০৭:৩৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

প্রকৃতিবিদের কাহিনী (কাহিনী-৩৯)

  • Sarakhon Report
  • ০৮:০১:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • 20

পিওতর মান্তেইফেল

পতঙ্গের একটা বৈশিষ্ট্য
পয়লা মে’র রোদ ভরা সকালে সবার সঙ্গে আমিও নেমেছি রাস্তায়। উৎসবের মিছিলে তা ভরে উঠেছে অনেক আগেই। জনস্রোত কূল ছাপিয়ে ফুটপাথ, আঙিনা, সব ভাসিয়ে দিচ্ছে।
আমাদের সারিটা থেমে গেল। উচুতে গর্জন করে উঠল এরোপ্লেনের ইঞ্জিন। মাথার ওপর দিয়ে সারি বেধে উড়ে যাচ্ছিল ইস্পাতের পাখিরা, মাটিতে পিছলে যাচ্ছিল তাদের ক্ষিপ্র ছায়া। আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা কালো বিন্দু চোখে পড়ল আমার। অনেক উঁচু থেকে তা নেমে আসতে লাগল সোজা আমার দিকে। দেখা গেল সেটা ভ্রমর। নির্ভুল লক্ষ্যে তা এসে বসল আমার বাটুন-হোলে গোঁজা এক স্তবক লিলি-অব-দ্যা-ভালি ফুলে। আমার কাছেই ছিল একদল কিশোর জীববিদ। তাদের অবাক লাগল এই দেখে যে অত উচু থেকে ভ্রমরটা ছোট্ট একগুছি লিলির গন্ধ ‘টের পেল’ কেমন করে – জ্বলজ্বলে সাজগোজ করা শোভাযাত্রীদের সারির মধ্যে সে ফুল যে চোখেই পড়েই না, রোদে তপ্ত পিচ থেকে ওঠা হাজার হাজার গন্ধে তার সৌরভ যে একেবারেই অকিঞ্চিৎকর। কাঁট-পতঙ্গের ঘ্রাণশক্তি সম্পর্কে প্রশ্নে প্রশ্নে ওরা ছে’কে ধরল আমায়।
কিশোর বন্ধুদের জবাব দিতে আমার আরো কয়েকটা অভিজ্ঞতার কথা বললাম ওদের। ছাত্রজীবনেই আমি একবার গুটি থেকে বিরল জাতের একটা নৈশ প্রজাপতি বার করি, লাতিনে তার নাম Orgia antigua। এদের মন্দাদের পাখা বেশ সুবিকশিত, পাটকিলে রঙের ওপর শাদা শাদা ফুটকি, শুড়গুলো ঘন, চিরুনির মতো। মাদীদের শড় কিন্তু সরু সরু, সুতোর মতো, তাছাড়া তাদের পাখা থাকে না। গুটি থেকে বার করে আমি আমার বন্দিনীকে রাখি গজ কাপড়ের একটা থলিতে। এই ধরনের প্রজাপতির দেখা মেলে কদাচিৎ, তাও কেবল বনে। সন্ধ্যায় আমি থলিটা ঝুলিয়ে রাখি বারান্দায়। দেখে একেবারে অবাক হয়ে গেলাম যে মাঠ পেরিয়ে সারি বোধে মন্দা প্রজাপতিরা উড়ে আসছে থলিটার দিকে। আসছে তারা বন থেকে আর সে বন আমার বাসা থেকে এক কিলোমিটারের বেশি দূরে। বাতাসের উল্টো দিকে সোজা রেখায় এসে তারা থলিটায় ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগল। যে ‘ঘ্রাণশক্তিতে’ প্রায় দেড় কিলোমিটার দূর থেকেও মন্দারা ছোট্ট বন্দিনীটির অস্তিত্ব টের পায়, তাতে স্তম্ভিত হবে না কে!
