স্বদেশ রায়
রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে যখন কোন বড় মাপের ঘটনা কোন দেশে বা সমাজে ঘটে, তখন ওই দেশ বা সমাজ শান্তভাবে প্রবাহিত হলেও আর আগের জায়গায় ফিরতে পারে না। তাকে অনেক পরিবর্তন মেনে নিতে হয়। কোন কোন পরিবর্তনে দেশ ও সমাজ পিছিয়ে যায়, কোন কোন ক্ষেত্রে এগিয়ে যায়। বাংলাদেশে গত এক সপ্তাহ ধরে যে ঘটনাগুলো ঘটে গেছে এরপর রাষ্ট্র ও সমাজ তার প্রয়োজনীয় গতিতে শান্ত হবে। এর থেকে অনেক বড় বড় ঘটনার পরেও এ সমাজ ও রাষ্ট্র শান্ত হয়েছে। তবে আগের ঘটনাগুলো যেমন সমাজ ও রাষ্ট্র’র অনেক কিছু পরিবর্তন করেছে এ ঘটনাও তেমনি কিছুটা হলেও পরিবর্তন করবে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র সমাজে গত ৫৪ বছরে বেশ অনেকগুলো ঘটনায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে, সে সব উল্লেখ ও বিশ্লেষণ করতে হলে একটা বই লিখতে হয়। এ সব বই লেখার জন্যেও সময় নিতে হয়। কারণ ঘটনাগুলোর পরিনতিরও রূপান্তর ঘটে। যা হোক, সে আলোচনায় না গিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে দেশে যা ঘটেছে তার দিকে একটু চোখ ফেরানো যেতে পারে। দেখা যেতে পারে কেন ঘটনাগুলো এভাবে ঘটলো।
প্রথমত দেখা গেছে ঘটনাটির সূত্রপাত হয়েছে চাকরিতে রিজার্ভেশান বা কোটা রাখা’র আন্দোলন থেকে। এ আন্দোলন আগেও একবার হয়েছিলো। ২০১৮ সালে। তখন প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে ঘোষনা দিয়ে সব ধরনরে কোটা বাতিল করে ওই আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটান।
এরপরে দেখা যাচ্ছে ২০২১ সালে সাতজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের ভবিষ্যত জেনারেশান কোটা না থাকায় ক্ষতিগ্রস্থ হবে এ কারণে সংক্ষুব্দ হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের পক্ষে হাইকোর্টে একটা মামলা দায়ের করেন। ব্যারিষ্টার তানিয়া আমির লিখেছেন, যে সাতজন একটি সংগঠনের নামে সংক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেন তাদের সংগঠনটির কোন রেজিষ্ট্রেশান বা আইনগত ভিত্তি নেই। তাই তারা সকলে এখানে ব্যক্তি, কোন সংগঠন নয়। ব্যক্তি সংক্ষুব্ধ হয়ে শুধুমাত্র তার নিজের জন্যে মামলা করতে পারে। সকলের জন্যে বা গোষ্ঠির জন্যে করতে পারে না।
তাছাড়া তারা মামলা করছে তাদের জন্যে যারা এখনও জম্মায়নি। তাই সব মিলে এই মামলা হাইকোর্টে গ্রহনের কোন বৈধতা ছিলো না। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদেরও সন্তান জম্মেছে তবে তাদের বেশিভাগ শিশু। তার থেকে বড় দিক হলো, যেহেতু যে সংগঠনটি মামলা করেছে সেটা বৈধ সংগঠন নয়। তাদের সকলের পক্ষে মামলা করার অধিকার নেই। তাহলে তিন বছর ধরে যখন এই মামলাটি চললো সে সময়ে দেশের আইনমন্ত্রী কী করলেন?
