নিজস্ব প্রতিবেদক
সুন্দরবনের আশেপাশের গ্রামের দরিদ্র জেলে এবং গ্রামবাসীরা প্রজন্মরে পর প্রজম্ম ধরে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনথেকে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বন্য মধু সংগ্রহ করে আসছে। এক সময়ে এই পেশায় বহু মানুষ জড়িত থাকলেও বর্তমানের ওই সব এলাকায় চলাচলের পথ সৃষ্টি হওয়ার ফলে কাজের খোঁজে অনেক অভ্যন্তরীন মাইগ্রেশান হয়েছে। আবার আইলার আঘাত ও চিংড়ি চাষের বিষাক্ত ছোবলে দরিদ্র একটি শ্রেনীর বড় অংশকে অভ্যন্তরীন মাইগ্রেশান করে শহর বা অন্য কোন স্থানে যেতে হয়েছে। তারপরেও এখনও অনেক মানুষ সুন্দরবনের মধু সংগ্রহের কাজ করে বার্ষিক এই মধু সংগ্রহের মৌসুম দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকার দরিদ্র ওই শ্রেনীর মানুষের জন্যে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে আসে। কারণ, এটি তাদেরকে বাড়তি কিছু আয়ের ব্যবস্থা করে দেয়। যারা এই মধু সংগ্রহ করে এলাকার ভাষায় তাদেরকে মৌয়াল বলে।
মৌসুমে ওই সব মৌয়ালরা গড়ে ৭০ থেকে ৮০ ডলার করে উপার্জন করে।
এই অতিরিক্ত অর্থ সাধারণত ওই মাছ ধরার পেশার মানুষেরা তাদের ঋণ পরিশোধ করতে বা নৌকা মেরামত করার কাজে লাগায়। এক সময়ে এ অর্থ দিয়ে অনেকে তাদের স্ত্রীকে রুপোর নাকফুল গড়িয়ে দিতো। যা ছিলো সব থেকে কম দামী গহনা।
মধু সংগ্রহ একটি সাধারণ গ্রামীণ পেশার মত শোনালেও এখানে এটি সম্ভবত পৃথিবর অন্যতম বিপজ্জনক কাজ।
মৌয়ালরা বনে মৌচাকের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানোর সময় তারা যে মারাত্মক শত্রুর মুখোমুখি হতে পারে সেটি দ্য রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
“এই বাঘ থেকেই সবচেয়ে বড় বিপদ আসে তাদের। পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা জেলার বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের অভিজ্ঞ মধু সংগ্রাহক আব্দুস সালাম বলেন, বাঘ ধরা মানেই মৃত্যু।
“তারপর বনের ভিতরে বিষাক্ত সাপ আছে। এই কাদামাটির পানিতে, কুমিরেরা অপেক্ষা করে থাকে,” তারাও সুযোগ পেলে গফ করে ধরে নিয়ে যায়। বা লেজের বাড়ি দিয়ে পানিতে ফেলে মুখে করে পানির তলে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলে।
সালাম বলেন এছাড়া তাদের জলদস্যুদের সমস্যার সাথেও মোকাবিলা করতে হয়। এই সব জলদস্যু অতন্ত নির্দয়। টাকা না পেলে তারা তাদেরকে হত্যা করে নদীতে বা জঙ্গলে ফেলে চলে যায।
বছরব্যাপী বাঘের আক্রমণ ঘটে কিন্তু মধু সংগ্রহের মৌসুমে ঘটনাগুলির সংখ্যা বেড়ে যায়।
প্রতি বছর সুন্দরবনে অন্তত ৮০ জন বাঘের হাতে জীবন দেয়। মৌয়াল কছিমউদ্দিনের মতে মধু সংগ্রহের সময় বাঘের হামলা বেশি ঘটার কারণ, এ সময়ে যতই সর্তক থাকা হোক না কেন, মৌয়ালদের চোখ থাকে মধুর চাকের সন্ধানে গাছের দিকে। নিচের ঘাসের ভেতর দিয়ে কখন নিঃশব্দে বাঘ আসে তার সেটা জানতে পারে না।
মৌচাকের সন্ধান
জেলেরা সাধারণত তিন সপ্তাহ ধরে তাদের ক্রিকি নৌকায় দ্বীপ থেকে দ্বীপে গিয়ে মধু সংগ্রহ করে, যা বিশ্বের কিছু বৃহত্তম এবং সবচেয়ে আক্রমণাত্মক মৌমাছিদের তৈরি মধুর চাক থেকে তাদেরকে সংগ্রহ করতে হয়।
মধু সংগ্রাহকরা সুন্দরবনের বনের মধ্য দিয়ে কাদামাটির লবণাক্ত নদী, খাল এবং সংকীর্ণ চ্যানেলগুলি দিয়ে চলাচল করে।
মধু সংগ্রাহকদের সঙ্গে গিয়ে দেখা গেছে তারা একটি প্রাচীন রীতি পালন করা। সুন্দরবনের জেলেরা বনদেবী বনবিবির পুজো করে। তাদের বিশ্বাস তিনি তাদের বাঘ এবং অন্যান্য বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।
এই জেলেরা, হিন্দু এবং মুসলিম উভয়ই, প্রজন্মরে পর প্রজম্ম ধরে বনবিবি’র পুজো করে আসছে।
এখন অনেকের এ বিশ্বাস না থাকলেও প্রতি বছর বনবিবির পুজো হয় । সঙ্গে তারা শিরনি দেয় সত্য নারায়ন পীরের।
মোবারক গাজী অনেক বৃদ্ধ মৌয়াল। এখন বাড়িতেই থাকে। তার বক্তব্য হলো এখনও এই জীবনবাজী রাখা পেশায় যারা আছে তারা অন্য কোন কাজ না পেয়েই আছে।
কীভাবে মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাচা ঘাসের এক ধরনের বান্ডিল তৈরি করে। তাতে আগুন দিয়ে প্রচুর ধোঁয়া তৈরি করে। ওই ধোঁয়া তারা গাছে উঠে মৌচাকের পাশে নিয়ে যায়। ধোয়ায় মৌমাছিরা টিকতে না পেরে দূরে চলে যায়। সে সময়ে তারা মৌচাকের শেষাংশ অর্থাৎ মধুর থলিটি কেটে নিয়ে আসে। পরে সেটা নিঙড়ে বা চেপে তারা মধু বের করে।
তাদের সময় তারা মধুতে কোন ভেজাল দিতো না। তাই গ্রামের মানুষ তাদেরকে অনেক সম্মান করতো। এখন অনেকে ভেজাল দেয়। মধুর সঙ্গে চিনির পানিও মেশায়।
তাছাড়া তার মতে সুন্দরবনে এখন আর ওই ভাবে গাছ নেই। তাই ফুলও কমে গেছে। যে কারনে মধুও কমে গেছে।