চট্টগ্রামের পটিয়া থানার সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মঙ্গলবার রাতে পুলিশের সংঘর্ষের পর থেকে থানা অবরোধ করে ব্লকেড কর্মসূচি পালন করছে শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধীদের সাথে এই কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছে ছাত্রদল ও ছাত্র শিবিরের নেতাকর্মীরাও।
এই কর্মসূচি থেকে পটিয়া থানার ওসির পদত্যাগ দাবিসহ তিন দফা দাবি জানিয়েছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
সেখান থেকে চট্টগ্রামের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ইবনে হোসাইন জিয়াদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ছাত্রলীগ নেতাকে বাঁচাতে গত রাতে ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়েছে পটিয়া থানার ওসি।
যে কারণে অভিযুক্তের পদত্যাগসহ তিনি দফা দাবিতে তারা এই কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে আসবেন না বলেও জানান।
মঙ্গলবার রাতের এই ঘটনাটিকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কড়া প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের।
বুধবার সকালে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফ সোহেল ফেসবুকে লিখেছেন, “পটিয়া থানা মাটির সাথে মিশায়া দিতে হবে।”
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর সারাদেশে দলবদ্ধভাবে বিশৃঙ্খলা বা মব সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতি সরকারের পক্ষ থেকে কঠোরভাবে মব দমন করার ঘোষণা দেয়ার পরও সেটি বন্ধ হচ্ছে না। কেনই বা একের পর এক এমন মব সৃষ্টি করছে এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধীরা সেই প্রশ্নও সামনে আসছে।
জবাবে আরিফ সোহেল বিবিসি বাংলাকে বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকে শুরু করে আমলাতন্ত্রের সেই পুরনো সিস্টেম রয়েই গেছে। আমরা এটি নিয়ে কথা বলতে গেলে, নিজ থেকে উদ্যোগ নিতে গেলে এটাকে মব বলা হয়। এটা মব নয়, বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের একটা প্রতিক্রিয়া”।
ছাত্রলীগ নেতাকে ধরা নিয়ে কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো জানতে বুধবার সকাল থেকে পটিয়া থানার ওসির সাথে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
তবে চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, মঙ্গলবার রাতে পুলিশ যা করেছে সেটি নিরাপত্তার স্বার্থেই করেছে। এখন এটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা।

কী হয়েছিল মঙ্গলার রাতে?
মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রামের পটিয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের বিষয়টি জানতে সেখানে প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থী, পুলিশ ও স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা।
সেখানে থাকা একজন প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থী জানান, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটার দিকে পটিয়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একটি প্রোগ্রাম আয়োজন করে। প্রোগ্রাম শেষে সেখান থেকে ফেরার পথে রাঙ্গামাটি জেলার ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি দীপঙ্কর তালুকদারকে দেখতে পায় তারা।
ওই শিক্ষার্থীর দাবি, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা দীপঙ্কর তালুকদারের মোবাইল চেক করে। তারা দীপঙ্করকে ছাত্রলীগের অন্তত পাঁচটি হোয়াটস্যাপ গ্রুপের অ্যাডমিন হিসেবে দেখতে পেয়ে তাকে নিয়ে যায় পটিয়া থানায়।
স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল কাইয়ুম বিবিসি বাংলাকে জানান, থানায় পৌঁছানোর পর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে দীপঙ্করকে আটক করতে বলে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা। তবে ওই ছাত্রলীগ নেতার নামে কোনো মামলা না থাকায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে চায়নি।
এ নিয়ে আন্দোলনকারী নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের উত্তেজনা দেখা দেয়। এর এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে বলেও জানান ওই গণমাধ্যমকর্মী।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রামের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ইবনে হোসাইন জিয়াদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ওই ঘটনার পর খবর পেয়ে চট্টগ্রামের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা সেখানে যায়। তখন পুলিশ ছাত্রদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এতে আমাদের বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে”।
পটিয়া থানায় যখন প্রথম দফায় পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, সেই খবর পেয়ে সেখানে ছাত্রদল ও শিবিরের কয়েকজন নেতাও সেখানে গিয়েছিলেন।
পটিয়া থানা ছাত্র শিবিরের সেক্রেটারি গাজী জোবায়ের বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই ঘটনা শুনে আমিসহ কয়েকজন তখন থানার সামনে যাই। তখন পুলিশের এই আচরণের বিরুদ্ধে থানার সামনে একটি সংবাদ সম্মেলন করা হয়”।
তিনি জানান, মঙ্গলবার রাত পৌনে ১২টার দিকে শেষ হয় সংবাদ সম্মেলনটি। তখন পুলিশের তিনটি গাড়িতে প্রায় একশো পুলিশ এসে তাদের ঘিরে ফেলে। সেখানে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, শিবির ও অন্যান্য সংগঠনের ছাত্রদের মারধর করে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও শিবিরের নেতারা দাবি করেন মঙ্গলবার রাতে পুলিশের লাঠিচার্জে অন্তত ২০-২৫ জন আহত হয়। আহতদের অনেকে চিকিৎসা দেয়া হয় পটিয়া মেডিকেলে। সেখান থেকে গুরুত্বর আহত দুইজনকে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জাহেদ মো. নাজমুন নূরকে এ নিয়ে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি ফোন ধরেন তিনি।
তবে থানার সামনে দ্বিতীয় দফায় যখন বৈষম্যবিরোধী ও অন্য ছাত্রসংগঠনের কয়েকজন নেতাকর্মীকে মারধর করা হয় তখন সেখানে ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, শুরু থেকেই পুলিশ শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা এটি নিয়ে বিক্ষোভ করে। পুলিশ পরবর্তীতে নিজেদের আত্নরক্ষার্থেই সব করেছে। উল্টো তারা থানার গ্লাস ভেঙেছে। পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে।

