০৯:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

রাঙামাটির আনারস: শতবর্ষী ঐতিহ্য ও রপ্তানির সম্ভাবনা

রাঙামাটি পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ে আনারস চাষ একটি শতবর্ষী কৃষি ঐতিহ্য। ইতিহাস বলছে, ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই এই অঞ্চলের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী আনারস চাষ করে আসছে। প্রাকৃতিকভাবে উর্বর পাহাড়ি মাটি, ঝরনা ও পাহাড়ি ছড়ার স্বচ্ছ পানি এবং অনুকূল জলবায়ু—সব মিলিয়ে রাঙামাটির আনারস হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে রসালো, মিষ্টি ও সুগন্ধিযুক্ত ফলগুলোর একটি।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আনারসের তুলনায় রাঙামাটির ফলের মান অনেক উন্নত বলে খ্যাতি আছে, যা শুধু স্থানীয় নয়, দেশের বাইরে রপ্তানির ক্ষেত্রেও বড় সম্ভাবনা তৈরি করে।

শতবর্ষী আনারস চাষের উত্তরাধিকার

রাঙামাটির লংগদু, কাউখালী, বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও নানিয়ারচর উপজেলায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী আনারস চাষ করে আসছে। এই চাষ শুধু পেশা নয়—একটি সাংস্কৃতিক পরিচয়। পাহাড়িদের জীবনে জুম চাষের পাশাপাশি আনারস চাষ একটি নির্ভরযোগ্য আয়ের উৎস। অনেক পরিবার আজও এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে এবং ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করতে আনারস চাষের আয়ে নির্ভর করে।

উৎপাদন ও জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা

প্রতি বছর রাঙামাটিতে প্রায় ৪০ হাজার টন আনারস উৎপন্ন হয়। এই বিপুল উৎপাদন সারা দেশের বাজারে সরবরাহ হয় এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

কিন্তু এত বড় উৎপাদনশীলতা থাকা সত্ত্বেও এখানকার আনারস চাষ পুরোপুরি অর্থনৈতিক সম্ভাবনায় রূপান্তরিত হয়নি। এর অন্যতম কারণ সঠিক বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ ও রপ্তানি অবকাঠামোর অভাব।

জাতীয় পর্যায়ে যদি পরিকল্পিতভাবে রাঙামাটির আনারসকে রপ্তানিমুখী কৃষি পণ্যে রূপান্তর করা যায়, তাহলে তা বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি নতুন খাত হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিপণন সংকট

রাঙামাটির প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় যাতায়াত ব্যবস্থা এখনও অনেক সীমিত। কাঁচা রাস্তা, পাহাড়ি উতরাই-চড়াই এবং সড়কপথের অপর্যাপ্ততার কারণে সময়মতো ফল সংগ্রহ ও বাজারজাত করা সম্ভব হয় না।

পাকা আনারস খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই কৃষকরা আনারস বাজারে তুলতে পারে না, ফলে মাঠেই তা পচে যায়।

পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ আনারস নষ্ট হয়। শুধু ফসল অপচয় নয়, এটি সরাসরি কৃষকের আয় হানিও বয়ে আনে। অনেকে হতাশ হয়ে চাষ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

স্থানীয় খাদ্যঘাটতি ও অপচয়ের করুণ চিত্র

এখনও রাঙামাটির কিছু পাহাড়ি ও প্রত্যন্ত এলাকায় মৌসুমি খাদ্যঘাটতি দেখা যায়। অথচ যে বিপুল পরিমাণ আনারস মাঠেই নষ্ট হয়, সেগুলো যদি সঠিক সময়ে সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করা যেত তাহলে স্থানীয় খাদ্যঘাটতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব হতো।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শিশুদের পুষ্টিহীনতা দূর করতে স্কুল ফিডিং কর্মসূচিতে আনারস জুস ব্যবহার করা যেত। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য কম মূল্যের প্রক্রিয়াজাত আনারস সংরক্ষণ করা যেত। এই অর্থনৈতিক অপচয় সামাজিক ক্ষতিতেও রূপান্তরিত হচ্ছে।