এত বড় একটা সেনসেটিভ বিষয় যা ২০১৮ সালে তার দল ও দেশের মানুষ দেখেছে সেই বিষয় নিয়ে মামলা চলছে, আর তা ক্ষতিয়ে দেখার তার একবারও সময় হয়নি ! মামলাটি চলার বৈধতা আছে কিনা এ নিয়ে তিনি দেশের বিজ্ঞ আইনজীবিদের সঙ্গে কথা বলার কোন সময় পাননি? তিনি তার দায়িত্ব পালন করলে তো হাইকোর্টের যে রায় সুপ্রীম কোর্ট বাতিল করেছে ওই রায়ই হাইকোর্ট দেবার কোন সুযোগ পায় না। বাস্তবে দায়িত্ববানদের এ ধরনের ভুল বা দায়িত্ব পালনে অবহেলাই একটি দেশে বা সমাজে অনেক সময় ভয়াবহ ঘটনা ঘটার সুযোগ দেয়।
তারপরেও যখন হাইকোর্টের রায় হয়ে গেলো ও সুপ্রীমকোর্ট “স্টাটাস কো” দিলো অর্থাৎ হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা থাকলো না সে সময়েও তিনি কেন বিষয়টি নমনীয় ও মার্জিত ভাষায় ব্যাখা করলেন না? সুপ্রীম কোর্টে এই মামলার রায় দেবার আগে প্রধান বিচারপতি দেশের তরুনদের উদ্দেশ্যে যে ভাষায় কিছু কথা বলেন, আইনমন্ত্রী যদি আগেই অমন সুন্দর, ভবিষ্যতমুখী ও তরুণরদের প্রতি ভালোবাসার কথাগুলোর দশভাগের একভাগও মন্ত্রী হিসেবে তরুণদের কাছে গিয়ে বলতেন ও তার দলের নেতাদের কাছে তুলে ধরতেন; যা আইনমন্ত্রী হিসেবে তার দায়িত্ব ছিলো- তাহলেও ঘটনা এভাবে প্রবাহিত হতে পারতো কি?
কারণ, পুরো ঘটনায় তার দলের অধিকাংশ নেতার বক্তব্য থেকে বোঝা গেছে তাঁরা বিষয়টির আইনগত দিক সম্পর্কে অবহিত নয়। এমনকি এটর্নী জেনারেল অফিস সঙ্গে সঙ্গে হাইকোর্টের রায়ের বিপরীতে সুপ্রীম কোর্টে আপীল করার পরে যখন সরকারও আন্দোলনকারীরা উভয়েই একই নৌকায় অর্থাৎ উভয়েই কোটা প্রথা বাতিলের পক্ষে – সে সময়ে তিনি আইনমন্ত্রী হিসেবে কেন ছাত্রদের কাছে গেলেন না?
হতে পারে তার এই সকল ভুলের মূল কারণ তিনি অরাজনৈতিক ব্যক্তি এজন্য। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি রাজনীতির ভাগ পেয়েছেন, কিন্তু রাজনীতির ভেতর দিয়ে আসেননি। তাই তিনি তার দলের জেনারেল সেক্রেটারিকেও বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেননি বা সুযোগ পাননি। সুযোগ পাননি বলছি এ কারণে যে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা বলে দেয়, কোন কোন রাজনৈতিক নেতা যখন অতিরিক্ত ক্ষমতাশালী হয়ে যায় তখন তার কলিগরাও তার সঙ্গে দেখা করার বা কথা বলার সুযোগ পান না। যেমন ১/১১ ঘটতে যাচ্ছে এটা জানতে পেরেও সাইফুর রহমান ও মান্নান ভুইয়া তা বেগম জিয়াকে টেলিফোনে ও সশরীরে গিয়ে জানানোর সুযোগ পাননি এমন তথ্যও নির্ভর যোগ্য সূত্র থেকে পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটাররি মধ্যেও এখন সেই সময়ের বেগম জিয়ার চরিত্রের ও ভাষার ছাপ পাওয়া যায়। তিনি যেমন তার কলিগদের মূল্য দেন না তেমনি তার যে কথাটি মূলত কোটা আন্দোলনের দাবীতে ছাত্ররা যে অহিংস আন্দোলন করছিলো তার মোড় ঘুরিয়ে দেয় তা বেগম জিয়ার ১৯৯৫ সালের একটা কথার প্রতিধ্বনি।
