০৭:১৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২০)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:২৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • 19

আমার অন্ধ দাদা

দ্রুত লয়ে খাটো করিয়া, কখনও ধমকের সুরে, কখনও আবেগমিশ্রিত সুরে, কখনও জোরে জোরে দাপটের সঙ্গে, কখনও ফিসফিস করিয়া মনে মনে কথা বলার মতো করিয়া, কাহিনীর বিষয়বস্তুটিকে তিনি শ্রোতাদের মধ্যে জীবন্ত করিয়া তুলিতেন।

এইভাবে দাদার মুখে যে কত কেচ্ছা শুনিয়াছি তাহার আর ইয়ত্তা নাই। সেইসব কেচ্ছা বলাইতে আমাকে আর নেহাকে অনেক কাঠখড়ি পোড়াইতে হইত। কত কষ্ট করিয়া খেজুর টোকাইয়া আনিয়া অনেক সাধ্যসাধনা করিয়া দাদাকে তাহার ভাগ দিতাম। ডুমকুর, জাম, পেয়ারা, বেথুল পাড়িয়া আনিয়া দাদাকে সাধিয়া সাধিয়া খাওয়াইতাম। আর গল্প আরম্ভ করিবার আগে যে কত অনুনয়-বিনয় করিতে হইত তাহার কিছুটা পরিচয় পাঠক আগেই পাইয়াছেন। দাদার নিকট আমরা আবদুল বাদশার গল্প, জিতুধরের গল্প, রূপবান কন্যার গল্প, আরও কত কি শুনিয়াছি, আজ ভালোমতো মনেও নাই। যে-বয়সে গল্প শুনিয়া মনে রাখিতে পারিতাম, দাদা তখন চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হইয়াছেন। মনের অগোচরে কখনও কখনও কোনো কোনো গানের কলি আমার কণ্ঠে আসিয়া ভর করে-

“মা তো আমার বকরি রাখে

বাপতো অন্ধ ঘরেরে,

লাউকি মইল পথের দিকে চায়ায়ে।”

এই লাউকি কে? কেন পথের দিকে চাহিয়া থাকে? গান গাহিতে গাহিতে কেবলি এই প্রশ্ন আমার মনে উদয় হয়। কিন্তু কে ইহার উত্তর দিবে? আরও একটি গানের কলি মনে পড়ে:

“পূর্ণিমার চান্দ উঠছেরে

ও বিবি তারা লয়া সাথেরে,

হারে নারে ও নারে নারেরে।”

তারা সঙ্গে লইয়া কোন দেশে এমন চাঁদ উঠিয়াছে?

একথা কোন বিবিকে কে বলিতেছে,

কেন বলিতেছে?

আরও একটি গানের কলি:

“আমার ভুজা রসের ভুজারে

ও কন্যা লক্ষ টাকা দামরে,

ও হারে নারে ও নারে নারে নারেরে।”

কে সেই ভুজাওয়ালা? কোন কন্যার দুয়ারে দাঁড়াইয়া সে ভুজা বেচিতে আসিয়াছে? এই প্রশ্নের উত্তর কে দিবে?

সেই কহকুণ্ড পাখির কেচ্ছার গান:

“আজ কেন কহরে কুণ্ড কোথায় রইলো?

মাতো গেল আগুন আনতে

ফিরা নহেরে-আইল।”

আরও একটা কিচ্ছার গান মনে পড়ে:

“তোমার হাতে দেখি নাল গামছা-

তোমার কান্ধে নাল ও ছাতিরে,

হ্যাদেরে গিধাড়ী

কোন শহরে ভালো তোমার বাড়ি ঘর হে।”

গান গাহিতে গাহিতে দুই চোখ ভরিয়া পানি আসে। ভাসাভাসা মনে পড়িতেছে, স্বামীকে খাইয়া তার রক্তে সমস্ত অঙ্গ লাল করিয়া গিধারী আসিয়া রাজকন্যার ছাতের উপর বসিয়াছে। রাজকন্যার প্রশ্নের উত্তরে গিধারী কি উত্তর দিল? এইসব কথা বিস্মৃতির অন্ধকারে মিলাইয়া গিয়াছে। হয়তো আজও কোনো গ্রামবৃদ্ধ এইসব গল্প বলিয়া আমাদেরই মতো তার নাতি-নাতনিদের মুগ্ধ করিতেছে। যদি সামর্থ্য থাকিত, পল্লীবাংলার ঘরে ঘরে ঘুরিয়া বেড়াইবার শক্তি পাইতাম, তবে এই অমৃত ভোগ কুড়াইয়া আনিয়া আমার দেশবাসীকে উপহার দিতাম: কিন্তু বাতব্যাধিতে প্রায় পঙ্গু হইতে বসিয়াছি। আর কি ফিরাইয়া পাইব স্বাস্থ্য? আর কি ফিরাইয়া পাইব সামর্থ্য? জীবনে কত আজেবাজে কাজ করিয়া সময় নষ্ট করিয়াছি। তখন সামর্থ্য থাকিতে কেন এ-কাজ করি নাই?

