স্বদেশ রায়
রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলো নাটকে বার বার একজন “ঠাকুরদা” ( গ্রান্ড ফাদার) থাকেন। যৌথ পরিবারগুলো ভেঙ্গে গিয়ে আজ আর ঠাকুরদাকে ওইভাবে চেনা সম্ভব হয় না। কারণ, এখন সেই সমাজ ও সেই মনোজগত নেই যে সকলে মিলে এক সঙ্গে বাস করা যাবে।
আগে যৌথ পরিবারে কে না ছিলো? বিধবা পিসির তিন ছেলের বৌ থেকে শুরু করে সাত পুরুষের চাকরের নাতি নাতনি অবধি। সেখানে পিসির ছেলের বৌ আর নিজের ভাইয়ের বউ- বৌদি হিসেবে একই সমতলে ছিলো। চাকর বাকরদের ছোট বেলা থেকে চাকর বাকর হিসেবে ভাবতে শেখার কোন উপায় ছিলো না। কারণ তারা কেউ ছিলো মামা, কেউ দাদু, কেউ কাকু, কেউ দিদি, কেউ পিসি বা কেউ মাসি। তাদের কারো সঙ্গে যে রক্তের কোন সম্পর্ক নেই তা কখনও মাথায় আসার পথ ছিলো না। কারণ, সম্পর্ক গুলো রক্তে নয় হৃদয়েই অবস্থান করতো বেশি।
গোটা পরিবারটি ছিলো হৃদয় দিয়ে গড়া। তারপরেও ওই পরিবারে শিশুর জন্য ভয় ছিলো বড় ভাই বা বড় বোনটি। বড় ভাই বা বোনদের জন্যে বাবা বা মা। সকলের বকাবকি’র থেকে রক্ষা পাবার শেষ আশ্রয় স্থল ছিলো ঠাকুরদা বা দাদাঠাকুর।
যারা এখনও সেই বিশাল যৌথ পরিবারের অভিজ্ঞতার ক্ষীন আলোক রেখা নিয়ে বেঁচে আছেন, সকলেরই মনে পড়বে, ওই শেষ আশ্রয়স্থলের মানুষটির মাথাটি কত শা্ন্ত ছিলো। সবথেকে মনে হতো ঠাকুরদা মানে সেই মানুষটি যিনি শুধু আদর করেন অথচ যার সামনে বাবা, বড় ভাই, মা সকলেই সকল রাগ নিয়ে গেলে মুহূর্তে শান্ত হয়ে যান। বাড়ির একটি দামী জিনিস ভেঙ্গে ফেলেও ঠাকুরদার কাছে গেলে সে যাত্রা রক্ষা পাওয়া যেতো। জ্যাঠাইমা খুব রাগ হলেও ঠাকুরদা কীভাবে যেন তাকে শান্ত করে দিতেন।
কীভাবে ওই ফোকলা দাঁতের মানুষটি সব কিছু অমন করে শান্ত করে দিতেন তা ছোট বেলায় বোঝার কোন উপায় ছিলো বা বোঝার দরকার আছে এমনটিও কখনও ভেবেও দেখেনি। কোন শিশু ভাবে কিনা তাও ওইভাবে জানা হয়নি কোনদিন।
এর পরে একবার, দুইবার তিনবার বরীন্দ্রনাথের নাটক পড়ে গেলেও কখনও ঠাকুরদা বা দাদাঠাকুর যাই বলিনা কেন ওই চরিত্রটিকে অত বড় মনে হয়নি। তাই রাজা নাটক হোক, বসন্ত হোক বা অচলায়তন হোক। বরং চোখ ও মন টেনেছে ঘটনা ও নায়ককে। বিষয়বস্তু খোঁজার জন্যে বার বার ঘটনার চূড়ান্ত পরিনতির ভেতর আলো ফেলার চেষ্টা করেছি। আর তখন মনে হতো রবীন্দ্রনাথ তো শুধু শিল্প’র জন্যে একটি শিল্প তৈরি করেছেন। একটি নাটকের জন্যে একটি নাটক লিখেছেন বা আরো কিছু খুঁজেছি।
ও দিকে আরো যে বড় বিষয়টি এর মধ্যে পরিবর্তন হয়ে গেছে তা হলো এখন তো আর সমাজে ঠাকুরদার সঙ্গে দেখা হবার কোন পথ নেই। বদলে গেছে পৃথিবীটা। বাবার সঙ্গেই দেখা হয় ভিডিও কলে কখনও সখনও। এমনকি শহরের পার্ক থেকে গ্রামের নদী পাড়ের পাখিও গেছে কমে। তারাও এখন আর কাছে আসে না। আবার একটা দুটো পাখি থাকলেও তাও দেখার কোন সুযোগ নেই। আর এই না থাকা নিয়েও দুঃখ করার কিছু নেই। বরং সত্যকে নিতে হবে সহজে।