বেগম জিয়া ১৯৯৫ সালে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের আন্দোলন দমন করার জন্যে ছাত্রদলই যথেষ্ট। এবার তারই প্রতিধ্বনি শোনা গেলো আওয়ামী লীগেরে জেনারেল সেক্রেটারি ওবায়দুল কাদেরের কণ্ঠে। তিনি বললেন, “ কোটা আন্দোলন বন্ধ করার জন্যে ছাত্রলীগই যথেষ্ট”। এর পরে তার নির্দেশে ছাত্রলীগ যা করলো কোটা আন্দোলনকারীদের প্রতি বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে এর ধারে কাছে কাজ শুধুমাত্র মোনায়েম খানের এন এস এফ এর ইতিহাসে আছে। তাও এতটা নয়।
ওই দিনের সোশ্যাল ফোরামে, বৈদ্যুতিন মিডিয়ায় ও পরবর্তী দিন সংবাদপত্রে ছাত্রলীগের কর্মকান্ডের যে সকল ছবি ছাপা হয়েছিলো তারপরে বাংলাদেশের বিবেকবান মানুষ ও সাধারণ তরুণ সমাজের মনোজগত সম্পূর্ণ বদলে যায়। তারপরেও তিনি এখনও ছাত্রলীগের ওপর হুংকার ছাড়ছেন, তারা কেন সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে এলো। বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী যদি তাদেরকে বিশ্ববিদ্যলয়ের হল ছেড়ে চলে আসতে বা পালিয়ে আসতে নির্দেশ না দিতেন তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় চত্তরে যে একের পর এক ডেড বডি পড়তো- তাতে কোন সন্দেহ ছিলো না।
যে কোন মৃত্যু আন্দোলন ও ক্ষোভকে জ্বালানি দেয়; আর সেই মৃত্যু যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্তরে হতো তাহলে গত সাতদিনের অবস্থা যে আরো ভয়াবহ হতো তাতে কারো প্রশ্ন থাকার কথা নয়। আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি কার হয়ে এ কাজটি করলেন, এটা ইতিহাসের একটা বড় প্রশ্ন। তবে হতে পারে তিনি দুবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে এখন ট্রমাটাইজড আছেন। তাই এ ধরনের একজন ট্রমাটাইজড ব্যক্তিকে এত বড় দায়িত্বে না রেখে বিদেশের কোন ভালো ট্রমা সেন্টারেই দ্রুত রাখা উচিত।
বাস্তবে কোটা আন্দোলনকারীদের আন্দোলন প্রথম থেকে লক্ষ্য করে দেখা যাচ্ছিলো সেখানে কিছু বিরোধী রাজনৈতিক দলের ছাত্র ছাত্রী আছে তবে বেশিভাগ সাধারণ ছাত্র ছাত্রী। এবং তারা কম পক্ষে দশ বারোটি গ্রুপে ভাগ ছিলো। আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী তাদের ওপর ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেবার পরে তারা সকলে এক হয়ে যায়। তাদেরকে এই এক জায়গায় এনে শক্তিশালী করার কাজটিও মূলত তিনি করে দেন।
আগের একটি লেখায়ও উল্লেখ করেছি, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্সের একটি বক্তব্য’র খন্ডিত অংশ ও ছাত্রদের একটি স্লোগানের খন্ডিত অংশ নিয়ে বেশ বির্তক সৃষ্টি হয়। যার মূল কথা ছিলো “রাজাকার” শব্দটি। আর এই আগুনে ঘি ঢেলে দেন দেশের জনপ্রিয় একজন সায়েন্স ফিকশন লেখক।
তিনি হয়তো ভালো সায়েন্স ফিকশন লেখেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও শিশুতোষ গল্প লিখেছেন। তবে রাজনীতি ও সমাজ সম্পর্কে তিনি যে সচেতন বা দায়িত্ববান নন তার প্রমান পাওয়া গেলো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চল্লিশ হাজার ছাত্র ছাত্রীকে তিনি “রাজাকার” বলে চিহ্নিত করে দিলেন।
প্রথমত তাকে বুঝতে হতো, একাত্তর সালে বেশিরভাগ মানুষ মুক্তিযুদ্ধ’র পক্ষে ছিলেন। এবং রাজাকারের সংখ্যা কয়েক লাখে সীমিত ছিলো। তারপরেও কোন মতেই বর্তমানের তরুণদেরকে কেউ রাজাকার বলতে পারে না। তাছাড়া ইতিহাসের দিকে তাকালেও এ সত্য অন্তত আমরা জানি, পাকিস্তানি সেনারা সাধারণ মানুষ হত্যার জন্য নিন্দিত হয়েছিলো, আলবদররা নিন্দিত হয়েছিলো বুদ্ধিজীবি হত্যার জন্যে।