পটিয়া থানা ও মহাসড়ক ব্লকেড
এই ঘটনার জের ধরে বুধবার সকালে চট্টগ্রামের পটিয়া থানা ঘেরাও করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শুরুতে পটিয়া থানার মূল ফটকের সামনে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। সেখানে অবস্থান নিয়ে তারা পুলিশের বিচার দাবিসহ বিভিন্ন শ্লোগান দিতে থাকে।
ঘণ্টাখানেক সেখানে অবস্থানের পর সকাল সাড়ে দশটার দিকে পটিয়া থানার সামনে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের একটি অংশ।
এতে মহাসড়কের দুই পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দেখা যায় তীব্র যানজট।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সাথে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাত্রদল ও শিবিরের নেতাকর্মীরাও এসে এই কর্মসূচিতে যোগ দেয়।
সেখানে থাকা চট্টগ্রাম পাচলাইশ থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ শাহীন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গা থেকে আমরা এখানে এসেছি। প্রয়োজন এখানে আরেকটা জুলাই ঘটাবো। জুলাই যোদ্ধাদের ওপর কোন হামলা বরদাশত করবো না। বৈষম্যবিরোধীসহ সবার সাথে একাত্ম হয়ে আমরা ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ করবো”।
পটিয়া থানা ছাত্র শিবিরের সেক্রেটারি গাজী জোবায়ের বিবিসি বাংলাকে বলেন, ”আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ সংগঠন। তাদের ব্যাপারে পুলিশসহ প্রশাসনের এখনো সিম্প্যাথি কাজ করছে। সেটির বিরুদ্ধে সব ছাত্র সংগঠন এক হয়ে লড়াই করবে।”
থানার সামনে ও মহাসড়কে অবস্থান নেয়ার পর আন্দোলনরত ছাত্ররা বিভিন্ন ধরনের শ্লোগান দিতে থাকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রামের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ইবনে হোসাইন জিয়াদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “হামলাকারী ওসিকে প্রত্যাহার, আটককৃত ছাত্রদের মুক্তি ও হামলাকারী পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া” দাবিতে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
সকাল থেকে শুরু হওয়া এক ব্লকেড কর্মসূচি বিকেল পর্যন্ত চলছিল। দুপুরের পর ঘটনাস্থলে আসে সেনাবাহিনী। তাদেরকে রাস্তা থেকে সড়ে যাওয়ার অনুরোধ জানায়।

কেন এত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে ছাত্ররা?
এই ঘটনা নিয়ে মঙ্গলবার রাত থেকেই নানা প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
বুধবার এক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম পটিয়ার শিক্ষার্থীদের উপর হামলার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানপন্থী সকল রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন ও প্লাটফর্মকে পটিয়ার শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি রিফাত রশীদ বলেছেন এক প্রতিক্রিয়ায় জানান, ”আমরা শুনতে পাচ্ছি, পটিয়া থানার ওসিকে ট্রান্সফার করে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হবে। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে আহত করার পর কোনো বিচারের সম্মুখীন না করেই এই ট্রান্সফার খেলা শিক্ষার্থীরা মেনে নেবে না।”
মঙ্গলবার থেকে এনসিপির শীর্ষ নেতারা দলীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে রংপুরে রয়েছেন। চট্টগ্রামের এই ঘটনার পর রংপুর থেকে কর্মসূচিতে যোগ দিতে চট্টগ্রামে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফ সোহেল।
তিনি অবশ্য কয়েকটি ফেসবুক স্ট্যাটাস কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। সেখানে থানা গুড়িয়ে দেয়ার মতো কথাও বলেছেন তিনি।
আরিফ সোহেল বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যখন পুলিশ স্বেচ্ছায় অক্ষমতা দেখাচ্ছেন ,সেটা দেখে নিজেরা বিচার নিশ্চিত করার কাজটি করেন তখন তাদের থামানোর জন্য যে ন্যারেটিভটা দরকার হয় বা ডিসকোর্সটা দরকার হয়, সেটাকেই মব বলে অভিহিত করা হয়”।
তিনি বলেন, “পটিয়া থানার ওসি স্পষ্ট মব শব্দটা ব্যবহার করেছেন। থানায় ছাত্রলীগের একজনকে নিয়ে গিয়ে দেওয়া হয়েছিল- যে এই ব্যক্তি ছাত্রলীগ করেছে, গত বছর জুলাই অগাস্টে হামলায় অংশ নিয়েছিল। কিন্তু ওসি তাকে না ধরে ছাত্রদের বলেছেন ছাত্ররা মব করছেন। তাদের এই শব্দটা একটা ন্যারেটিভ”, যোগ করেন।
প্রায় ৮ ঘণ্টা সড়ক অবরোধের পর ছাত্রদের একটি প্রতিনিধি দল বিকালে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজির সাথে সাক্ষাৎ করছেন বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম।
ওসিসহ পুলিশদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেকি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ডিআইজি স্যার ছাত্রদের সাথে কথা বলে যে সিদ্ধান্ত নিবেন সেটা আশা করি সবাই মেনে নেবে”।
বিবিসি বাংলা