তারপরেও গত এক দশকে কত না চিন্তা এসেছে, বদলে যাচ্ছে কত পরিবর্তনের ব্যাখ্যা। সামনে এসেছে জিওগ্রাফির শক্তি, শংকিত হতে হয়েছে ন্যারো করিডোর এর একের পর এক তৈরি দেখে, লিবারইজম বা গণতন্ত্রের মৃত্যুকে নানান সুন্দর সুন্দর মোড়কে ঢাকার কৌশল দেখে।
পৃথিবী জোড়া এই সব চিন্তা আর শংঙ্কার পথগুলো নিয়ে নানান মত এসেছে। তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্রতম ও বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপে বসেও যতটা পারা যায় তাদের চিন্তার রাজ্যগুলোয় বিচরণ করতে করতে মনে হয়েছে সেখানে কেবল ভুলগুলো চিহ্নিত আছে। ভুল সংশোধনের কঠিন কঠিন পথ আছে। আর তার থেকে বেশি আছে শক্তি দিয়ে শক্তিকে ব্যালান্স করার কৌশল। জিওগ্রাফির কথা এলেই এসেছে প্রতিটি জিওগ্রাফির পাওয়ারের কথা। লিবারলইজম, গণতন্ত্র সবই পাওয়ারের কাছে মারা যাচ্ছে- অথচ খোঁজা হচ্ছে পাওয়ারের বিকল্প পাওয়ারকে। সেখানে পাওয়ারগুলো তত্ত্ব দিয়ে, নিরেট কঠিন পথ দিয়ে ভরা।
এ সবের মাঝে সমাধান খুঁজতে খুঁজতে কখনও কখনও মনে হয়, পরিবার, সমাজ, নিশ্চয়তা সবই যখন রাষ্ট্রের হাতে চলে গেছে। তাই পরিবারে বা সমাজে এখন আর ঠাকুরদা বা দাদাঠাকুরের কোন কাজ নেই। হয়তো সেই ঠাকুরদা বা দাদাঠাকুর হবার খোলা বারান্দাটা বা আরাম কেদারাটাও নেই।
তবে রাষ্ট্র কি একজন রবীন্দ্রনাথের ওই নাটকগুলোর ঠাকুরদা বা দাদাঠাকুর তৈরি করতে পারে না? যার রাগ নেই, ক্রোধ নেই অথচ বাবার মাথায়ও হাত বুলান, নাতির মাথায়ও হাত বুলান- আবার কখনও কখনও নিজের আনন্দে নয়, সকল শিশুর আনন্দে তাদের সঙ্গে নাঁচেনও। অথচ এই সংসারে তার আর কোন জৈবিক আসক্তি নেই। কাজ শুধু তার হৃদয়ের উত্স হতে আসা ভালোবাসার জারকরসে সিক্ত জ্ঞানকে আনন্দময় করে সমাধান দেয়া। যিনি সকলের থেকে বয়োবৃদ্ধ হয়েও শিশুর মতো নির্মল পবিত্রতা দিয়ে সকল শিশুকে সঙ্গে নিয়ে যখন যেখানে আলো, আনন্দ আর বাতাস এর দরকার হয় সেখানেই থাকেন।
রবীন্দ্রনাথের এই ঠাকুরদার মাঝে কি একবার খুঁজে দেখা যায় না বর্তমান বিশ্বের সব পাওয়ারকে কোমল করার কোন পথ? আবার মনে হয়, এটাই সত্য পথ হলেও বাস্তবতা তাকে নেবে না। কারণ, ঠাকুরদা তো টাকার থলি বাবার কাছে দিয়ে পৃথিবীর রূপ রস গন্ধে পাগল এক কবি। শিশুও বেশিদিন ঠাকুরদার কাছে থাকে না, বরং দ্রুতই তাকে টেনে নিয়ে যায় বাবার টাকার থলি, তার পরে নিজেও হন বাবা। রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদার পৃথিবীতে সমুদ্র মন্থন শেষ করেও কি যাওয়া যায়? আবার না গেলেও পৃথিবী বাবার টাকার থলিতেই আটকে থাকে। আর ঠাকুরদা যেহেতু কবি তাই রাষ্ট্র তো কবিকে নগরের বাইরেই রাখতে বলেছে। তাই যার হাতে রাষ্ট্র সেই যদি কখনও রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা বা দাদাঠাকুর হন তাহলে হয়তো শিশু থেকে বাবা সকলের মাথায় একটি শান্ত হাতের ছোঁয়া পড়ার সুযোগ হয়।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ, The Present World.
Leave a Reply