আর রাজাকাররা নিন্দিত হয়েছিলো মানুষের সম্পদ লুটপাট করার জন্যে। রাজাকারদের এই নিন্দিত অবস্থানকে কিন্তু ১৯৯১ থেকে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতিটি দলের জনপ্রতিনিধিরা অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে। কারণ, প্রতিটি দলের স্থানীয় পর্যায়ের অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি এত বেশি অপরের সম্পদ, সরকারের সম্পদ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ দখল করে চলেছে, মানুষ তাদেরকে রাজাকারের থেকে খুব বড় কিছু মনে করে না।
আজ রিকসা স্টান্ড থেকে শুরু করে গরুর হাট অবধি জনপ্রতিনিধি বা তাদের আত্মীয়রা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দখল করছে। দখল করছে দুর্বলের সম্পত্তি। আর গত দশ বছরের বেশি সময় ক্ষমতাসীনদের জনপ্রতিনিধিদের জনগনের কাছে ভোটের জন্যে না গিয়েই জনপ্রতিনিধি হবার সুযোগ হওয়ায় তারা আরো বেশি এ কাজে উম্মত্ত হয়ে উঠেছে। যাতে একাত্তরে রাজাকারদের যেমন জনসমর্থন ছিলো না এখন এদেরও অধিকাংশের সেই অবস্থা।
আর তা একেবারেই পরিস্কার হয়ে গেলো যখন ছাত্র আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে বিরোধী দল ও মৌলবাদী গ্রুপরা পরিকল্পিত আন্দোলন শুরু করলো। তারা সারা দেশে বিভিন্ন রাজপথ দখল করলে এই সব নেতাদের অনেকে নিজে বাঁচার জন্যে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে- তার জন্যে পুলিশ পাঠাতে। যে সময় তার লোকজন নিয়ে পুলিশের পাশে থাকার কথা ছিলো সে সময় সে নিজে বাঁচার জন্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পুলিশ পাঠাতে বলে।
রাজনৈতিক আন্দোলনের সাংবাদিকতা করার অভিজ্ঞতা থেকে ঘটনা প্রবাহ দেখে ধরে নেই ১৮ তারিখ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে কারফিউ দেয়া হবে। এবং সেনাবাহিনীকে দেশের স্থিতি অবস্থা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব দেয়া হবে। কিন্তু সরকার কেন সেখানে শুক্রবার রাত বারোটা অবধি অপেক্ষা করলো, এটা কি দূর দৃষ্টির অভাব না সিদ্ধান্তহীনতা তা বোঝা গেলো না। তবে এর ফলে যা ঘটলো, এখনও অবধি পত্র পত্রিকার খবর অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ২ শত ছাড়িয়ে গেছে। যা অনেক রক্ত। এত বড় রক্তের মূল্য সব সময়ই দেশ ও জাতিকে আরো বড় আকারে শোধ করতে হয়।
অন্যদিকে সোম ও মঙ্গল এই দুই দিন ঢাকার রামপুরা ও বাড্ডা রোড, টেলিভিশন সেন্টার, সেতু ভবন, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ও মীরপুর ১০ নম্বরের মেট্রোরেলের ক্ষতিগ্রস্থ স্টেশন, ঢাকা উত্তররের ময়লা রাখার গাড়ির স্থান ও কাজী পাড়া ক্ষতিগ্রস্থ স্টেশন এলাকা ঘুরে দেখি। বুধবার থেকে যানজট হয়ে যাওয়াতে উত্তরা, যাত্রাবাড়ি ও শনির আখড়া এলাকায় যেতে পারিনি।
