আমার মা
আমাদের সংসারে আমার মায়ের দুঃখের সীমা-পরিসীমা ছিল না। আমার মা ছিলেন নানার আদরের মেয়ে। আর দুইটি মেয়ে আগেই মারা গিয়াছে। এই একমাত্র মেয়েটিকে নানা-নানি বড়ই আদর করিয়া পালিতেন। নানার বাড়ি ছিল তাম্বুলখানা গ্রামে। আমাদের বাড়ি হইতে ছয়-সাত মাইল দূরে। সেই গ্রামের চারিদিকে বিজাবন জঙ্গল। সেই জঙ্গলের এখানে-সেখানে দু’চার ঘর মানুষ। শুনিয়াছিলাম অনেক’ আগে সেখানে জঙ্গল ছিল না। বড় বড় আটচালা ঘর তৈরি করিয়া বর্ধিষ্ণু গৃহস্থেরা বাস করিত। লোকজনে সমস্ত গ্রাম কলরব করিত; তারপর কলেরা মহামারিতে, ম্যালেরিয়া জ্বরে প্রায় সমস্ত গ্রাম উজাড় হইয়া যায়। যেখানে ফলবান বৃক্ষ ছিল সেসব জায়গায় বেত, শ্যামালতা, কুমারলতা প্রভৃতি জন্মাইয়া স্থানটিকে মানুষের অগম্য করিয়া তোলে। তারপর শেয়াল, খাটাস, শুয়োর, বাঘ প্রভৃতি জানোয়ারেরা ধীরে ধীরে সেখানে আসিয়া বসতি আরম্ভ করে। বনের মাঝে মাঝে এখানে-সেখানে যেসব গৃহস্থেরা তখনও বসতি উঠাইয়া লইয়া সুদুর লোকালয়ে চলিয়া যায় নাই, তাহাদিগকে সর্বদা এইসব হিংস্র জানোয়ারের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে হইত।
এতদূরের এই বুনোগাঁয়ের মেয়ে কি করিয়া আমাদের বাড়ি আসিল সে ইতিহাস অনেক চেষ্টা করিয়াও জানিতে পারি নাই। মাকে কতবার জিজ্ঞাসা করিয়াছি, “মা। বল তো সেই বুনো দেশের মেয়ে, তুমি কি করিয়া আমাদের বাড়ি আসিলে? কে সেই বিয়ের ঘটক ছিল? বিয়ের দিন কে কে সঙ্গে গিয়াছিল, কে কলমা পড়াইয়াছিল?” মা কোনো উত্তর করিতেন না। কখনও কখনও কৃত্রিম রাগ করিয়া বলিতেন, “তুই তলের কথা টান দিয়া বাহির করিতে চাস।” যখন মনে মনে আমি রসুলউল্লার কথা ভাবিতে চাহি তখন আমার নানান চেহারা মনে পড়ে। মনে হয় নানার মতো তেমনি তিনি স্নেহপ্রবণ-তেমনি তিনি পরহেজগার ছিলেন। নানা যখনই আমাদের বাড়ি আসিতেন, হয়তো নারকেলের লাডু, খইএর মোয়া অথবা কদমা বাতাসা লইয়া আসিতেন। তারপর দু’একদিন থাকিয়া চলিয়া যাইতেন। যাইবার সময় মা কাঁদিয়া ফেলিতেন। কোঁচার খোঁটে চোখ মুছিতে মুছিতে তিনি মাঠের পথ ধরিতেন।
মার সংসারে শ্বাশুড়ি নাই, ভাজ নাই। রান্না হইতে আরম্ভ করিয়া ঘর-সংসারের সমস্ত কাজ মাকে একলা করিতে হইত। খাইয়া লইয়া আমরা যখন ঘুমাইয়া পড়িতাম তখন মা দুই-তিন ধামা ধান ভানিতে ঢেঁকিঘরে ঢুকিতেন। সেই ধান ভানিবার সময় তাহা আলাইবার জন্য লোক নাই। ঢেঁকিতে পার দিতে দিতে মা কাড়াইল দিয়া মাঝে মাঝে লোটের আধভাঙা ধান নাড়িয়া-চাড়িয়া দিতেন।
আমার পিতার প্রতি মার সবচাইতে অভিযোগ ছিল, তিনি ঢেঁকিঘরের তদ্বির তালাশ করিতেন না। ঢেঁকির কাতলা দুইটা প্রায়ই নড়বড় করিত। চুরুনে ঘুণ ধরা। নোটের তলার কাঠের গইড়ার খানিকটা ইদূরে কাটিয়া লইয়া গিয়াছে। সেখান দিয়া যে ধানগুলি ঢুকিয়া পড়ে তাহা ঢেঁকির পাড়ে ভাঙে না। মা বাজানকে বকিতেন আর ধান ভানিতেন। বাজান কিন্তু সেদিকে গ্রাহ্যও করিতেন না। তিনি আমাদের লইয়া দিব্যি আরামে ঘুমাইয়া পড়িতেন। অনেক ঝগড়া ফ্যাসাদের পরে গ্রামে কারও বাড়িতে ছুতোর মিস্ত্রি আসিলে বাজান তাকে ডাকিয়া আনিয়া ঢেঁকির সকল সাজসরঞ্জাম মেরামত করাইয়া দিতেন। কিন্তু সে কয়দিনের জন্য। দুই-চার মাস যাইতে ঢেঁকি যন্ত্র আগে যেমনটি ছিল তেমনটি হইয়া পড়িত। মা’র বকুনি আবার আরম্ভ হইত। আমাদিগকে পিঠা খাওয়াইতে মা যে কত কষ্টই না করিতেন। পিঠার চাল আলাইবার কেহ না থাকিলে তাহা গুঁড়া করা যায় না। মা ঢেঁকিতে দু’চার পাড় দিতেন আবার নামিয়া আসিয়া নোটের চাল নাড়িয়া-চাড়িয়া দিয়া যাইতেন। এইরূপে প্রায় অর্ধেক রাত মা পিঠার চাল কুটিতেন। একটু বড় হইয়া আমি মাঝে মাঝে পিঠার গুঁড়া আলাইয়া দিতাম। তা কি মা আমাকে করিতে দিতে চাহিতেন? যদি আমার কচি হাতে চুরুনের গুঁতা লাগে। অতি সাবধানে মা ঢেঁকিতে পাড় দিতেন। শীতকালের শেষরাত্রে উঠিয়া মা পিঠা বানাইতে বসিতেন।
চলবে…