মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
মাহমুদুল হক
খচড়ামিটা তোর আজন্মকালের ঘোড়ারোগ। সব কথা বুঝেও না বোঝার ভান ক’রে আমার কাঁধে গায়ের জোরে একটা মত চাপাতে চাচ্ছিস তুই।’
‘চোখের পলক পড়তে না পড়তে পাঁচশো টনের একটা কোবাল্ট বম গোটা পৃথিবীকে হিরোশিমা ক’রে ছাড়তে পারে ব’লে মানুষকে আমরা আজকের মানুষ হিসেবে যেমন চিহ্ন দিতে পারি না, ঠিক তেমনি রাশিয়ার নিপীড়িত জনগণ জারতন্ত্রকে উচ্ছেদ ক’রেছে ব’লে তাদেরও আমরা আজকের মূর্তিমান মানুষ বলে আখ্যা দেবো না। এই মুহূর্তে তুই আর আমি এই রমনা রেস্তরাঁয় ব’সে যাকে আজ ব’লে আখ্যায়িত করছি, আর মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তা গতকাল হ’য়ে যাবে। গতকাল আজ আগামীকাল এগুলোর ঠুনকো আপেক্ষিকতাকে তুই নিশ্চয়ই স্বীকার করিস। কিন্তু মানুষ, যখন আকাশে তারার অভ্যুদয় ঘটেনি তখনকারও এক সভ্যতার কথা আমরা শুনে থাকি, টিটিকাকা হদের কোলে টিয়াহুয়ানাকোর সভ্যতা এই ধরনের প্রাচীন। গতকালকের মানুষ আর আজকের মানুষ ব’লে কোনো কথা নেই। টিয়াহুয়ানাকোর মানুষও যা, ঘাটমোসের মিশরীয়রাও তাই।
কখনো সিজারকে সে হাতের স্টাইলাসে কুপোকাত করছে, কখনো সিংহের চামড়া পরে যোদ্ধার বেশে বাঁদর নাচ নাচছে মোজাম্বিকে। প্রত্যেকেই মানুষ। দলাক্রোয়াও মানুষ ছিলো, শাগালও মানুষ, রশিদ চৌধুরীও মানুষ। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ কিংবা বিনয় মজুমদারের সঙ্গে বংগো বাজানো প্রাদোর আমি কোনো তফাত দেখি না। লা-হোলা লেখা মৌপাসার সঙ্গে একজন ভুডো এক্সপার্টের আদতেই কোনো প্রভেদ নেই। সবক্ষেত্রেই ওই একই কথা, মানুষ। পাঁচশো টনের কোবাল্ট বম ঝাড়তে পারিস ব’লে, কিংবা লংমার্চ করতে পারিস ব’লে তুই মুরাদ চৌধুরী কিংবা শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী আজকের মানুষ হ’তে পারিস না। মানুষ পিরামিড গড়েছিলো, মানুষ কলোশিয়াম নির্মাণ করেছিলো, বাগদাদের ইলেকটিক ব্যাটারির কথা শুনিসনি!’
‘এখন দয়া ক’রে কিছুক্ষণের জন্যে তোর ওই ব্যাপারটাকে তুলে রাখ, এসব ফালতু কথা ঘাঁটাঘাঁটির কোনো মানে হয় না। তুই ঘরের দরোজা বন্ধ ক’রে ভুডো প্রাকটিস কর, আমাকে ওর ভিতর জড়াসনে। তোর লাইন আলাদা। তুই শালা ডাক্তারকে বলিস ম্যাজিশিয়ান, ভ্যালিয়মকে বলিস মাদুলি, অক্সিজেনকে বলিস ঝাঁড়ফুক। আমার স্পষ্ট মনে আছে এখনো গত বছর স্যালাইনকে অক্ষতযোনী ষোড়শীর টাটকা পেচ্ছাব বলায় হাসপাতালের ডাক্তাররা তেড়ে এসেছিলো তোকে মারতে।’
‘কথাটা ঘুরিয়ে দিলি তো? ভালোই করেছিস-‘
‘এই রোবটের কথা শুনলেই আমার গা শিরশির করে। যে কথার জন্যে এসেছিলাম এখানে, তা আর বলা হবে না আজ।’
Leave a Reply