রামপুরা ও বাড্ডা রোডে গাছগুলো বিশেষ করাত দিয়ে কাটা হয়েছে। বাড্ডায় শুধু একটি বিশেষ ইউনিভারসিটি ভেঙ্গেছে আন্দোলনকারীরা তাছাড়া অন্য কারো কোন ব্যক্তিগত সম্পদের ক্ষতি করেনি। বিটিভির বাইরের থেকেই তার পোড়া অবস্থা দেখি। আর বেশ কিছু নির্ভর যোগ্য সুত্রে জানতে পারি, বিটিভির ভেতর থেকে গেট খুলে দেয়া হয়েছিলো ও যারা টিভি সেন্টারের ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতিতে আগুন দিয়েছে তাদেরকে ভেতরের কিছু লোক সহায়তা করে।
মীরপুর দশ নম্বরের মেট্রো রেল স্টেশনের গার্ড লিটন যে ওই দিন রাত একটা অবধি সেখানে আটকা পড়েছিলো তার ভাষ্য হলো, ছাত্ররা বেলা ৫ টার সময় উঠে গিয়েছিলো সেখান থেকে। এবং তারা সকলের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছিলো। এমনকি তাদের খাবার থেকে তাকেও খাবার সরবরাহ করেছিলো।
অন্যদিকে স্টেশন আক্রমন শুরু হয় সন্ধ্যা সাতটার দিকে। লিটনের মতে, তার ভেতর দু একজন ছাত্র থাকলে থাকতে পারে তবে সবই অপরিচিত লোক। তাছাড়া সে স্থানীয় নয়, তাই তারপক্ষে তাদের চেনা সম্ভব হয়নি। রাস্তার পাশের দোকানের সেলসম্যানরাও তাদেরকে চেনে না বলে জানায়।
তবে পরবর্তীতে টেলিফোনে ওই এলাকার কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, ওই রেল স্টেশন যারা ভাঙতে এসেছিলো তার সঙ্গে বাসের শ্রমিকরাও ছিলো। কারণ, মেট্রোরেল চালু হওয়াতে বাস ব্যবসা একেবারে বসে গেছে। তবে গার্ড লিটনের ও অনান্যদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায়, যারা মেট্রোরেলের স্টেশনটি নষ্ট করেছে তাদের সঙ্গে এক্সপার্ট ছিলো। তাছাড়া যেগুলো তারা যেভাবে নষ্ট করেছে ওগুলো সাধারণ মানুষের বোঝার কথা নয়।
অন্যদিকে আর যে বিষয়টি বলা হচ্ছে বিরোধী দল ঢাকায় কয়েক লাখ লোক ঢুকিয়েছে আগে থেকে। কেউ কেউ এটাকে দশ লাখও বলছে। তবে গত কয়েকদিনে বিভিন্নভাবে খোঁজ নিয়ে যা জানা যায়, তা হলো গত পনেরো বছরে মামলা ও এলাকায় টিকতে না পেরে বিরোধী দলের কম পক্ষে ৫০ থেকে ৬০ হাজার কর্মী ঢাকায় নানাভাবে সব সময়ই অবস্থান করছে।
পাঁচ থেকে ১০ হাজার লোক সপ্তাহ জুড়ে জামিনের জন্যে আসে। এর পরে ঢাকার আশে পাশের জেলা থেকে যদি আর ২০ হাজার লোক ঢোকে এই সব মিলেই তো ফাঁকা মাঠে (অর্থাৎ সরকারি দলের কর্মীরা যখন ভয়ে ঘরে ঢুকে গেছে সে সময়ে) আন্দোলন করার জন্যে যথেষ্ট।
আর বাড্ডা, উত্তরা, শনির আখড়া, সাইনবোর্ড এলাকার আন্দোলনে যে মাদ্রাসার ছাত্ররা অংশ নেয় এদের সঙ্গে কিছু অন্য জেলা থেকে এসেছে তা মৃতদেহ সনাক্তের মধ্য দিয়ে জানা গেছে। তবে আওয়ামী লীগ সমর্থকরাই জানায়, উত্তরার সঙ্গে যুক্ত আশকোনা থেকে আশুলিয়া এবং টঙ্গীর দুপাশের মাদ্রাসা মূলত গাজীপুরের প্রাক্তন মেয়র জাহাঙ্গীরের আনুকূল্যে গড়ে ওঠা।
অন্যদিকে সাইনবোর্ড এলাকার মাদ্রাসা শক্তিশালী করার জন্য বেশি সহায়তাকারী শামীম ওসমান বলেই ওই এলাকার আওয়ামী লীগের সজ্জন ব্যক্তিদের মত। বাড্ডা এলাকায়ও গলিতে গলিতে মাদ্রাসা। এই সব মিলে ছাত্রদের আন্দোলন ছিনতাই করে নিয়ে কারা আন্দোলনকে ভিন্ন পথে নিয়ে গেছে তা অনেকটা পরিস্কার হয়।
