শীত নামলেই ভিয়েনা যেন ফিরে যায় নিজের পুরোনো ছন্দে। ঝাড়বাতির আলোয় সাদা টাই আর দীর্ঘ গাউন পরে ওয়াল্টজে মেতে ওঠে নানা বয়সের মানুষ। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়টাকে এখানে বলা হয় বলের মৌসুম। শহরজুড়ে প্রায় সাড়ে চারশোর মতো নৃত্যানুষ্ঠান হয়, যেখানে ঐতিহ্য আর আধুনিকতা একসঙ্গে হাত ধরে চলে।
ভিয়েনা ফিলহারমোনিক বলের রাজকীয় ঐতিহ্য
নতুন বছরের কনসার্ট শেষ হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই স্বর্ণখচিত মিউজিকভেরাইন মিলনায়তনে বসে ভিয়েনা ফিলহারমোনিক বল। অতিথিদের জন্য ধাতব বাদ্যের ধ্বনি, মাথায় বিশেষভাবে তৈরি মুকুট পরে অভিষিক্ত তরুণ যুগলদের নাচ, সব মিলিয়ে এই বলকে শহরের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আয়োজনগুলোর একটি হিসেবে ধরা হয়। এবারের আসরে দুই শতাধিক তরুণ যুগল অডিশন দিয়েছিলেন, তবে নির্বাচিত হয়েছেন মাত্র আশিজন। এই আয়োজন শুধু নাচ নয়, বরং ভিয়েনিজ সংস্কৃতির জীবন্ত জানালা।
সংগীত, থিম আর নতুন প্রজন্ম
আগামী আসরে কন্ডাক্টরের দায়িত্বে থাকছেন ড্যানিয়েল হার্ডিং। অনুষ্ঠানে থাকছে রুশ সুরকারদের কাজের পাশাপাশি ওয়াল্টজের রাজা ইয়োহান স্ট্রাউসের সুর। আগের আসরে স্ট্রাউসের জন্মের দুইশ বছর উদ্যাপন করা হলেও এবার বেছে নেওয়া হয়েছে রূপকথার আবহ। ঐতিহ্য ধরে রেখেও সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে চাইছেন আয়োজকেরা, এমনটাই জানিয়েছেন দীর্ঘদিনের সংগঠক পল হালভাক্স।

অর্থনীতির চাকা ঘোরানো এক উৎসব
এই বলগুলো শুধু বিনোদনের জন্য নয়, ভিয়েনার অর্থনীতিরও বড় চালিকাশক্তি। সাম্প্রতিক মৌসুমে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ এসব আয়োজনে অংশ নিয়েছেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পর্যটক। একটি সন্ধ্যায় একজন অতিথির খরচ থেকে শুরু করে খাবার, পোশাক, নৃত্যশিক্ষালয় আর পানীয়—সব মিলিয়ে শহরে শত শত মিলিয়ন ইউরোর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তৈরি হয়। বলের মৌসুমে হাজার হাজার বোতল মদ ও শ্যাম্পেন খরচ হওয়াও এখানে স্বাভাবিক ঘটনা।
ইতিহাসের ভেতর দিয়ে নাচ
ভিয়েনার বল সংস্কৃতির শিকড় বহু শতাব্দী পুরোনো। মধ্যযুগে শীত তাড়াতে মুখোশ পরে উৎসব করার রীতি ছিল ইউরোপজুড়ে। পরে সম্রাজ্ঞী মারিয়া থেরেসার সময় রাস্তায় এমন সমাবেশ নিষিদ্ধ হলে নাচ ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতরে, ঝকঝকে বলরুমে। উনিশ শতকে ইউরোপের রাজনৈতিক পুনর্গঠনের সময় এসব নৃত্যানুষ্ঠান হয়ে ওঠে সামাজিক যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। সাধারণ মানুষের সরাইখানা থেকে শুরু হওয়া ওয়াল্টজ ধীরে ধীরে অভিজাত সমাজে জায়গা করে নেয়।
ব্যক্তিগত স্মৃতি আর সমসাময়িক বাস্তবতা
এই বছরের বলের বিশেষ আকর্ষণ তরুণ জোয়ি শোনবার্গ, যিনি বিখ্যাত সুরকার আর্নল্ড শোনবার্গের প্রপৌত্র। পরিবারের ইতিহাসে নাৎসি নিপীড়নের স্মৃতি থাকা সত্ত্বেও এই মঞ্চে নাচতে পারা তার কাছে ইতিহাস পুনরুদ্ধারের মতোই আনন্দের। আয়োজকেরা মনে করেন, যুদ্ধ আর জ্বালানি সংকটের মতো কঠিন বাস্তবতার মাঝেও মানুষ এমন একটি রাত চায়, যেখানে দুশ্চিন্তা ভুলে সুর আর নাচে হারিয়ে যাওয়া যায়। এই বল সেই সুযোগটাই দেয়।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















