১১:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১০)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০৬:৫৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • 20

জীবনকথা

বাজান টের পাইলে এত ভোরে কোথাও যাইতে দিবেন না। আমাদের উঠান পার হইয়া নেহাজন্দীদের ঘরের পিছনে কলার ভেলা। আস্তে আস্তে দুই ভাই ভেলার উপর সোয়ার হইয়া দুইটা চইড় দিয়া ভেলা ঠেলিতে লাগিলাম। হনু শেখের পাটক্ষেত বামে ফেলিয়া কমিরদীর ধানক্ষেতের পাশ দিয়া ভেলা লইয়া ভাসিয়া চলিলাম। এখানে ওখানে দু’একটি মাছ লাফালাফি করিতেছে। কারিকর পাড়ার জঙ্গলে কতরকমের পাখি ডাকিতেছে। ওই তো দূরে তালগাছ দুইটি দেখা যায়। হদু মল্লিকের পুতের বউ এখনও এলোচুল মেলিয়া দিয়া গাছের উপর দাঁড়াইয়া আছে নাকি। ভয়ে নিশ্বাস বন্ধ হইতে চায়। কিন্তু পাকা পাকা তালের ঘ্রাণ নাকে আসিতেছে। এখনই শব্দ করিয়া একটি তাল পানিতে পড়িল। দুই ভাই আরও জোরে জোরে ভেলা ঠেলিয়া তালগাছের গোড়ায় লইয়া গেলাম। তখন একটু একটু আলো হইয়াছে। দেখি গাছতলায় সামান্য মাথা জাগাইয়া কত তাল ভাসিতেছে।
আমরা মনের আনন্দে পাঁচ ছয়টা তাল ভেলায় উঠাইয়াছি, এমন সময় শব্দ করিয়া হাতের লগি পানিতে পড়িয়া গেল। হদু মল্লিক গলা খেঁকারি দিয়া ডাকিয়া উঠিল, “এত সকালে তালতলায় কেরে?” অমনি আমরা ভেলা ঠেলিয়া বাড়ির মুখে। ইরালি-বিরালি লতার ঘাসে ভেলা আটকাইয়া যায়। প্রাণপণে তাহা ছাড়াইয়া গায়ের যত জোর দিয়া ভেলা ঠেলি কিন্তু প্রভাতের সূর্য আমাদের শত্রু হইয়া উঠিয়াছে। হদু মল্লিক উচ্চগলায় চিৎকার করিতে লাগিল-ওই যে জছী আর নেহা আমার তাল চুরি করিয়া লইয়া যায়। ধর! ধর। কিন্তু ধরিবে কে? তাঁতিদের বাড়ি উচ্চ জায়গায়, তাহাদের নৌকা বা কলার ভেলা নাই। আমরা তাড়াতাড়ি বাড়ি আসিয়া পৌঁছিলাম। মুরব্বিরা এইজন্য কম বকিলেন না; কিন্তু তাল চুরির মধ্যে যে অপূর্ব রোমাঞ্চ অনুভব করিয়াছিলাম তাহা সমস্ত বকাবকিকে অতিক্রম করিল। হদু মল্লিকের এই তালগাছ আরও এক কারণে আমার নিকট বড়ই রহস্যময় ছিল।
