইডারিয়ান 



