সম্ভাবনার দ্বার: রাঙামাটির আনারস থেকে বিশ্ব বাজার

বিশ্বজুড়ে আনারস জুস, আনারস ক্যান, শুকনা আনারস (ড্রাইড ফ্রুট), আনারস জ্যাম, এমনকি আনারস বিয়ার অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও এ ধরনের পণ্যের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। রাঙামাটির আনারস দিয়ে সহজেই ফ্রুট ক্যানিং প্ল্যান্ট স্থাপন করে এইসব পণ্য তৈরি করা সম্ভব। এতে স্থানীয় কাঁচামাল সরবরাহের পাশাপাশি বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

যদি সরকার ও বেসরকারি খাত সমন্বিত উদ্যোগে এগিয়ে আসে, তাহলে রাঙামাটির আনারস রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা সম্ভব।

করণীয় ও পরিকল্পনা

রাঙামাটির আনারস চাষের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ প্রয়োজনঃ

স্থানীয় পর্যায়ে ফল প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র স্থাপন করা
সরকারি বেসরকারি বিনিয়োগে ফ্রুট ক্যানিং ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা
বিশেষায়িত কোল্ড স্টোরেজ ও আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা তৈরি
কৃষকদের প্রশিক্ষণ, ভর্তুকি ও সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা প্রদান
ফল বিপণন, রপ্তানি নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন

রাঙামাটির পাহাড়ে উৎপাদিত আনারস শুধু একটি ফল নয়, বরং এটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক সম্ভাবনাময় সম্পদ।সঠিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে এই শতবর্ষী ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা যেতে পারে একটি শক্তিশালী আনুষঙ্গিক শিল্পখাত।

এটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করা এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে এক নতুন দ্বার উন্মোচন করবে।

সরকার, বেসরকারি খাত এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর যৌথ উদ্যোগে এই উজ্জ্বল সম্ভাবনার বাস্তব রূপায়ন সম্ভব।

রাঙামাটির আনারস: শতবর্ষী ঐতিহ্য ও রপ্তানির সম্ভাবনা

০৫:১৬:২৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০২৫

রাঙামাটি পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ে আনারস চাষ একটি শতবর্ষী কৃষি ঐতিহ্য। ইতিহাস বলছে, ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই এই অঞ্চলের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী আনারস চাষ করে আসছে। প্রাকৃতিকভাবে উর্বর পাহাড়ি মাটি, ঝরনা ও পাহাড়ি ছড়ার স্বচ্ছ পানি এবং অনুকূল জলবায়ু—সব মিলিয়ে রাঙামাটির আনারস হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে রসালো, মিষ্টি ও সুগন্ধিযুক্ত ফলগুলোর একটি।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আনারসের তুলনায় রাঙামাটির ফলের মান অনেক উন্নত বলে খ্যাতি আছে, যা শুধু স্থানীয় নয়, দেশের বাইরে রপ্তানির ক্ষেত্রেও বড় সম্ভাবনা তৈরি করে।

শতবর্ষী আনারস চাষের উত্তরাধিকার

রাঙামাটির লংগদু, কাউখালী, বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও নানিয়ারচর উপজেলায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী আনারস চাষ করে আসছে। এই চাষ শুধু পেশা নয়—একটি সাংস্কৃতিক পরিচয়। পাহাড়িদের জীবনে জুম চাষের পাশাপাশি আনারস চাষ একটি নির্ভরযোগ্য আয়ের উৎস। অনেক পরিবার আজও এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে এবং ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করতে আনারস চাষের আয়ে নির্ভর করে।

উৎপাদন ও জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা

প্রতি বছর রাঙামাটিতে প্রায় ৪০ হাজার টন আনারস উৎপন্ন হয়। এই বিপুল উৎপাদন সারা দেশের বাজারে সরবরাহ হয় এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