এই তালগাছের ডালে ডালে শত শত বাবুই পাখির বাসা। স্কুল হইতে ফিরিবার সময় কতদিন যে বইখাতা বোগলে করিয়া এই তালগাছ দুটির পানে চাহিয়া থাকিয়াছি তাহার আর কোনো ইয়ত্তা নেই। স্কুল হইতে ফিরিবার সময় ক্ষুধায় পেট জ্বলিয়া যাইত। জোরে জোরে পা ফেলিতাম বাড়ি আসিবার জন্য। কিন্তু এই তালগাছ দুটির নিকটে আসিয়া সকল ভুলিয়া যাইতাম। কি সুন্দর নৈপুণ্যের সঙ্গে বাবুই পাখিগুলি বাসা বানাইত। একটি পাখি থাকিত বাসার উপরে আর একটি বাসার ভিতরে বসিয়া। সে চঞ্চুর সাহায্যে অতি কলা-কৌশলের সঙ্গে তালপাতার আঁশগুলি উপরে উঠাইয়া দিত, আবার উপরের পাখিটা সেই আঁশকে চঞ্চুর সাহায্যে নিচে বিলি দিয়া দিত। এইভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাসের পর মাস কোনো এক জোড়া পাখি সবুজ পাতার আঁশ দিয়া নতুন বাসা বানাইত। তাদের বোধহয় নতুন দাম্পত্য জীবন সবে আরম্ভ হইয়াছে। বাসা বানাইতে এ ওর গায়ে পাখা ঘষিয়া আদর করিত। ঠোঁটের পাতার সুতালি ফুরাইয়া গেলে দুইজনে উড়িয়া যাইয়া অপর গাছ হইতে পাতা চিরিয়া সুতালি তৈরি করিয়া আবার ফিরিয়া আসিয়া বাসা বানানোর কাজে লাগিয়া যাইত।
কোনো কোনো বাবুই দম্পতি তাহাদের পুরাতন বাসার যেটুকু ঝড়ে বা রৌদ্র বৃষ্টিতে নষ্ট হইয়া গিয়াছে, তাহা নতুন করিয়া বুনট করিত। দুইটি তালগাছ ভরিয়া শত শত বাসা। কত রকমেই বাবুই পাখিগুলি ডাকিত। আস্তে, জোরে, বিলম্বিত লয়ে। যাহাদের বাসা তৈরি হইয়া গিয়াছে তাহারা দল বাঁধিয়া নিকটের ফসলক্ষেত হইতে শস্যকণা টুকাইয়া লইয়া বাসায় ফিরিয়া আসিত। এ কি কম রহস্যের ব্যাপার। দেখিয়া দেখিয়া আশ মিটিত না।
(চলবে)……..