ফেলানি খাদ্যের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে মাছির ভন-৬নানি দেখতে আমরা অভ্যন্ত, কিন্তু মাছিগুলো তার শিকারের সন্ধান পায় কোথেকে তা নিয়ে বড়ো ভাবি না। জানলা দিয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া একটুকরো মাংস ছুড়ে দিলে দেখা যাবে শিগগিরই তা বড়ো বড়ো সোনালী মাছিতে ছেয়ে গেছে, যেন ঠিক এরই অপেক্ষায় ছিল। বহ মাছি আবার কয়েকটা পাড়া পেরিয়েও উড়ে আসে।
উত্তরী হরিণদের অবিরাম উৎপীড়ক গো-মাছিরা তাদের শিকারের সন্ধান পায় বিশ কিলোমিটারেরও বেশি দূর থেকে। আমরা এও দেখেছি যে পাখি মারা পড়ার দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যেই দূর থেকে উড়ে এসেছে গুবরেজাতীয় পোকা। পাখির মাংস পচতে শুরু করার আগেই ‘মাংসভুক মাছি’ আর গুবরেরা পাখির লাসের দিকে ধাওয়া করেছে। মরুভূমিতে কারাভান চলে যাবার পর বালিতে উটের গোবর পড়ে থাকলে তৎক্ষণাৎ কে জানে কোথা থেকে হঠাৎ উড়ে আসে বড়ো বড়ো গুবরে পোকা।
পতঙ্গদের এই আশ্চর্য ক্ষমতার কারণ তাদের স্নায়ুকোষ অসাধারণ সুবেদী, আর এ কোষ থাকে তাদের শুঁড়ে, পেয়ালাকৃতি গর্তের মধ্যে অনান্ত।
মন্দা প্রজাপতি, কয়েক জাতের গুবরে ও অন্যান্য পতঙ্গের শুঁড়গুলো হয় চিরুনির মতো। এ রূপ গঠনের ফলে প্রত্যঙ্গটির উপরিভাগের সুবেদিতা বহুগুণ বেড়ে যায়। পতঙ্গদের কাছে বাতাস গন্ধ (এবং শুধুই কি গন্ধ?) বয়ে আনে মাঝে মাঝে কয়েক ডজন কিলোমিটার দূর থেকে। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বাতাসের উল্টো মুখে সরু একটা ফিতের আকারে উড়ে পতঙ্গেরা তাদের মাদী বা খাদ্যের সন্ধানে পাড়ি দিচ্ছে বিপুল দূরত্ব।
১৯৩৬ সালে গ্রীষ্মে চিড়িয়াখানার কিশোর জীববিদ গর্শকভ একতাল গোবর থেকে ধরে তিরিশটি নীলচে-সবুজ মাছি। তাদের ওপর ময়দা ছিটিয়ে গর্শকভ বিভিন্ন দূরত্ব থেকে পাঁচটি করে মাছি ছাড়তে থাকে। গোবরের তালটা তারা খুঁজে বার করে এমনকি সাত শ’ মিটার দূর থেকেও। খোঁচা খোঁচা রোঁয়ার মধ্যে গায়ে লেগে থাকা ময়দা দেখে গর্শ কভ অনায়াসে সনাক্ত করে তাদের।
পরীক্ষায় দেখা গেছে, পতঙ্গের শাঁড়ে প্যারাফিনের পাতলা প্রলেপ লাগালে তারা জোরালো গন্ধছাড়া খাদ্যও ধরতে পারে না।