কিন্তু এত বড় উৎপাদনশীলতা থাকা সত্ত্বেও এখানকার আনারস চাষ পুরোপুরি অর্থনৈতিক সম্ভাবনায় রূপান্তরিত হয়নি। এর অন্যতম কারণ সঠিক বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ ও রপ্তানি অবকাঠামোর অভাব।

জাতীয় পর্যায়ে যদি পরিকল্পিতভাবে রাঙামাটির আনারসকে রপ্তানিমুখী কৃষি পণ্যে রূপান্তর করা যায়, তাহলে তা বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি নতুন খাত হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিপণন সংকট

রাঙামাটির প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় যাতায়াত ব্যবস্থা এখনও অনেক সীমিত। কাঁচা রাস্তা, পাহাড়ি উতরাই-চড়াই এবং সড়কপথের অপর্যাপ্ততার কারণে সময়মতো ফল সংগ্রহ ও বাজারজাত করা সম্ভব হয় না।

পাকা আনারস খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই কৃষকরা আনারস বাজারে তুলতে পারে না, ফলে মাঠেই তা পচে যায়।

পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ আনারস নষ্ট হয়। শুধু ফসল অপচয় নয়, এটি সরাসরি কৃষকের আয় হানিও বয়ে আনে। অনেকে হতাশ হয়ে চাষ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

স্থানীয় খাদ্যঘাটতি ও অপচয়ের করুণ চিত্র

এখনও রাঙামাটির কিছু পাহাড়ি ও প্রত্যন্ত এলাকায় মৌসুমি খাদ্যঘাটতি দেখা যায়। অথচ যে বিপুল পরিমাণ আনারস মাঠেই নষ্ট হয়, সেগুলো যদি সঠিক সময়ে সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করা যেত তাহলে স্থানীয় খাদ্যঘাটতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব হতো।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শিশুদের পুষ্টিহীনতা দূর করতে স্কুল ফিডিং কর্মসূচিতে আনারস জুস ব্যবহার করা যেত। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য কম মূল্যের প্রক্রিয়াজাত আনারস সংরক্ষণ করা যেত। এই অর্থনৈতিক অপচয় সামাজিক ক্ষতিতেও রূপান্তরিত হচ্ছে।

সম্ভাবনার দ্বার: রাঙামাটির আনারস থেকে বিশ্ব বাজার

বিশ্বজুড়ে আনারস জুস, আনারস ক্যান, শুকনা আনারস (ড্রাইড ফ্রুট), আনারস জ্যাম, এমনকি আনারস বিয়ার অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও এ ধরনের পণ্যের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। রাঙামাটির আনারস দিয়ে সহজেই ফ্রুট ক্যানিং প্ল্যান্ট স্থাপন করে এইসব পণ্য তৈরি করা সম্ভব। এতে স্থানীয় কাঁচামাল সরবরাহের পাশাপাশি বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

যদি সরকার ও বেসরকারি খাত সমন্বিত উদ্যোগে এগিয়ে আসে, তাহলে রাঙামাটির আনারস রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা সম্ভব।

করণীয় ও পরিকল্পনা

রাঙামাটির আনারস চাষের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ প্রয়োজনঃ

স্থানীয় পর্যায়ে ফল প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র স্থাপন করা
সরকারি বেসরকারি বিনিয়োগে ফ্রুট ক্যানিং ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা
বিশেষায়িত কোল্ড স্টোরেজ ও আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা তৈরি
কৃষকদের প্রশিক্ষণ, ভর্তুকি ও সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা প্রদান
ফল বিপণন, রপ্তানি নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন

রাঙামাটির পাহাড়ে উৎপাদিত আনারস শুধু একটি ফল নয়, বরং এটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক সম্ভাবনাময় সম্পদ।সঠিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে এই শতবর্ষী ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা যেতে পারে একটি শক্তিশালী আনুষঙ্গিক শিল্পখাত।

এটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার করা এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে এক নতুন দ্বার উন্মোচন করবে।

সরকার, বেসরকারি খাত এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর যৌথ উদ্যোগে এই উজ্জ্বল সম্ভাবনার বাস্তব রূপায়ন সম্ভব।