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১০)

১১:০৬:৫৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

জীবনকথা

বাজান টের পাইলে এত ভোরে কোথাও যাইতে দিবেন না। আমাদের উঠান পার হইয়া নেহাজন্দীদের ঘরের পিছনে কলার ভেলা। আস্তে আস্তে দুই ভাই ভেলার উপর সোয়ার হইয়া দুইটা চইড় দিয়া ভেলা ঠেলিতে লাগিলাম। হনু শেখের পাটক্ষেত বামে ফেলিয়া কমিরদীর ধানক্ষেতের পাশ দিয়া ভেলা লইয়া ভাসিয়া চলিলাম। এখানে ওখানে দু’একটি মাছ লাফালাফি করিতেছে। কারিকর পাড়ার জঙ্গলে কতরকমের পাখি ডাকিতেছে। ওই তো দূরে তালগাছ দুইটি দেখা যায়। হদু মল্লিকের পুতের বউ এখনও এলোচুল মেলিয়া দিয়া গাছের উপর দাঁড়াইয়া আছে নাকি। ভয়ে নিশ্বাস বন্ধ হইতে চায়। কিন্তু পাকা পাকা তালের ঘ্রাণ নাকে আসিতেছে। এখনই শব্দ করিয়া একটি তাল পানিতে পড়িল। দুই ভাই আরও জোরে জোরে ভেলা ঠেলিয়া তালগাছের গোড়ায় লইয়া গেলাম। তখন একটু একটু আলো হইয়াছে। দেখি গাছতলায় সামান্য মাথা জাগাইয়া কত তাল ভাসিতেছে।
আমরা মনের আনন্দে পাঁচ ছয়টা তাল ভেলায় উঠাইয়াছি, এমন সময় শব্দ করিয়া হাতের লগি পানিতে পড়িয়া গেল। হদু মল্লিক গলা খেঁকারি দিয়া ডাকিয়া উঠিল, “এত সকালে তালতলায় কেরে?” অমনি আমরা ভেলা ঠেলিয়া বাড়ির মুখে। ইরালি-বিরালি লতার ঘাসে ভেলা আটকাইয়া যায়। প্রাণপণে তাহা ছাড়াইয়া গায়ের যত জোর দিয়া ভেলা ঠেলি কিন্তু প্রভাতের সূর্য আমাদের শত্রু হইয়া উঠিয়াছে। হদু মল্লিক উচ্চগলায় চিৎকার করিতে লাগিল-ওই যে জছী আর নেহা আমার তাল চুরি করিয়া লইয়া যায়। ধর! ধর। কিন্তু ধরিবে কে? তাঁতিদের বাড়ি উচ্চ জায়গায়, তাহাদের নৌকা বা কলার ভেলা নাই। আমরা তাড়াতাড়ি বাড়ি আসিয়া পৌঁছিলাম। মুরব্বিরা এইজন্য কম বকিলেন না; কিন্তু তাল চুরির মধ্যে যে অপূর্ব রোমাঞ্চ অনুভব করিয়াছিলাম তাহা সমস্ত বকাবকিকে অতিক্রম করিল। হদু মল্লিকের এই তালগাছ আরও এক কারণে আমার নিকট বড়ই রহস্যময় ছিল।
এই তালগাছের ডালে ডালে শত শত বাবুই পাখির বাসা। স্কুল হইতে ফিরিবার সময় কতদিন যে বইখাতা বোগলে করিয়া এই তালগাছ দুটির পানে চাহিয়া থাকিয়াছি তাহার আর কোনো ইয়ত্তা নেই। স্কুল হইতে ফিরিবার সময় ক্ষুধায় পেট জ্বলিয়া যাইত। জোরে জোরে পা ফেলিতাম বাড়ি আসিবার জন্য। কিন্তু এই তালগাছ দুটির নিকটে আসিয়া সকল ভুলিয়া যাইতাম। কি সুন্দর নৈপুণ্যের সঙ্গে বাবুই পাখিগুলি বাসা বানাইত। একটি পাখি থাকিত বাসার উপরে আর একটি বাসার ভিতরে বসিয়া। সে চঞ্চুর সাহায্যে অতি কলা-কৌশলের সঙ্গে তালপাতার আঁশগুলি উপরে উঠাইয়া দিত, আবার উপরের পাখিটা সেই আঁশকে চঞ্চুর সাহায্যে নিচে বিলি দিয়া দিত। এইভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাসের পর মাস কোনো এক জোড়া পাখি সবুজ পাতার আঁশ দিয়া নতুন বাসা বানাইত। তাদের বোধহয় নতুন দাম্পত্য জীবন সবে আরম্ভ হইয়াছে। বাসা বানাইতে এ ওর গায়ে পাখা ঘষিয়া আদর করিত। ঠোঁটের পাতার সুতালি ফুরাইয়া গেলে দুইজনে উড়িয়া যাইয়া অপর গাছ হইতে পাতা চিরিয়া সুতালি তৈরি করিয়া আবার ফিরিয়া আসিয়া বাসা বানানোর কাজে লাগিয়া যাইত।
কোনো কোনো বাবুই দম্পতি তাহাদের পুরাতন বাসার যেটুকু ঝড়ে বা রৌদ্র বৃষ্টিতে নষ্ট হইয়া গিয়াছে, তাহা নতুন করিয়া বুনট করিত। দুইটি তালগাছ ভরিয়া শত শত বাসা। কত রকমেই বাবুই পাখিগুলি ডাকিত। আস্তে, জোরে, বিলম্বিত লয়ে। যাহাদের বাসা তৈরি হইয়া গিয়াছে তাহারা দল বাঁধিয়া নিকটের ফসলক্ষেত হইতে শস্যকণা টুকাইয়া লইয়া বাসায় ফিরিয়া আসিত। এ কি কম রহস্যের ব্যাপার। দেখিয়া দেখিয়া আশ মিটিত না।
(চলবে)……..