প্রকৃতিবিদের কাহিনী (কাহিনী-৩৯)

০৮:০১:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পিওতর মান্তেইফেল

পতঙ্গের একটা বৈশিষ্ট্য
পয়লা মে’র রোদ ভরা সকালে সবার সঙ্গে আমিও নেমেছি রাস্তায়। উৎসবের মিছিলে তা ভরে উঠেছে অনেক আগেই। জনস্রোত কূল ছাপিয়ে ফুটপাথ, আঙিনা, সব ভাসিয়ে দিচ্ছে।
আমাদের সারিটা থেমে গেল। উচুতে গর্জন করে উঠল এরোপ্লেনের ইঞ্জিন। মাথার ওপর দিয়ে সারি বেধে উড়ে যাচ্ছিল ইস্পাতের পাখিরা, মাটিতে পিছলে যাচ্ছিল তাদের ক্ষিপ্র ছায়া। আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা কালো বিন্দু চোখে পড়ল আমার। অনেক উঁচু থেকে তা নেমে আসতে লাগল সোজা আমার দিকে। দেখা গেল সেটা ভ্রমর। নির্ভুল লক্ষ্যে তা এসে বসল আমার বাটুন-হোলে গোঁজা এক স্তবক লিলি-অব-দ্যা-ভালি ফুলে। আমার কাছেই ছিল একদল কিশোর জীববিদ। তাদের অবাক লাগল এই দেখে যে অত উচু থেকে ভ্রমরটা ছোট্ট একগুছি লিলির গন্ধ ‘টের পেল’ কেমন করে – জ্বলজ্বলে সাজগোজ করা শোভাযাত্রীদের সারির মধ্যে সে ফুল যে চোখেই পড়েই না, রোদে তপ্ত পিচ থেকে ওঠা হাজার হাজার গন্ধে তার সৌরভ যে একেবারেই অকিঞ্চিৎকর। কাঁট-পতঙ্গের ঘ্রাণশক্তি সম্পর্কে প্রশ্নে প্রশ্নে ওরা ছে’কে ধরল আমায়।
কিশোর বন্ধুদের জবাব দিতে আমার আরো কয়েকটা অভিজ্ঞতার কথা বললাম ওদের। ছাত্রজীবনেই আমি একবার গুটি থেকে বিরল জাতের একটা নৈশ প্রজাপতি বার করি, লাতিনে তার নাম Orgia antigua। এদের মন্দাদের পাখা বেশ সুবিকশিত, পাটকিলে রঙের ওপর শাদা শাদা ফুটকি, শুড়গুলো ঘন, চিরুনির মতো। মাদীদের শড় কিন্তু সরু সরু, সুতোর মতো, তাছাড়া তাদের পাখা থাকে না। গুটি থেকে বার করে আমি আমার বন্দিনীকে রাখি গজ কাপড়ের একটা থলিতে। এই ধরনের প্রজাপতির দেখা মেলে কদাচিৎ, তাও কেবল বনে। সন্ধ্যায় আমি থলিটা ঝুলিয়ে রাখি বারান্দায়। দেখে একেবারে অবাক হয়ে গেলাম যে মাঠ পেরিয়ে সারি বোধে মন্দা প্রজাপতিরা উড়ে আসছে থলিটার দিকে। আসছে তারা বন থেকে আর সে বন আমার বাসা থেকে এক কিলোমিটারের বেশি দূরে। বাতাসের উল্টো দিকে সোজা রেখায় এসে তারা থলিটায় ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগল। যে ‘ঘ্রাণশক্তিতে’ প্রায় দেড় কিলোমিটার দূর থেকেও মন্দারা ছোট্ট বন্দিনীটির অস্তিত্ব টের পায়, তাতে স্তম্ভিত হবে না কে!
ফেলানি খাদ্যের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে মাছির ভন-৬নানি দেখতে আমরা অভ্যন্ত, কিন্তু মাছিগুলো তার শিকারের সন্ধান পায় কোথেকে তা নিয়ে বড়ো ভাবি না। জানলা দিয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া একটুকরো মাংস ছুড়ে দিলে দেখা যাবে শিগগিরই তা বড়ো বড়ো সোনালী মাছিতে ছেয়ে গেছে, যেন ঠিক এরই অপেক্ষায় ছিল। বহ মাছি আবার কয়েকটা পাড়া পেরিয়েও উড়ে আসে।
উত্তরী হরিণদের অবিরাম উৎপীড়ক গো-মাছিরা তাদের শিকারের সন্ধান পায় বিশ কিলোমিটারেরও বেশি দূর থেকে। আমরা এও দেখেছি যে পাখি মারা পড়ার দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যেই দূর থেকে উড়ে এসেছে গুবরেজাতীয় পোকা। পাখির মাংস পচতে শুরু করার আগেই ‘মাংসভুক মাছি’ আর গুবরেরা পাখির লাসের দিকে ধাওয়া করেছে। মরুভূমিতে কারাভান চলে যাবার পর বালিতে উটের গোবর পড়ে থাকলে তৎক্ষণাৎ কে জানে কোথা থেকে হঠাৎ উড়ে আসে বড়ো বড়ো গুবরে পোকা।
পতঙ্গদের এই আশ্চর্য ক্ষমতার কারণ তাদের স্নায়ুকোষ অসাধারণ সুবেদী, আর এ কোষ থাকে তাদের শুঁড়ে, পেয়ালাকৃতি গর্তের মধ্যে অনান্ত।
মন্দা প্রজাপতি, কয়েক জাতের গুবরে ও অন্যান্য পতঙ্গের শুঁড়গুলো হয় চিরুনির মতো। এ রূপ গঠনের ফলে প্রত্যঙ্গটির উপরিভাগের সুবেদিতা বহুগুণ বেড়ে যায়। পতঙ্গদের কাছে বাতাস গন্ধ (এবং শুধুই কি গন্ধ?) বয়ে আনে মাঝে মাঝে কয়েক ডজন কিলোমিটার দূর থেকে। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বাতাসের উল্টো মুখে সরু একটা ফিতের আকারে উড়ে পতঙ্গেরা তাদের মাদী বা খাদ্যের সন্ধানে পাড়ি দিচ্ছে বিপুল দূরত্ব।
১৯৩৬ সালে গ্রীষ্মে চিড়িয়াখানার কিশোর জীববিদ গর্শকভ একতাল গোবর থেকে ধরে তিরিশটি নীলচে-সবুজ মাছি। তাদের ওপর ময়দা ছিটিয়ে গর্শকভ বিভিন্ন দূরত্ব থেকে পাঁচটি করে মাছি ছাড়তে থাকে। গোবরের তালটা তারা খুঁজে বার করে এমনকি সাত শ’ মিটার দূর থেকেও। খোঁচা খোঁচা রোঁয়ার মধ্যে গায়ে লেগে থাকা ময়দা দেখে গর্শ কভ অনায়াসে সনাক্ত করে তাদের।
পরীক্ষায় দেখা গেছে, পতঙ্গের শাঁড়ে প্যারাফিনের পাতলা প্রলেপ লাগালে তারা জোরালো গন্ধছাড়া খাদ্যও ধরতে পারে না।