বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘ, উত্তাল ও প্রভাবশালী এক অধ্যায়ের অবসান ঘটেছে। তিনবারের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মঙ্গলবার ভোরে ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল আশি বছর।
দলের তথ্য ও যোগাযোগবিষয়ক সম্পাদক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের প্রধান এ কে এম ওয়াহিদুজ্জামান জানান, মঙ্গলবার সকাল ছয়টায় তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
দীর্ঘ অসুস্থতা ও শেষ সময়
গত তেইশ নভেম্বর থেকে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসাধীন ছিলেন খালেদা জিয়া। বহু বছর ধরেই তিনি আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার, ফুসফুস, হৃদ্যন্ত্র ও চোখের নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। শেষ কয়েক মাসে নিউমোনিয়া, দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের সংক্রমণ ও হৃদ্যন্ত্রের জটিলতা তাঁর অবস্থা আরও সংকটাপন্ন করে তোলে।
দলীয় ও জাতীয় প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দলের চেয়ারপারসনের প্রয়াণের সংবাদ জানাতে হচ্ছে। তাঁর মৃত্যুকে সমর্থকেরা একটি যুগের অবসান হিসেবে দেখছেন, আবার সমালোচকদের কাছেও এটি বাংলাদেশের রাজনীতির এক বিতর্কিত অধ্যায়ের সমাপ্তি। তবে জাতির জন্য এটি ইতিহাসে ভরা এক নীরবতার মুহূর্ত।

চিকিৎসা ইতিহাস ও বিদেশে চিকিৎসা
দুই হাজার বাইশ সালের জুনে তাঁর হৃদ্যন্ত্রে গুরুতর ব্লক ধরা পড়ে এবং একটি স্টেন্ট বসানো হয়। পরে আরও দুটি ব্লক ধরা পড়লেও শারীরিক দুর্বলতার কারণে সেগুলো অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। দুই হাজার চব্বিশ সালের জুনে তাঁর শরীরে পেসমেকার স্থাপন করা হয়। লিভার সিরোসিসসহ নানা জটিলতায় ভুগলেও আইনি কারণে দীর্ঘদিন বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি পাননি তিনি।
দুই হাজার চব্বিশ সালের আগস্টে রাষ্ট্রপতির আদেশে সম্পূর্ণ মুক্তি পাওয়ার পর তিনি লন্ডনে যান এবং সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে উন্নত চিকিৎসা নেন। প্রায় চার মাস চিকিৎসা শেষে কাতারের রাজকীয় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে দেশে ফেরেন তিনি। দেশে ফেরার পরও গুলশানের বাসভবন ও এভারকেয়ার হাসপাতালে একাধিকবার চিকিৎসা নিতে হয় তাঁকে।
শৈশব থেকে রাজনীতিতে উত্থান
উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সালের পনেরো আগস্ট দিনাজপুরে জন্ম খালেদা জিয়ার। সাধারণ পারিবারিক জীবন থেকে তিনি উঠে আসেন জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নীরব সহায়কের ভূমিকা পালন করেন। উনিশশো একাশি সালে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং উনিশশো চুরাশি সালে বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অবদান
উনিশশো একানব্বই সালে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। তাঁর নেতৃত্বে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে বিনামূল্যের প্রাথমিক শিক্ষা, মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি, খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি চালু হয়। যমুনা বহুমুখী সেতু নির্মাণের উদ্যোগ এবং সার্ক সম্মেলন আয়োজন তাঁর সরকারের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ছিল।
পরবর্তী সময়ে তিনি আরও দুইবার প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর তৃতীয় মেয়াদে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পায়, শিল্প ও টেলিযোগাযোগ খাতে অগ্রগতি হয়। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নতুন বাহিনী গঠন ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়। তবে দুর্নীতির অভিযোগ ও রাজনৈতিক অস্থিরতাও তাঁর শাসনামলের অংশ ছিল।

কারাবাস ও শেষ অধ্যায়
দুই হাজার সাত থেকে দুই হাজার আট সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। দুই হাজার আঠারো সালে দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে তিনি কারাবরণ করেন। কোভিড মহামারির সময় মানবিক বিবেচনায় মুক্তি পেলেও বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা ছিল। অবশেষে দুই হাজার চব্বিশ সালের আগস্টে তিনি সব সাজা থেকে মুক্তি পান।
গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে উত্তরাধিকার
খালেদা জিয়া আপসহীন গণতন্ত্রকামী নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান, স্বৈরশাসনের সঙ্গে আপস না করার দৃঢ়তা এবং কারাবরণের আশঙ্কা জেনেও দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত তাঁর চরিত্রের পরিচয় বহন করে। ব্যক্তিগত জীবন থেকে জাতীয় রাজনীতি—সব ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন দৃঢ়তার ছাপ।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















