শ্রী নিখিলনাথ রায়
হীরাঝিল
সিরাজের সাধের হীরাঝিল এবং তদুপরিস্থিত প্রাসাদ অনেক দিন হইতে কালগর্ভে নিমগ্ন হইতে আরম্ভ হইয়াছে। তাঁহার নিজ স্মৃতি যেমন বিশ্বতির প্রগাঢ় অন্ধকারময় অনন্ত গর্ভে চিরনিদ্রিত রহিয়াছে, সেইরূপ তাঁহার প্রাসাদাদির চিহ্নও কালসমুদ্রে নিমগ্ন হইতে হইতে না জানি কোন্ অনিশ্চিত দেশে আশ্রয় লইতেছে। বিধাতার ইঞা, মুর্শিদাবাদের সহিত সিরাজের সকল সম্বন্ধ ঘুচিয়া যায়। যে হতভাগ্য অতুলনীয় রূপরাশি ও অতুল সম্পত্তি লাভ করিয়াও সংসারে দুই দিন ভোগ করিতে পাইল না, তাহার আর স্মৃতিচিহ্ন থাকিবার প্রয়োজন কি?
মুর্শিদাবাদ তাহার প্রাণ অপেক্ষা প্রিয়তর হইলেও, হতভাগ্যের প্রদত্ত অলঙ্কার সে অনায়াসে ভাগীরথীজলে বিসর্জন দিতে পারে। তাই কাল একে একে মুর্শিদাবাদের সকল অলঙ্কারগুলি খুলিয়া কতক বা ভাগীরথীজলে, কতক বা বসুন্ধরাহৃদয়ে মিশাইয়া দিয়াছে। যদিও সকলের প্রদত্ত অলঙ্কার-রাশি মুর্শিদাবাদনগরী একে একে উন্মোচন করিতেছে, তথাপি যাহার দ্বারা সিরাজ তাহাকে শোভা- শালিনী করিয়াছিলেন, সেইগুলি কালপ্রবাহে ভাসাইয়া দেওয়া তাহার সর্বতোভাবে যুক্তিসঙ্গতই হইয়াছে। কারণ, সিরাজ যে তাহাকে প্রাণ অপেক্ষাও অধিক ভালবাসিতেন এবং তাহাকে সৌন্দর্য্যময়ী করিবার জন্ত প্রতিনিয়ত যত্ন পাইয়াছিলেন।
সিরাজ বড় সাধ করিয়া হীরাঝিল ও তাহার উপরিস্থিত প্রাসাদের নির্মাণ করেন। বাঙ্গলা, বিহার, উড়িষ্যার অধীশ্বর হইয়া সেই প্রাসাদে মহানন্দে জীবন যাপন করিবার ইচ্ছা তাঁহার হৃদয়ে অভ্যন্ত বলবতী হইয়াছিল। কিন্তু বিধাতার বিচারে সিংহাসনারোহণের কিঞ্চিদধিক এক বৎসর পরে তিনি ইহ জগৎ হইতে চিরবিদায় লইতে বাধ্য হন। সিরাজের যৌবরাজ্যকালে হীরাঝিলের প্রাসাদ নিৰ্ম্মিত হয়। মোগলসম্রাট্দিগের মধ্যে বাদশাহ শাজাহানের ক্ষার মুর্শিদাবাদের নবাবদিগের মধ্যে সিরাজেরও সৌন্দর্য্যপ্রীতির কথা শুনা যায়। মুর্শিদাবাদের দ্বিতীয় নবাব সুজা উদ্দীনেরও সৌন্দর্য্যপ্রিয়তা ছিল বটে, কিন্তু সিরাজ তাঁহার সে প্রীতিকে অনেক পরিমাণে অতিক্রম করিয়াছিলেন।
সৌন্দর্য্যপ্রীতি অনেক সময়ে বিলাসিতার সহিত বিমিশ্রিত থাকিলেও, বিমল সৌন্দর্য্যপ্রীতি দেবতারও বাঞ্ছনীয়। যদিও সিরাজ-হৃদয়ে তাহা বিলাসাবরণে আচ্ছাদিত ছিল, তথাপি সময়ে সময়ে তাহাকে আবরণোন্মুক্তও দেখা গিয়াছে। হীরাঝিলের প্রাসাদ মুর্শিদাবাদের মধ্যে অতি মনোরম দৃশ্য ছিল। ঝিলের হীরকস্বচ্ছ সলিলরাশি তাহার পদপ্রান্ত চুম্বন করিয়া বেড়াইত এবং স্বীয় বক্ষে তাহার প্রতিচ্ছবি লইয়া ঈষৎ সমীরতাড়নেও কাঁপিয়া উঠিত। যখন জ্যোৎস্নালোকে বিধৌত হইয়া সেই সৌন্দর্য্যসারভূত প্রাসাদরত্ব হাসিতে হাসিতে ঝিলসলিলের ক্রীড়া নিরীক্ষণ করিত, সেই সময়ে কিছু দূরে ভাগীরথীবক্ষ হইতে তাহার অপূর্ব্ব শোভা দেখিলে, মনঃপ্রাণ প্রফুর হইয়া উঠিত। এই সুন্দর প্রাসাদে সিরাজ যৌবনসুলভ আমোদোপভোগ করিতে আরম্ভ করেন।