শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৩৮ পূর্বাহ্ন

জীবন আমার বোন (পর্ব-৫২)

  • Update Time : সোমবার, ১৫ জুলাই, ২০২৪, ১২.০০ পিএম

মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন। 

মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে। 

তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু। 

তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক

মাহমুদুল হক

একটা খালি রিকশা দেখে খোকা এগিয়ে গেলেও তার আগেই লাফিয়ে উঠলো অপর একজন উষ্কখুষ্ক যুবক। উঠেই চিৎকার ক’রে বললে: বন্দুকের নল থেকেই বেরিয়ে আসে প্রকৃত ক্ষমতা, ভাইসব, ভাইসব, আপনারা যাত্রা-থিয়েটার দেখে অনেক সময় নষ্ট করেছেন, এবার হাতে অস্ত্র তুলে নিন-

হই হই ক’রে ছুটে এলো একদল, শুরু হ’লো ছোটাছুটি, হুটোপুটি। খোকা দৌড়ে একটা রিকশায় উঠলো। বললে, ‘রামপুরায় চলো-‘

রামপুরায় টেলিভিশন কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকে মুরাদরা। অকারণে মুরাদের জন্যে মন খারাপ হ’লো খোকার। ঐদিন সত্যিই তর্ক করতে নেমে যাচ্ছেতাই অপমান ক’রে ফেলেছে সে। শুধু অপমানই নয়, যথেষ্ট আঘাতও দিয়েছে। সন্দেহ নেই সেদিন সে সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। ওভাবে মুরাদের বড়বোনের প্রসঙ্গ তোলা উচিত হয়নি তার; নোংরামির একেবারে চূড়ান্ত ক’রে ছেড়েছিলো সে। মুরাদ নিজেও খুব ভাল ক’রে জানে, রেক্সে ব’সে গুলতানি মারার সময় বন্ধুরা প্রায় সবাই তার বোন লুলু চৌধুরীকে নিয়ে কদর্যভাবে ইয়ার্কি-ঠাট্টা করে, কেবলমাত্র খোকা এই দলের বাইরে।

‘লুলু চৌধুরীর পাছাটা ঠিক যেন একটা আধমুনে ধামা, একটা চোস্ত খাজুরাহো’, ‘লুলু চৌধুরীর নদগদে পাছা দুলিয়ে হাঁটা, চুলটুলে চাহনি আর ফিক ক’রে হাসা দিয়ে গোটা আদমজী জুট মিলটাই কেনা যায়’, ‘সেদিন স্বপ্ন দেখলাম ন্যাংটো হ’য়ে ঘোড়ায় চেপে সারা ঢাকা শহর টহল দিচ্ছে লুলু চৌধুরী, সাক্ষাৎ লেডিগোদিভা’, ‘লুলু চৌধুরীর শাড়ি পরার স্টাইলটা মারাত্মক, মনে হয় আর দেড় সেকেন্ডের ভিতর গা থেকে সব আবরণ ঝরঝর ক’রে খুলে প’ড়ে যাবে’, হামেশাই মওলা রহমান নুরুদ্দিনদের মুখ থেকে এইসব মন্তব্য শোনা যায়।

লজ্জিত হয় খোকা। মুরাদ তাকে আলাদা চোখে দেখে বলেই বিয়ার খেতে খেতে খুব ‘দুঃখ ক’রে নিজের বোনের প্রসঙ্গ তুলেছিলো। মনের জোর আছে মুরাদের, খোকা নিজেই মর্যাদা রাখতে পারেনি। খুব ছোট হ’য়ে গিয়েছে সে।

রিকশায় ব’সে খোকা ভাবতে থাকে, দিন দিন আমি একটা চাঁড়াল হয়ে যাচ্ছি, চাষাভুষোর মতো যখন মুখে যা আসে তাই বলি, ভারসাম্য রক্ষা করতে পারি না কোনোকিছুর; লুলু চৌধুরী যে পাড়ার খাতায় নাম লেখানো বেশ্যা নয়, তার বন্ধুর বড় বোন, একথা ভালো ক’রে ভাবা উচিত ছিলো। তার সেদিনের সেই কদর্য মন্তব্য থেকে দুয়ের তফাৎ ধরা যায় না।

এমনও হ’তে পারে ভবিষ্যতে কোনো একসময় বেলীর মতো উচ্ছনে যাবে রঞ্জু। তখন! রঞ্জু সম্পর্কে বন্ধুরা তার কানে বিষ ঢাললে কেমন লাগবে তা শুনতে! এখনো যে রজ্জুকে নিয়ে পিছনে পিছনে মনগড়া মন্তব্য করছে না, জোর ক’রে তা’ বলা যায় না। ওদের যা গাছে গরু চরানো স্বভাব, তাতে মন্তব্য না করাটাই অস্বাভাবিক।

খোকার চোখের সামনে কয়েকটি রাস্না ও লিকলিকে লতা মৃদু মৃদু দোল খায়, এবং লতাগুলো এক সময় সাপ হয়ে যায়। তার বুকের ভিতরকুঠরির ফাঁকা কামরাগুলো গমগম ক’রে বেজে ওঠে।

সাবধান হ’তে হবে এখন থেকে। মুরাদের পক্ষে যা অসম্ভব তার কাছে তা অতি সহজ। লুলু চৌধুরীকে কড়কে দেবার ক্ষমতা মুরাদের নেই; রঞ্জুকে অতি সহজেই শাসনে রাখতে পারে সে, বয়েসে ছোট, এখনো চোখ ফোটেনি ওর। খোকার ভিতরের কর্তব্যবোধ দুপুরের রোদের মতোই চড়চড় ক’রে ঝল্ল্সে উঠতে থাকে। লুলু চৌধুরী অথবা বেলীর মতো, অথবা দু’জনের মাঝামাঝি অন্য কারো মতো পাগলামির নেশা কোনো অসতর্ক অসংলগ্ন মুহূর্তেও যাতে ওর মগজে ভর না করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে সেদিকে; রঞ্জুকে হ’তে হবে রঞ্জুর নিজের মতো, অবিচল নির্মেঘ গগনপটে একফোঁটা রঞ্জুকে আলতোভাবে শুইয়ে নিপুণ সতর্কতায় একটার পর একটা ড্যাগার ছুড়তে থাকে সে, যেন চারপাশে গেঁথে যায়, যেন ড্যাগারের মৃত্যু আঁটুনি থেকে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে আসতে না পারে। এক হাতপা ছাড়া নির্বোধ অসহায়তাকে শাসন করতে থাকে খোকা; অবাক হয় সে নিজেই, তার স্বাভাবিক সংযম এক মুহূর্তে যেভাবে কালিমালিপ্ত হ’য়ে যায়, তাতে আর নিজের ওপরে সে তেমন আস্থা রাখতে পারে না। ধূমকেশর বিতৃষ্ণা প্রতিদ্বন্দ্বী হ’য়ে ওঠে খোকার। নিজের সঙ্গে এ এক ধরনের জটিল রহস্যময় বোঝাপড়া; অথবা ভৌতিক পাশাখেলা, কানাকড়িও বাজি ধরেনি, তবু অগোচরে সর্বস্বান্ত হ’য়ে চলেছে।

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024