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২০)

১১:০০:২৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আমার অন্ধ দাদা

দ্রুত লয়ে খাটো করিয়া, কখনও ধমকের সুরে, কখনও আবেগমিশ্রিত সুরে, কখনও জোরে জোরে দাপটের সঙ্গে, কখনও ফিসফিস করিয়া মনে মনে কথা বলার মতো করিয়া, কাহিনীর বিষয়বস্তুটিকে তিনি শ্রোতাদের মধ্যে জীবন্ত করিয়া তুলিতেন।

এইভাবে দাদার মুখে যে কত কেচ্ছা শুনিয়াছি তাহার আর ইয়ত্তা নাই। সেইসব কেচ্ছা বলাইতে আমাকে আর নেহাকে অনেক কাঠখড়ি পোড়াইতে হইত। কত কষ্ট করিয়া খেজুর টোকাইয়া আনিয়া অনেক সাধ্যসাধনা করিয়া দাদাকে তাহার ভাগ দিতাম। ডুমকুর, জাম, পেয়ারা, বেথুল পাড়িয়া আনিয়া দাদাকে সাধিয়া সাধিয়া খাওয়াইতাম। আর গল্প আরম্ভ করিবার আগে যে কত অনুনয়-বিনয় করিতে হইত তাহার কিছুটা পরিচয় পাঠক আগেই পাইয়াছেন। দাদার নিকট আমরা আবদুল বাদশার গল্প, জিতুধরের গল্প, রূপবান কন্যার গল্প, আরও কত কি শুনিয়াছি, আজ ভালোমতো মনেও নাই। যে-বয়সে গল্প শুনিয়া মনে রাখিতে পারিতাম, দাদা তখন চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হইয়াছেন। মনের অগোচরে কখনও কখনও কোনো কোনো গানের কলি আমার কণ্ঠে আসিয়া ভর করে-

“মা তো আমার বকরি রাখে

বাপতো অন্ধ ঘরেরে,

লাউকি মইল পথের দিকে চায়ায়ে।”

এই লাউকি কে? কেন পথের দিকে চাহিয়া থাকে? গান গাহিতে গাহিতে কেবলি এই প্রশ্ন আমার মনে উদয় হয়। কিন্তু কে ইহার উত্তর দিবে? আরও একটি গানের কলি মনে পড়ে:

“পূর্ণিমার চান্দ উঠছেরে

ও বিবি তারা লয়া সাথেরে,

হারে নারে ও নারে নারেরে।”

তারা সঙ্গে লইয়া কোন দেশে এমন চাঁদ উঠিয়াছে?

একথা কোন বিবিকে কে বলিতেছে,

কেন বলিতেছে?

আরও একটি গানের কলি:

“আমার ভুজা রসের ভুজারে

ও কন্যা লক্ষ টাকা দামরে,

ও হারে নারে ও নারে নারে নারেরে।”

কে সেই ভুজাওয়ালা? কোন কন্যার দুয়ারে দাঁড়াইয়া সে ভুজা বেচিতে আসিয়াছে? এই প্রশ্নের উত্তর কে দিবে?

সেই কহকুণ্ড পাখির কেচ্ছার গান:

“আজ কেন কহরে কুণ্ড কোথায় রইলো?

মাতো গেল আগুন আনতে

ফিরা নহেরে-আইল।”

আরও একটা কিচ্ছার গান মনে পড়ে:

“তোমার হাতে দেখি নাল গামছা-

তোমার কান্ধে নাল ও ছাতিরে,

হ্যাদেরে গিধাড়ী

কোন শহরে ভালো তোমার বাড়ি ঘর হে।”

গান গাহিতে গাহিতে দুই চোখ ভরিয়া পানি আসে। ভাসাভাসা মনে পড়িতেছে, স্বামীকে খাইয়া তার রক্তে সমস্ত অঙ্গ লাল করিয়া গিধারী আসিয়া রাজকন্যার ছাতের উপর বসিয়াছে। রাজকন্যার প্রশ্নের উত্তরে গিধারী কি উত্তর দিল? এইসব কথা বিস্মৃতির অন্ধকারে মিলাইয়া গিয়াছে। হয়তো আজও কোনো গ্রামবৃদ্ধ এইসব গল্প বলিয়া আমাদেরই মতো তার নাতি-নাতনিদের মুগ্ধ করিতেছে। যদি সামর্থ্য থাকিত, পল্লীবাংলার ঘরে ঘরে ঘুরিয়া বেড়াইবার শক্তি পাইতাম, তবে এই অমৃত ভোগ কুড়াইয়া আনিয়া আমার দেশবাসীকে উপহার দিতাম: কিন্তু বাতব্যাধিতে প্রায় পঙ্গু হইতে বসিয়াছি। আর কি ফিরাইয়া পাইব স্বাস্থ্য? আর কি ফিরাইয়া পাইব সামর্থ্য? জীবনে কত আজেবাজে কাজ করিয়া সময় নষ্ট করিয়াছি। তখন সামর্থ্য থাকিতে কেন এ-কাজ করি নাই?