২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো সতর্ক করে বলেছে, রাজনীতিবিদ, অধিকারকর্মী, শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর ধারাবাহিক হামলা আইনের শাসন দুর্বল হওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। একই সঙ্গে সংকুচিত হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিক পরিসর এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের সুযোগ।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উদ্বেগ
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মাধ্যমে প্রকাশিত এক যৌথ বিবৃতিতে একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন জানান, তারা বাংলাদেশের সাংবাদিক, গণমাধ্যমকর্মী, শিল্পী ও নানা সম্প্রদায়ের মানুষের পাশে সংহতি প্রকাশ করছে। তাদের ভাষায়, নিরাপদ ও স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ, জবাবদিহি এবং সাংস্কৃতিক ও নাগরিক জীবনে অংশগ্রহণের অধিকার রক্ষা করা এখন জরুরি হয়ে উঠেছে।
এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছে এক্সেস নাও, আর্টিকেল নাইনটিন, কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস প্রজেক্ট, জার্নালিস্টস ফর ডেমোক্রেসি ইন শ্রীলঙ্কা এবং টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট।
গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা
মানবাধিকার সংগঠনগুলো ২০২৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে হামলা এবং ছায়ানটের ভাঙচুরের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তাদের মতে, এসব হামলা স্বাধীন সাংবাদিকতা, অধিকারকর্মী এবং সাংস্কৃতিক পরিসরের ওপর এক ভয়াবহ মাত্রার আক্রমণ।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এসব হামলা পরিকল্পিত ও সমন্বিত বলে মনে হচ্ছে, যা বাংলাদেশের স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করেছে। বিশেষ করে আগুনের সময় সংবাদকর্মী ও কর্মীদের ভেতরে আটকে পড়ার খবর তাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছে।

হিংসা ও প্রাণহানির ঘটনা
একই রাতে ময়মনসিংহের ভালুকায় দীপু চন্দ্র দাসকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা ও মরদেহ পোড়ানোর ঘটনায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংগঠনগুলো। অভিযোগ অনুযায়ী, ধর্ম নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্যের জেরেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।
এর আগে রাজধানীতে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান রাজনৈতিক কর্মী শরীফ ওসমান হাদী, যিনি ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম মুখ ছিলেন। এসব ঘটনার ধারাবাহিকতা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও আইনের শাসন নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
গণমাধ্যম বন্ধ ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা
হামলার পর দুটি পত্রিকার মুদ্রিত ও অনলাইন সংস্করণ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের গণমাধ্যম ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা বলে উল্লেখ করেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তারা বলছে, ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের হয়রানি ও শারীরিকভাবে ভয় দেখানোর ঘটনা প্রমাণ করে যে, কার্যকর রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা না থাকলে গণমাধ্যমবিরোধী শক্তিগুলো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

সাংস্কৃতিক পরিসরে সংকট
ছায়ানটের ওপর হামলাকে শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর আক্রমণ হিসেবে নয়, বরং সামগ্রিকভাবে সাংস্কৃতিক পরিসর ও শিল্পচর্চার প্রতি বৈরিতার প্রতিফলন হিসেবে দেখছে সংগঠনগুলো। তাদের মতে, এতে ভিন্নমত ও শিল্পীসত্তার জন্য পরিবেশ ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে উঠছে।
অনলাইন ঘৃণা ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা
বিবৃতিতে অনলাইন ও অফলাইন সহিংসতার যোগসূত্রের কথাও উঠে এসেছে। বছরের বিভিন্ন সময়ে বাউল, সাংবাদিক ও শিল্পীদের ওপর হামলার পেছনে অনলাইন ঘৃণামূলক বক্তব্য ও সহিংসতার আহ্বান ভূমিকা রেখেছে বলে তারা উল্লেখ করেছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো ঘৃণাবাক্য ও সহিংস উসকানি ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রও অনলাইন ঘৃণা ও উসকানির বিরুদ্ধে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

আইন সংস্কার ও আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা
অন্তর্বর্তী সরকার সাইবার আইন সংস্কারের কথা বললেও, তার বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নাগরিক সমাজ। মানবাধিকার সংগঠনগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চুক্তিসহ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বাংলাদেশ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাধ্য।
সরকারের প্রতি আহ্বান
মানবাধিকার সংগঠনগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের অবিলম্বে কার্যকর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে, হামলার নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে এবং সাংস্কৃতিক ও নাগরিক পরিসরকে নিরাপদ রাখতে। একই সঙ্গে আসন্ন নির্বাচনের আগে অনলাইন ও অফলাইন উভয় ক্ষেত্রেই সহিংসতা রোধে স্পষ্ট ও দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার তাগিদ দিয়েছে তারা।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