তবে তারপরেও এবারের এ সত্য স্বীকার করতে হবে, রাজপথে না এলেও সাধারণ মানুষ আন্দোলনকারীদের বাধা দেয়নি। কারণ, ছাত্রলীগের হামলা সাধারণ মানুষ ও সাধারণ ছাত্রদের মনোজগত পালটে দেয়। তার ওপর সময় মতো সেনাবাহিনীর সহায়তা না নেওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে।
এছাড়া আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতাদের অনেকের অত্যাচারী জমিদারী আচরণ, নিত্যপন্যের দাম- সাধারণ মানুষকে ভিন্ন অবস্থানে নিয়ে গেছে। তার সঙ্গে আরো বড় যে পরিবর্তন হয়েছে, আওয়ামী লীগের ত্যাগী কর্মীদের প্রায় ৬০ ভাগই জীবন সংগ্রামে হাবুডুবু খাচ্ছে। কারণ, তাদের দেখার কেউ নেই। নেতারা নব্য সুবিধাবাদীদের নিয়ে চলছে। অন্যদিকে, ত্যাগী কর্মীদের অনেকের বয়স হয়ে গেছে।
নতুন করে ত্যাগী কর্মী তৈরি হবার থেকে সুবিধাবাদী তৈরি হয়েছে বেশি। তাই সাংগঠনিকভাবে আওয়ামীলীগ এখন সত্যি কোন ঝড় মোকাবিলার জন্যে যথেষ্ট কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আর সে প্রশ্নের উত্তরও মিলেছে গত সাত দিনে। মানুষ এখন সত্যি অর্থে ধন্যবাদ দিচ্ছে সেনাবাহিনীর দক্ষতাকে।
তারা নামার পরে যখনই পুরোপুরি দায়িত্ব পেয়েছে তারপর থেকে শুধু আগের আহতরাই হাসপাতালে মারা গেছে। নতুন করে আর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। যার ফলে প্রমানিত হয়েছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগে নয়, যে কোন দুর্যোগে দেশের সম্পদ।
অন্যদিকে শুধু বাহ্যিক দিক না দেখে এত বড় একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এর ভেতরের দিকেও নজর দিতে হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে। কারণ, পৃথিবীর সব থেকে বড় উপসাগর বঙ্গোপসাগর যা পাঁচটি দেশের সীমানা ছুঁয়ে আছে। বাংলাদেশ তার একটি। ভবিষ্যতের ভূ-রাজনৈতিক গেমের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ যে ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকা সেখানে চায়না ও তার বিপরীত প্রতিদ্বন্দি “কোয়াড” জোট এর উভয়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এই বঙ্গোপসাগর।
ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগর ছোঁয়া বড় একটি দেশ মিয়ানমার একটি বাফার স্টেটে পরিনত হয়েছে। তাছাড়া এসব পরিবর্তন এমন একটি সময়ে ঘটছে যে সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো অবস্থানে নেই। এবং দেশের মানুষকে আপাত স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিতে সব থেকে বড় অবদান রেখেছে দেশের সেনাবাহিনী।
এ কারণে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও দেশের অভ্যন্তরের কোন বড় ঘটনা সত্যি যখন দেশ ও সমাজকে নাড়া দেয় তখন কোন সমাজ বা দেশ আর তার আগের জায়গায় শতভাগ ফিরতে পারে না। তাকে কিছুটা হলেও নতুন করে সাজাতে হয়, আর সেখানে ভুল করলে আরো বেশি মূল্য দিতে হয়। এ কারণে এমন ঘটনার পরে সাময়িক স্থিতি অবস্থাকে স্বাভাবিক মনে করলে যে কোন রাষ্ট্র ও সমাজকে আরো বেশি মূল্য দিতে হয়। নিকট ও দূর ভবিষ্যত নিয়ে পরিবর্তিত হবার সময় এখন দ্রুত বয়ে যাচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিকতায় রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The present World.